Post editorial

সবার জন্য স্বাস্থ্য কোন পথে?

সম্পাদকীয় বিভাগ

ডাঃ সুবর্ণ গোস্বামী

সোভিয়েত রাশিয়া প্রথম পথ দেখিয়েছিল, তারপর চীন ও কিউবার অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ বিশ্ব স্বাস্থ্য মহাসম্মেলন ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ স্লোগান তুলেছিল ১৯৭৮ সালে সোভিয়েতের মাটিতে দাঁড়িয়ে। সেদিন স্বাস্থ্যের যে সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছিল ঐ মহাসম্মেলন, তার মূল ভাবনা ছিল রোগবালাই প্রতিরোধ করে সার্বিকভাবে সমৃদ্ধতর জীবনের দিকে কদম কদম এগিয়ে চলা। পরিবেশ, জলবায়ু, নিকাশি, পানীয় জল, আবাসন, কাজের সুযোগ, রোজগার, খাদ্য নিরাপত্তা, পুষ্টি, শিক্ষা, যোগাযোগ ব্যবস্থা, লিঙ্গসাম্য, সামাজিক ন্যায় ইত্যাদির মতো স্বাস্থ্যের আর্থ-সামাজিক নিয়ামকগুলির ক্রমউন্নতির মাধ্যমে শরীর, মন ও সমাজকে ব্যাধিমুক্ত রেখে প্রতিটি মানুষের জীবনকে সর্বাঙ্গীণ পূর্ণতা দেওয়াই ছিল রাষ্ট্রের অঙ্গীকার। কিন্তু সাড়ে চার দশক পেরিয়ে আজ গুটিকয়েক দেশ ছাড়া তামাম বিশ্বজুড়েই রোগ নিরাময়ের নামে কর্পোরেট হাসপাতাল, বহুজাতিক ওষুধ ব্যবসায়ী, ঝাঁ-চকচকে ল্যাবরেটরি আর বিমা কোম্পানিগুলি দেদার মুনাফা লুটছে। স্বাস্থ্যের সংজ্ঞাটাই বদলে দিতে চাইছে নয়া উদারবাদ। রোগ প্রতিরোধ আজ আর আলোচনার কেন্দ্রে নেই,  চিকিৎসাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত যাবতীয় ডিসকোর্স। আপাতত সমস্ত মানুষকে চিকিৎসার আওতায় আনাটাই ধনতন্ত্রের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। 
ধনতান্ত্রিক দেশগুলির মধ্যে যুক্তরাজ্যে সর্বপ্রথম জনগণের করের টাকায় সর্বজনীন স্বাস্থ্য পরিষেবা চালু হয় ১৯৪৬ সালে, যেখানে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সমস্ত নাগরিককে বিনামূল্যে উন্নত গুণমানের স্বাস্থ্য পরিষেবার আওতায় আনা হয়। একে একে আরও অনেক দেশে কমবেশি এই ব্যবস্থা লাগু হয়। তবে উদার অর্থনীতির কালে স্বাস্থ্য পরিষেবার চৌহদ্দিতে সর্বজনের অন্তর্ভুক্তির প্রশ্নটির মীমাংসা বিভিন্ন দেশ বিভিন্নভাবে করছে। কিউবা, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, নরওয়ে, ডেনমার্ক, স্পেন, হঙকঙ, সৌদি আরব, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি দেশে জনগণের করের টাকায় চালিত রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিখরচায় সবার জন্য স্বাস্থ্য সুনিশ্চিত করে চলেছে আজও। বাকি দেশগুলিতে যেখানে রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যব্যবস্থা ততটা শক্তিশালী নয়, সেখানে জনগণের করের টাকায় সামাজিক বিমার ব্যবস্থা করেছে সরকার। এর মধ্যে কানাডা, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশে এই সামাজিক বিমার মাধ্যমে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেয় বিভিন্ন অলাভজনক সংস্থা। আবার জার্মানি, ফ্রান্স, নেদারল্যান্ড, জাপানের মতো কিছু দেশে সামাজিক বিমা সর্বজনীন নয়, বরং ঐচ্ছিক। সেখানে একাধিক বেসরকারি বিমাও সমান্তরালভাবে চলে।

রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে ও ব্যবস্থাপনায় নিখরচায় স্বাস্থ্যসেবা, নাকি ব্যক্তিগত খরচে বেসরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা— এটি মতাদর্শগত রাজনৈতিক প্রশ্ন।
বিমা সামাজিক না ব্যক্তিগত, তাও একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সামাজিক বিমা একধরনের সমবায় পদ্ধতি - সাধ্য অনুযায়ী কর সংগ্রহ, প্রয়োজনমাফিক খরচ। কল্যাণকামী রাষ্ট্রগুলিতে যেখানেই সামাজিক বিমার মাধ্যমে অলাভজনক বেসরকারি সংস্থাচালিত স্বাস্থ্যব্যবস্থা চালু রয়েছে, তা সেদেশে হয় বামপন্থী, সোশালিস্ট বা লেবার পার্টি সরকারে এসে চালু করেছে, নয় বামপন্থীদের উত্থান রুখতে, তাদের চাপে দক্ষিণপন্থী কনজার্ভেটিভ পার্টির সরকার চালু করতে বাধ্য হয়েছে। ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলির প্রত্যেকটাতেই তাই হয়েছে। সামাজিক বিমাকরণের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে সংগৃহীত অর্থের পুনর্বণ্টন মতাদর্শগত কারণেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের না-পসন্দ। রাষ্ট্র বিনামূল্যে তার নাগরিকের স্বাস্থ্যের দায়িত্ব নেবে এই সমাজতান্ত্রিক ভাবনার বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে সাম্রাজ্যবাদের ভাবনা হলো ব্যক্তিগত বিমা-নির্ভর, মুনাফা-ভিত্তিক বেসরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা। ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামোয় দাঁড়িয়ে সামাজিক বিমার মাধ্যমে হয় রাষ্ট্রীয়, নয় অলাভজনক বেসরকারি সংস্থাচালিত ব্যবস্থার মাধ্যমে সকলের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হলো মধ্যবর্তী বাম বিকল্প।
কিন্তু বিমা সামাজিক হোক বা ব্যক্তিগত, বহু রাষ্ট্রকে তার পরিষেবা প্রদানকারীর ভূমিকা থেকে বের করে এনে ফাইন্যান্সারের ভূমিকায় অবতীর্ণ করিয়েছে উদার অর্থনীতি। মুনাফা-ভিত্তিক বেসরকারি  চিকিৎসাব্যবস্থা কি সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিকল্প হয়ে উঠতে পারে? রোগ-প্রতিরোধ কোনও বেসরকারি সংস্থাই চায় না, কারণ রোগী যাদের খদ্দের, রোগ না হলে তাদের ব্যবসাটাই লাটে উঠবে। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা না থাকলে বা দুর্বল হলে রোগ প্রতিরোধ দুরূহ হয়, রোগবালাই বাড়তেই থাকে এবং সামান্য কারণে মানুষ বিমার ভরসায় বড় বড় বেসরকারি হাসপাতালে ঘনঘন দৌড়ায়। ফলে বিমার অপচয় বাড়ে, প্রিমিয়াম বাড়ে, জনগণের উপর করের বোঝা বাড়ে। লাভ হয় একমাত্র বেসরকারি হাসপাতাল ও বিমা কোম্পানিগুলির। বিমার অপচয় আটকাতে অনেক দেশে চিকিৎসার মোট খরচের একটা অংশ রোগীকে বহন করতে হয়। কিন্তু  জনগণের দরিদ্রতম অংশ সেটুকুও বহন করতে পারে না বলে চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হয়। ফলে অর্থনৈতিকভাবে টেকসই উপায়ে, কম খরচে, উন্নত মানের সর্বজনীন চিকিৎসা পরিষেবা নিশ্চিত করবার সেরা উপায় হলো সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে ও ব্যয়ে মজবুত পরিকাঠামো ও নিবেদিত পেশাদার দ্বারা পরিষেবা প্রদান। সেখানে কিছু অত্যাধুনিক, ব্যয়বহুল চিকিৎসার পরিকাঠামোয় খামতি থাকলে তা মেটাতে সামাজিক বিমার মাধ্যমে অলাভজনক সংস্থাকে সেই চিকিৎসার ভার দেওয়া যেতে পারে, যা অনেক দেশই করে থাকে। বেসরকারি হাসপাতাল ও বিমা থাকতে পারে বড়জোর যারা আর্থিকভাবে সক্ষম ও ইচ্ছুক, তাদের জন্য। অবশ্য তারাও যদি সরকারী ব্যবস্থায় উন্নত মানের পরিষেবা পায়, তাহলে কেই বা ইচ্ছুক হবে! ফলে বেসরকারি ক্ষেত্রের দাপট কমতে বাধ্য। শুধুমাত্র যুক্তরাজ্যে বা স্পেনেই নয়, আমাদের দেশেও জনস্বাস্থ্য খাতে যেসব রাজ্যের বরাদ্দ বেশি, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা যেখানে মজবুত, সেইসব রাজ্যেও তাই দেখা যায়। কেরালা ও তামিলনাড়ুতে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা বেশ শক্তিশালী, মানুষ সেখানে অধিকাংশ রোগের চিকিৎসা হয় বিনামূল্যে, নয় নামমাত্র মূল্যে পায়। ফলে বেসরকারি হাসপাতালগুলিকে উচ্চ গুণমানের পরিষেবা নিশ্চিত করেই টিকে থাকতে হয় ঐ রাজ্যগুলিতে। অন্য রাজ্য, এমনকি অন্য দেশ‌ থেকেও রোগীরা ঐ হাসপাতালগুলিতে চিকিৎসা করাতে যান। ওডিশা, গোয়ার মতো রাজ্যে জনস্বাস্থ্যে বরাদ্দ অন্য রাজ্যের তুলনায় বেশি, সেখানে কোভিড থেকে সেরে ওঠার হারও অন্য রাজ্যের থেকে উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি ছিল। সম্প্রতি মানুষের স্বাস্থ্যের অধিকারকে আইনি স্বীকৃতি দিয়েছে রাজস্থান সরকার, যা স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি, সরকারি ব্যবস্থার মজবুতীকরণ ও বেসরকারি ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণের প্রথম ধাপ।

স্বাস্থ্য সূচকে বিপুল বৈষম্য 
বর্তমান বিশ্বে শুধুমাত্র গ্লোবাল নর্থ আর গ্লোবাল সাউথের মধ্যেই স্বাস্থ্যসূচকে আকাশ-পাতাল ফারাক রয়েছে তাই নয়, অধিকাংশ‌ দেশের অভ্যন্তরেও সমাজের বিভিন্ন অংশের মধ্যে বিরাট অসাম্য রয়েছে এবং তা ক্রমশ চওড়া হচ্ছে। নিম্ন বা মধ্য আয়ের দেশে তো বটেই, এমনকি ধনী দেশেও জনগণের দুর্বলতর অংশ স্বাস্থ্যব্যবস্থার দোরগোড়া অবধি পৌঁছাতেই পারছে না। পৌঁছালেও চিকিৎসাখাতে তাদের পকেট থেকে খরচের দরুন দারিদ্রের আবর্তে তারা ঘুরপাক খাচ্ছে। মূলত এই দুই সমস্যা থেকে মুক্তির জন্যই সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার কথা বলে আসছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। কিন্তু যেসব ধনতান্ত্রিক দেশ তা নিশ্চিত করেছে বহুবছর আগেই, সেখানেও এই অসাম্য প্রকট। 
ভারতের স্বাস্থ্যচিত্রেও এই বৈষম্য লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। দেশে সোভিয়েত রাশিয়ার আদলে ভোর কমিটির সুপারিশে সম্পূর্ণ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল স্বাধীনতার পর। বেসরকারি ক্ষেত্র ছিল নিতান্ত দুর্বল। উদার অর্থনীতির হাত ধরে কর্পোরেট জগৎ স্বাস্থ্যক্ষেত্রে পা রাখল নয়ের দশকে। ২০১৭ সালে তৃতীয় জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে সামাজিক বিমার মাধ্যমে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার পক্ষে সওয়াল করা হয়। পরের বছরেই আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পে প্রধানমন্ত্রী জন আরোগ্য যোজনা নামে সামাজিক বিমা চালু হয়। কিন্তু সেই সামাজিক বিমায় পরিষেবা প্রদানের ভার দেওয়া হলো মুনাফা-ভিত্তিতে চলা বেসরকারি ক্ষেত্রকে। তার পাঁচ বছর পরে, অমৃতকালে, এদেশে স্বাস্থ্যে বৈষম্যের ছবিটা বেশ চমকপ্রদ। সর্বশেষ সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, আধুনিক, নিজস্ব শৌচাগার রয়েছে সাধারণ জাতিভুক্ত ৬৫.৭ শতাংশ পরিবারে, কিন্তু তফসিলি উপজাতিদের মধ্যে মাত্র ২৫.৯ শতাংশ পরিবারে তা রয়েছে। সাধারণ জাতিভুক্ত পরিবারের চেয়ে তফসিলি জাতিভুক্ত পরিবারে ১২.৬ শতাংশ বেশি শিশু বামনত্বে ভুগছে। আর্থ-সামাজিক পিরামিডের চূড়ায় থাকা ২০ শতাংশ পরিবারের তুলনায় একেবারে নিচের ২০ শতাংশ পরিবারে তিনগুণ বেশি শিশু তাদের পঞ্চম জন্মবার্ষিকীর আগেই মারা যায়। গত কয়েক দশকে দেশে গড় আয়ু বাড়লেও ধনীদের তুলনায় গরিবরা গড়ে সাড়ে সাত বছর কম বাঁচে। দলিত মহিলারা সাধারণ জাতিভুক্ত মহিলাদের তুলনায় গড়ে ১৫ বছর কম বাঁচে। আদিবাসীদের মধ্যে শিশুমৃত্যুর হার হাজারে ৪৪.৪, যা সাধারণ জাতিভুক্তদের তুলনায় ৪০ শতাংশ বেশি ও জাতীয় গড়ের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি।
অক্সফ্যাম ইন্ডিয়ার গতবছরের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে ভারতে সাধারণ জাতিভুক্তদের চেয়ে তফসিলি জাতি ও উপজাতিভুক্তদের, হিন্দুদের চেয়ে‌ মুসলিমদের, ধনীদের চেয়ে গরিবদের, পুরুষদের চেয়ে মহিলাদের, শহরের বাসিন্দাদের চেয়ে গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্যসূচকগুলি দুর্বলতর। সারাদেশে মুসলিম পরিবারগুলি হিন্দু পরিবারের চেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব ও আইসিডিএস প্রকল্পে পুষ্টি প্রাপ্তির নিরিখে ১০ শতাংশ এবং শিশুদের টিকাকরণের নিরিখে ৮ শতাংশ পিছিয়ে রয়েছে। দেশের গ্রামাঞ্চলে প্রায় ৭০ শতাংশ মানুষের বাস হলেও দেশে মোট হাসপাতাল শয্যার মাত্র ৪০ শতাংশ রয়েছে গ্রাম ও মফঃস্বল মিলিয়ে। যদিও দ্বিতীয় তরঙ্গে দেশে মোট পরীক্ষিত কোভিড রোগীর অর্ধেক ছিল গ্রামাঞ্চলে। উত্তর প্রদেশ‌ ও রাজস্থানে ৭৫ শতাংশ কোভিড রোগীই ছিল গ্রামের বাসিন্দা। ২০১০ সালে দেশে দশহাজার জনপিছু হাসপাতাল শয্যা ছিল ৯টি, ২০২০ সালে তা কমে হয়েছে মাত্র ৫টি। যেখানে বাংলাদেশ, কেনিয়া ও চিলিতে তা এখন যথাক্রমে ৮.৭, ১৪ ও ২১টি। শয্যার হিসাবে ১৬৭টি দেশের মধ্যে ভারতের স্থান এখন ১৫৫তম।

বিমার গাজর নয়, চাই রাষ্ট্রকে 
এই ক্রমবর্ধমান স্বাস্থ্য-বৈষম্য সত্ত্বেও সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার নামে সামাজিক বিমার গাজর ঝুলিয়ে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট বরাদ্দ ক্রমশ কমিয়ে আনছে কেন্দ্রীয় সরকার। ২০২১-২২ সালে তার আগের বছরের তুলনায় ৯.৮ শতাংশ  বাজেট বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার, তারপরেও তা ছিল মোট বাজেটের ৩.৫ শতাংশ ও জিডিপি’র ০.৬ শতাংশ। এবছর সেটা কমে দাঁড়িয়েছে মোট বাজেটের মাত্র ২.০৬ শতাংশে ও জিডিপি’র মাত্র ০.৩৫ শতাংশে। শুধু তাই নয়, শিক্ষা, একশো দিনের কাজের প্রকল্প ইত্যাদির মতো স্বাস্থ্যের অন্যতম নিয়ামক ক্ষেত্রগুলিতেও কমানো হলো বরাদ্দ। অথচ এই সরকারই জিডিপি’র ২.৫ শতাংশ স্বাস্থ্যখাতে খরচের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল জাতীয় স্বাস্থ্যনীতিতে!
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তাদের ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে এবছর ‘সবার জন্য স্বাস্থ্যে’র অর্থনীতি বিষয়ক যে ইশ্‌তেহার প্রকাশ করেছে, তার মোদ্দা কথাই হলো রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যক্ষেত্রকে নেতৃত্বদানকারী ভূমিকা নিতে হবে। বলা হয়েছে, ‘সমস্ত অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের চরম লক্ষ্য হতে হবে সুস্বাস্থ্যের অধিকারী মানবজাতি গড়ে তোলা। স্বাস্থ্যখাতে অর্থবরাদ্দকে খরচের ন্যারেটিভ থেকে বের করে স্বাস্থ্যসম্মত সমাজ গঠনের লক্ষ্যে বিনিয়োগের ন্যারেটিভে বদলে ফেলতে হবে ... এবং তা কাজে করে দেখানোর সময় এখনই।’
এদেশে মুখে ‘সবার জন্য স্বাস্থ্য’ স্লোগান আওড়ে, কার্যক্ষেত্রে জনগণের করের টাকা বিমা-নির্ভর, মুনাফা-ভিত্তিক স্বাস্থ্যকারবারীদের হাতে অগ্রিম তুলে দিচ্ছে সরকার। বেসরকারি ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণের ন্যূনতম সদিচ্ছা নেই, পরিষেবার গুণমান নিশ্চিত করার কোনও পদ্ধতি নেই, ওষুধের মূল্যবৃদ্ধির হার লাগামছাড়া। রাষ্ট্রীয় স্বাস্থ্যক্ষেত্র ক্রমশ সঙ্কুচিত হচ্ছে, দ্রুত সেই শূন্যস্থানে বেসরকারি, কর্পোরেট মালিকানার জাল প্রসারিত হচ্ছে। রাষ্ট্র শুধুমাত্র সামাজিক বিমার প্রিমিয়ামটুকু দিয়ে তার দায় ঝেড়ে ফেলতে চাইছে। এই জনবিরোধী, কর্পোরেট-বান্ধব নীতি বদলাতে গেলে যে রাজনৈতিক লড়াই লড়তে হবে, সেটাই আজকের দিনের স্বাস্থ্য আন্দোলনের অভিমুখ। স্বাস্থ্য একটি আপাদমস্তক রাজনৈতিক বিষয়, তাই স্বাস্থ্য আন্দোলন শ্রেণি-দৃষ্টিভঙ্গিরহিত, রাজনীতি-বিবর্জিত হতে পারে না।

পশ্চিমবঙ্গের মানুষের স্বাস্থ্য এক সাঁড়াশি আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে। একদিকে কেন্দ্র স্বাস্থ্যখাতে এবং স্বাস্থ্যের নির্ধারক ক্ষেত্রগুলিতে বরাদ্দ ছাঁটাই করছে, অন্যদিকে এরাজ্যে সেই হ্রাসপ্রাপ্ত বরাদ্দের অর্থ নয়ছয় চলছে। এমনকি বিপর্যয় মোকাবিলার সামগ্রীও আত্মসাৎ করছে শাসক। এরাজ্যেও সামাজিক বিমার নামে প্রতিবছর কয়েক হাজার কোটি টাকা বেসরকারি হাঙরদের পেটে ঢালছে সরকার। সঙ্কুচিত করছে মানুষের কাজের অধিকার, গণতান্ত্রিক পরিসর, সামাজিক স্থিতি, মূল্যবোধের সংস্কৃতি - যেগুলি মানুষের শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক স্বাস্থ্যের নির্ধারক। এরাজ্যের শ্রমজীবী মানুষের, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের, মহিলা ও লিঙ্গগত সংখ্যালঘুদের, তফসিলী জাতি ও উপজাতিভুক্ত মানুষের লড়াইটা তাই আরও কঠিন, তাদের লড়াই এই দুইয়ের বিরুদ্ধেই। সবার জন্য স্বাস্থ্য নিশ্চিত করার একমাত্র পথ শ্রেণির লড়াই তীব্রতর করা, নয়া উদারবাদের বিরুদ্ধে অবিরাম সংগ্রামে লিপ্ত থাকা, দুর্নীতি ও স্বৈরাচারের মূল উৎপাটনের লড়াইয়ে শামিল হওয়া। সুবিধাপ্রাপ্ত সম্প্রদায়ের শখের স্বাস্থ্য আন্দোলন নয়, জনগণের দুর্বলতর অংশগুলিকে সংগঠিত করেই স্বাস্থ্যের জন্য প্রকৃত সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

Comments :0

Login to leave a comment