সন্দেহ আরও ঘনীভূত হচ্ছে।
ওএমআর শিট অর্থাৎ উত্তরপত্র নষ্ট বা ধ্বংস করার আগে সত্যি কি কোনও ডিজিটাল প্রতিলিপি স্ক্যান কপি রাখেনি এসএসসি? নাকি তা রাখলেও পরবর্তীতে এসএসসি-কে নির্দেশ দিতে পারে এমন কোনও প্রভাবশালী ব্যক্তি বা মহলের চাপে তা সরিয়ে ফেলা হয়?
গুরুতর সন্দেহ দেখা দিচ্ছে। আইনজীবী মহলের দাবি, সন্দেহ যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে ভারতের বুকে কোনও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় এত সংগঠিত ভয়ানক চেহারার দুর্নীতি এর আগে দেখা যায়নি।
সন্দেহ তৈরি হয়েছে এসএসসি’র বক্তব্যে। ২০২৩ থেকে ২০২৫— গত তিন বছরে দেশের শীর্ষ আদালতে এসএসসি’র বক্তব্যেই সেই সন্দেহ আরও দৃঢ় হয়েছে। কমিশন কি ২২ লক্ষ পরীক্ষার্থীর ওএমআর শিট ধ্বংস করার আগে স্ক্যান কপি রেখে দিয়েছিল এবং পরবর্তীতে কোনও শীর্ষ প্রভাবশালী মহলের নির্দেশে তা সরিয়ে বা নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল? যোগ্য-অযোগ্য ভাগ করার শেষতম সম্ভাবনা ছিল যদি কমিশন আসল ওএমআর শিট অথবা তার ডিজিটাল প্রতিলিপি বা মিরর কপি যদি দেখানো যেত আদালতে। ২০২৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের শুনানিতে যদিও কমিশনের তরফে স্পষ্টতই স্বীকার করে নেওয়া হয় যে তাদের কাছে ওএমআর শিটের কোনও কপি নেই!
সত্যি কী তাই? কেন তা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হচ্ছে?
কারণ এর আগে এই এসসসি’র গ্রুপ-ডি’র মামলায় কমিশনের তরফে সুপ্রিম কোর্টে বলা হয়েছিল ২১ নম্বর রুল অনুযায়ী প্যানেল প্রকাশিত হওয়ার এক বছরের মধ্যে উত্তরপত্রের নষ্টের আগে তার মিরর ইমেজ অর্থাৎ ডিজিটাল প্রতিলিপি রাখা হয়েছিল। ২০২১-২২’ সালে ১৬’র এসএসসি’তে বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থী অচিন্ত্য কুমার মণ্ডল ও লক্ষ্মী টুঙ্গার করা মামলায় সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসুর এজলাসে শুনানির সময় খোদ কমিশন দাবি করেছিল তাদের কাছে ওএমআর শিটের মিরর কপি বা ডিজিটাল প্রতিলিপি রয়েছে। এসএসসি’র গ্রুপ-সি, গ্রুপ-ডি, নবম-দশম, একাদশ- দ্বাদশের নিয়োগ দুর্নীতির সেই মামলাতেই এমনকি এসএসসি’র কাছে থাকা ওএমআর শিট এবং নাইসার মতো অভিযুক্ত সংস্থার কাছে যে ওএমআর শিট ছিল তাতেও একই প্রার্থীর দু’রকম নম্বরের অভিযোগও সামনে আসে। অর্থাৎ এসএসসি’র কাছে যে ওএমআর শিট রয়েছে তাতে অকৃতকার্য হওয়া প্রার্থী, সরকারেরই নিযুক্ত করা নাইসা নামক সংস্থার কাছে রাখা ওমএমআর শিটে বেমালুম পাশ করে গিয়েছে!
কিন্তু প্রশ্ন হলো, কমিশন তিন-চার বছর আগে সুপ্রিম কোর্টে এসএসসি সংক্রান্ত অন্য মামলায় বিচারপতি অনিরুদ্ধ বসুর এজলাসে দাবি করেছিল যে নষ্ট করার আগে ওএমআর শিটের ডিজিটাল কপি তারা রেখে দিয়েছিল। সেই কমিশনই ২০২৪-২৫‘সালে এসে আসল বা ডিজিটাল প্রতিলিপি কোনও কিছুই তাদের কাছে নেই বলে সুপ্রিম কোর্টে দাবি করল কেন? যে দাবির জন্যই টাকার বিনিময়ে, খালি খাতা দিয়ে চাকরি পাওয়া অযোগ্যদের ভিড়ে যোগ্যরাও চাকরিহারা হলেন?
তাহলে কি পরিকল্পিতভাবেই যোগ্য প্রার্থীদের অযোগ্যদের ভিড়ে রেখে দিয়ে প্যানেল বাতিলের সম্ভাবনাকে তৈরি করেছিল কমিশন-পর্ষদ-সরকার মিলে? ডিজিটাল কপি সংগ্রহে রাখলেও কোনও প্রভাবশালী মহলের নির্দেশে তাহলে তা উধাও হয়ে গেল? তাহলে কি কমিশনের ওপর কোনও ধরনের চাপ ছিল সরকারের প্রভাবশালী মহল থেকে? যদি থাকে তাহলে গোটা দুর্নীতির সরকারিকরণ হয়েছে বলেই স্পষ্ট হবে, মত আইনজীবীদের।
এসএসসি মামলায় বঞ্চিত চাকরিপ্রার্থীদের অন্যতম আইনজীবী ফিরদৌস শামিমের কথায়, ‘‘এটা মারাত্মক অভিযোগ। তাহলে সরকারের নির্দেশেই এসএসসি বিভ্রান্তিকর উত্তর দিয়েছে সুপ্রিম কোর্টে? তাহলে কি ওমএমআর শিটের মিরর কপি কোথাও লুকিয়ে রাখা হয়েছে? কার নির্দেশে? এরাজ্যে তো একজনের নির্দেশ ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না। তাহলে কি রাজ্য সরকারই চেয়েছিল অযোগ্যদের সঙ্গে যোগ্যদের চাকরিও চলে যাক? রাজনৈতিক কোন অভিসন্ধি হতে পারে এটা। যদি হয় তাহলে তা ভয়াবহ।’’
শুধু তাই নয়, কমিশনের তরফে সুপ্রিম কোর্টে জানানো হয়েছিল এসএসসি’র ২১ নম্বর ধারা অনুযায়ী ওমএমআর শিট নষ্ট করা হয়েছে। কারণ ওই ধারায় বলা হয়েছে নিয়োগের প্যানেল প্রকাশিত হওয়ার এক বছরের মধ্যে লিখিত উত্তরপত্র অর্থাৎ ওএমআর শিট নষ্ট করে দিতে হবে। এসএসসি ২০১৯ সালের ২২জুলাই এক্সিটিউভ ডিসিশন নিয়ে এই ধারা সংশোধন করে। আগে ছিল প্যানেল প্রকাশিত তিন বছর পর্যন্ত উত্তরপত্র রেখে দিতে হবে। তৃণমূল সরকার ২০১৯ সালে সেটা কমিয়ে ১ বছরের মেয়াদ করে দেয়। তাও কি পরিকল্পিতভাবেই? দুর্নীতির মামলা আগে থেকে সাজানোর জন্য!
অবশ্য কমিশনের এই যুক্ত খারিজ করে দিয়ে প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্না ও বিচারপতি সঞ্জয় কুমার তাদের রায়ের ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে জানিয়েছে যে, এসএসসি’র নিজেদের পরিবর্তন করা এই রুল গ্রুপ-সি, গ্রুপ-ডি’র ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। অর্থাৎ প্যানেল প্রকাশিত হওয়ার এক বছরের মধ্যে ওএমআর শিট নষ্ট করার যুক্তি তাঁদের নিজেদের আইনেই গ্রুপ-সি, গ্রুপ-ডি’র ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, ‘নিজেদের রুলই মানেনি এসএসসি।’ কেন তাহলে গ্রুপ-সি, গ্রুপ-ডি’র পরীক্ষার উত্তরপত্র নষ্ট করা হয়েছিল? উত্তর নেই কমিশনের কাছে। তাহলে কি আদৌ নষ্ট করেনি কমিশন? সরকারি কোন মহলের চাপে পরবর্তীতে তা সরিয়ে ফেলতে হয়েছে? আর যদি নষ্ট করাই হয়ে থাকে তাহলে নিজেদের নিয়ম ভেঙে শিক্ষাকর্মীদের চাকরি পরীক্ষার উত্তরপত্র কেন ধ্বংস করা হলো?
আবার এই কমিশনের চেয়ারম্যানই কলকাতা হাইকোর্টের রায়ের পরে গত বছরের ৩ মে সাংবাদিক বৈঠক করে জানান, ‘যোগ্য-অযোগ্য ভাগ সম্ভব। যাঁরা যোগ্য, যাঁদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগ নেই, সেই তালিকাও আমরা আদালতে জমা দেব।’ কীসের ভিত্তিতে বলেছিলেন? ওএমআর শিটের মিরর কপি ছাড়া কীভাবে তা প্রমাণ করা সম্ভব হতো? ২০২৪ সালের ৩ মে এমন দাবি করার পরে ২৫’ সালে সুপ্রিম কোর্টে কেন সেই তালিকা জমা দেওয়া হলো না?
রহস্যের পর রহস্য। উত্তর কে জানে? কালীঘাটের কাকুর সাহেব না কি রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধান?
OMR Sheet
আইনজীবীদের অভিমত, প্রভাবশালীদের নির্দেশে নষ্ট করা হয়েছে ওএমআর শিট

×
Comments :0