PANCHAYAT 'SHUDRA JAGORON'

বামফ্রন্টের সময়ে পঞ্চায়েত, ‘এক ধরণের শূদ্র জাগরণ’

রাজ্য

PANCHAYAT SHUDRA JAGORON

সৌরভ গোস্বামী

পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েত আইন তৈরি হয় ১৯৫৬ সালে। ওই বছরেই প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তারপরে ১৯৬৩ সালে দ্বিতীয় বার আইন তৈরি ও নির্বাচন হয়েছিল। কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষের জন্য পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ছিল অধরা। 

পশ্চিমবঙ্গে ১৯৮৪ সালে বঙ্গীয় স্থানীয় স্বশাসন আইনের মাধ্যমে ত্রি-স্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা চালু হয়। ১৯৯৩ সালে ৭২তম সংবিধান সংশোধনী আইনের অনেক আগেই পশ্চিমবঙ্গে এই আইন লাগু হয়ে যায় বামফ্রন্ট সরকারের নেতৃত্বে। মেহতা কমিটির সুপারিশ অনুসারে রাজনৈতিক দল ভিত্তিক নির্বাচনের ডাক দেওয়া হয়। ত্রিস্তর পঞ্চায়েত হল গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি ও জেলা পরিষদ। প্রতিটি সংস্থায় গঠিত হয় প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে এবং প্রতি সংস্থার মেয়াদকাল চার বছর। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার সুষ্ঠু বিন্যাস ও ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ পশ্চিমবঙ্গের স্বায়ত্তশাসনকে জনমুখী ও শক্ত বুনিয়াদের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত করে। ১৯৯৩-এ অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পঞ্চায়েতের ত্রিস্তরেই এক-তৃতীয়াংশ বা ২৩ হাজার মহিলা প্রার্থী নির্বাচিত হন। এই নির্বাচন পর্বে প্রতি স্তরেই তপশিলি জাতি ও উপজাতির জন্য আসন সংরক্ষিত হয়।

পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মূল লক্ষ্য হল ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ ঘটিয়ে তৃণমূল স্তর পর্যন্ত তা পৌঁছে দেওয়া। স্বশাসনের যে গণতান্ত্রিক বনিয়াদ তার সার্থক প্রয়োগ পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মধ্যেই সম্ভব। পঞ্চায়েত আসলে স্থানীয় সরকার। ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ এবং স্থানীয় সরকার প্রয়োজন কারণ, গণতন্ত্রের প্রসার ঘটে। আর গণতন্ত্রের সঙ্গে উন্নয়নের প্রশ্নটি অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরে তৃণমূল স্তরে গণতন্ত্র সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ফলে গ্রামগঞ্জে নাগরিকদের ক্ষমতা কয়েকগুণ বেড়ে গিয়েছিল। গ্রামে পরিষেবা প্রদানে অথবা অন্যান্য সরকারি কাজকর্মে ত্রুটি ঘটলে পঞ্চায়েতকে মানুষ নির্ভয়ে জবাবদিহি করতেন। সরকারের নিয়ন্ত্রকদের হাতের কাছে পাওয়ার ফলে জবাবদিহি চাওয়ার কাজটা অনেকটাই সহজতর ছিল। প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ এবং উপযুক্ত ক্ষমতার অধিকারী স্থানীয় পঞ্চায়েতের প্রয়োজনীয়তা বামফ্রন্ট সরকার তুলে ধরতে পেরেছিল। ক্রয় ক্ষমতা যে বেড়েছিল তার অন্যতম উদাহরণ হিসেবে বলা যায় কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র শিল্প, দোকান-পাট, যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধি। 

তাঁতের কাপড়ের উৎপাদন ১৯৮০-৮১ সালে ছিল ২৫.৫ কোটি মিটার, ১৯৯০-৯১ সালে যা হয় ৪৩.২ কোটি মিটার। ১৯৭৮ সালের জুন মাসে অনুষ্ঠিত প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গ্রামীণ নেতৃত্বের মৌলিক পরিবর্তন হয়। ভূমিহীন,প্রান্তিক,ক্ষুদ্র কৃষক অংশের মানুষই বেশি পরিমাণে পঞ্চায়েতে নির্বাচিত হন। প্রথম পঞ্চায়েতের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মধ্যে বর্গাদারদের শতকরা হার ছিল ১.৮ শতাংশ, ভূমিহীনসহ তিন একরের কম জমির মালিকের প্রতিনিধিত্ব ছিল ২১.৮ শতাংশ। দ্বিতীয় পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় এটা বেড়ে বর্গাদারদের ক্ষেত্রে ৩.১৭ শতাংশ, ভূমিহীনসহ তিন একরের কম জমির মালিকের প্রতিনিধিত্ব ছিল ৩০.১৭ শতাংশ। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় দেখা গেল ৬১ শতাংশ সদস্য/সদস্যার বার্ষিক আয় ২৪ হাজার টাকার কম, ২২.৭ শতাংশ ভূমিহীন, ৭.২ শতাংশ বর্গাদার কিংবা পাট্টা প্রাপক,৩৭.৩ শতাংশ এক একরের কম জমির মালিক, ২৪ শতাংশ মালিকানা ৩ শতাংশের কম। 

অর্থাৎ বামফ্রন্ট সরকারের জমি বন্টন নীতির ফলে পশ্চিমবঙ্গের বেশিরভাগ পঞ্চায়েতে নির্বাচিত হয় গরিব মানুষের প্রতিনিধিরা। এক কথায় ‘‘অবদমিত মনুষ্যত্বের বিকাশ’’ ঘটেছিল। গরিব,পশ্চাদপদ মানুষের আত্মবিশ্বাস, আত্মমর্যাদা বেড়েছিল। যা দিল্লি তথা অবাম শাসিত রাজ্যগুলির থেকে পশ্চিবঙ্গকে পৃথক করে তোলে। সেখানে পঞ্চায়েত হোক বা পৌরসভা- কোনো নির্বাচনই নিয়মিত হয়না। আর, নাম কা ওয়াসতে নির্বাচন হলেও ক্ষমতায় আসে সেই বড়লোক প্রতিনিধি। এ রাজ্যে চিত্রটা ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। রাজ্যে গ্রামোন্নয়নের যাবতীয় দায়িত্ব দেওয়া হয় স্থানীয় পঞ্চায়েতগুলিকে। ফলে, গ্রামে গরিবদের পক্ষে শক্তির ভারসাম্য বদলাতে পঞ্চায়েত-ব্যবস্থা অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছে যার সহায়ক শক্তি হয়েছে জমি বন্টন নীতি। 

রাজ্যে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রখ্যাত অধ্যাপক প্রভাত দত্ত মন্তব্য করেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্তার নেতৃত্বে আছে গরিব মানুষের প্রতিনিধি। এদিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ভারতবর্ষে নজিরবিহীন...সম্ভবত এ এক ধরণের শূদ্র জাগরণ।’’

গত ১২ বছরে পিসি-ভাইপোর সরকার গোটা ব্যবস্থার কোমর ভেঙে দিয়েছে। ক্ষমতায় আসার পরে পরেই ২০১২ সালে গ্রামীণ বিকেন্দ্রীকরণ প্রক্রিয়ার প্রথম আঘাত হানে মমতা ব্যানার্জির সরকার। উত্তর ২৪ পরগনা জেলা পরিষদের ক্ষমতা কেড়ে নিয়ে সেটিকে পঙ্গু করে দেওয়া হয়। মমতার কোপ থেকে রেহাই পায়নি নদীয় এবং মুর্শিদাবাদ জেলাও। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সরিয়ে দিয়ে গ্রামোন্নয়নের দায়িত্ব আমলাদের হাতে তুলে দেওয়া শুরু করে মমতার সরকার। আগে কখনও যা হয়নি, তা শুরু হয় রাজ্যের রাজনীতিতে। পঞ্চায়েত থেকে জেলা পরিষদ, ভোটে হেরেও বিরোধী জনপ্রতিনিধিদের দলবদল করিয়ে ঘুরপথে দখল। গরিব মেহনতির নিজের সরকারকে গুঁড়িয়ে আমলা আর মাতব্বরদের একতরফা নিয়ন্ত্রণ শুরু হয় গ্রামজীবনে।  

গ্রাফিক্স: মনীষ দেব

Comments :0

Login to leave a comment