School

লবণ সত্যাগ্রহের গ্রাম হারাচ্ছে স্কুল বেসরকারি স্কুলে ছাত্র বৃদ্ধির ‘দায়িত্বে’ তৃণমূলের নেতারা

বিশেষ বিভাগ ফিচার পাতা

রামশঙ্কর চক্রবর্তী
 

স্বাধীনতা আন্দোলনের আঁচ জড়িয়ে আছে গ্রামের নামে। বিস্মৃতির অতলে থাকা সেই গ্রামকে চেনা যায় একটি স্কুলের মাধ্যমে। বিস্তীর্ণ প্রান্তর আর রূপনারায়ণের পাড়ে একা একা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ছে সে। সাক্ষী হাতেগোনা তার কয়েকজন ছাত্র আর শিক্ষক। হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে মরণাপন্ন রোগী মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাওয়ার সময় যেমন সাক্ষী থাকে সেই হাসপাতাল আর সে নিজে। তেমনি আস্তে আস্তে হারিয়ে যাওয়ার পথে একটি স্কুল নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন আর দেখেনা। শুধু এক বুক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেঁচে থাকা তার।
১৯৪২ সালের ভারতছাড়ো আন্দোলনে শহীদ হয়েছিলেন মাতঙ্গিনী হাজরা। তাঁর গ্রাম তমলুক থানার আলিনান। এই আলিনানের পাশেই রয়েছে নুন্নান গ্রাম। অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে বরাবরই সামনের সারিতে ছিল। তেমনি তমলুক গ্রামীণ এলাকার রূপনারায়ণের তীরবর্তী এই গ্রামগুলিও স্বাধীনতা আন্দোলনে নিজেদের উৎসর্গ করেছিল। লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে সায়রা মৌজা জুড়ে নুন মারার কাজ করতেন এই এলাকার বাসিন্দারা। সেই কারণেই সায়রা মৌজার একটি অংশের নামকরণ নুন্নান হয়ে গিয়েছিল। 
১৯৪৪ সালে গ্রামে শিক্ষার প্রসার ঘটানোর তাগিদ নিয়ে হরিপদ কাঁঠাল ও প্রকাশ চন্দ্র সামন্ত নামে দুই ব্যক্তি জমি দান করেছিলেন একটি পাঠশালা গড়ে তোলার জন্য। স্বাধীন ভারতে সেই পাঠশালা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মর্যাদা পায়। নদীর তীরবর্তী এলাকা ও সাধারণ গরিব মানুষের বসবাসের এই গ্রামে বিদ্যালয়ে নতুন দিশা দেখিয়েছিল শিক্ষায়। বহু কৃতী নুন্নান প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে শিক্ষা লাভ করেছেন। ইতিহাসের পাতায় রয়েছে শ্যামপদ মালাকারের নাম। কারণ ইংরেজ আমলে অনেক বিপ্লবী তাঁর বাড়িতে আত্মগোপন করে থেকেছিলেন। এই গ্রামেই তাঁর বাড়ি। হলদিয়া মেচেদা রাজ্য সড়ক দিয়ে নুন্নান গ্রামে পৌঁছাতে গেলে কাঁকটিয়া থেকে আলিনান গ্রামের উপর দিয়েই আসতে হয়। অন্যদিকে তমলুক শহর থেকে উত্তরে রূপনারায়ণ নদী পার বরাবর এই নুন্নান গ্রামে পৌঁছানো যায়। তবে গ্রামের এখন একমাত্র উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠান প্রাথমিক বিদ্যালয়। কিন্তু সেই বিদ্যালয় সরকারি নোটিসে বন্ধ হওয়ার মুখে। 
খাতায় কলমে ২২ জন ছাত্র-ছাত্রী রয়েছে। শিক্ষক রয়েছেন দুজন। এমন অবস্থা বিগত সাত আট বছর ধরে। জানাচ্ছেন গ্রামের বাসিন্দা গোবিন্দ অধিকারী। তাঁর কথায় "এই গ্রামের একজন বাসিন্দা হিসাবে আমাদের অত্যন্ত কষ্টের যে এই বিদ্যালয় প্রায় বন্ধ হওয়ার জায়গায় পৌঁছেছে। তার কারণ ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা হাতে গোনা।" এর কারণ হিসেবে সুকুমার সামন্ত নামে আরেক গ্রামবাসী বলেন "এলাকায় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলি বহুল প্রচারিত হয়ে উঠেছে। ফলে অভিভাবকরা তাদের বাচ্চাদের বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করাটাই উপযুক্ত মনে করছেন।"
এই গ্রামকে চেনা যায় এই বিদ্যালয় দিয়েই কারণ যোগাযোগ ব্যবস্থা ততটা উন্নত নয় ফলে প্রত্যেকেরই চিহ্নিতকরণের জায়গা থাকে এই প্রাথমিক বিদ্যালয়। গ্রামের দুটি বুথে ৩২০০ মানুষের বসবাস। অথচ ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা মাত্র ২২। একজন অভিভাবক বলেন "আসলে সরকারি স্কুলে পঠন-পাঠনের মান একেবারেই নিম্নমানের। তার উপর রাজ্যে যেভাবে শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতি সামনে আসছে তাতে বাচ্চাদের ভবিষ্যৎ নিয়েই চিন্তা হয়। তাই সরকারি স্কুলে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা কি শিখবে বলুন তো? সবই তো ভুয়া মাস্টার।" আরেকজন অভিভাবক বলেন "সরকারি প্রতিষ্ঠান হওয়ার জন্য বিদ্যালয়ের পরিকাঠামেরও কোনও উন্নতি হয়নি। গতানুগতিকভাবে বাচ্চারা স্কুলে আসে আবার চলে যায়। সিলেবাসেরও কোনও ঠিক নেই। কি শিখবে আমাদের ছেলে মেয়েরা। তার থেকে বেসরকারি স্কুলগুলি পেশাদারিভাবে শিক্ষাদান করে।"
বিদ্যালয়ের সামনে গিয়ে বোঝা গেল। বিগত ১০/১২ বছরে বিদ্যালয় ভবনের কোনও কাজই হয়নি। বিদ্যালয়টিকে সরকারিভাবেই যেন অবহেলা করা হয়েছে। তার প্রত্যক্ষ নিদর্শন রয়েছে।
এবার আসা যাক কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের বিষয় এই গ্রাম থেকে ৪৫ কিমির মধ্যেই পাঁচ থেকে ছটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যেগুলি কোনটা এনজিও অথবা ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই গ্রামের একজন বাসিন্দা বলেন "স্থানীয় নেতাদেরকে ধরে বেসরকারি স্কুলগুলি গ্রামে ব্যাপক প্রচার চালায়। এমনকি এজেন্টও রয়েছে তাদের। সাধারণ মানুষের কাছে এই প্রচার চলে যে সরকারি স্কুলে ছেলে-মেয়েদের পাঠিয়ে লাভ নেই।" এমনকি জেলার হেঁড়িয়াসহ কিছু জায়গায় বেসরকারি স্কুল খুলেছে স্থানীয় তৃণমূল নেতার মদতে।
অন্যদিকে নন্দকুমার ব্লকের কালীদহী গ্রামের একমাত্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বলতে কালীদহী প্রাথমিক বিদ্যালয়। সেটিও প্রায় বন্ধের পর্যায়ে। মাত্র ১২ জন ছাত্র-ছাত্রী। শিক্ষিকা রয়েছেন একজন। ১৯৯৮ সালে গ্রামের এক ব্যক্তি শশীভূষণ মাইতি শিক্ষা প্রসারের জন্য নিজের জায়গা দান করে একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার প্রয়াস করেন। তৎকালীন সময়ের গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্যসহ গ্রামের অন্যান্য ব্যক্তিরা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। গড়ে ওঠে প্রাথমিক বিদ্যালয়। গ্রামের ছাত্র-ছাত্রীরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাঠ গ্রহণ করে উচ্চশিক্ষায় পাশের গ্রামে যায়। এমনই ছিল। কালের নিয়মে সে সবকিছু যেন হারিয়ে গেছে। বিগত বছর ছয়েক ধরে বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রী কমতে কমতে এখন ১২ জনে এসে পৌঁছেছে। বিদ্যালয়ের একমাত্র শিক্ষিকা উষারানি পাত্র বলেন এলাকার গ্রাম পঞ্চায়েত, গ্রাম কমিটি, অভিভাবকদের নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে কিন্তু কোনও লাভ হয়নি।" গ্রামবাসীদের কথায় "সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার উপর অভিভাবকরা ভরসা করতে পারছে না। তাই বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের উপরেই ভরসা করছে তারা।" এলাকার পঞ্চায়েত ননীগোপাল দাস বলেন "আমি আমার মতো চেষ্টা করেছি। অভিভাবকের উপর তো জোর করতে পারি না।"
এই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুই কিলোমিটারের মধ্যে একটি নামকরা বেসরকারি আধ্যাত্মিক সংস্থার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তারা নিয়মিত এই গ্রাম সহ পাশাপাশি কয়েকটি গ্রামে বাড়ি বাড়ি প্রচার করে তাদের প্রতিষ্ঠানে বাড়ির ছেলেমেয়েদের ভর্তি করানোর জন্য। এমনকি অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি থাকে। গ্রামের মানুষজন সেই প্রলোভনে কম খরচে ভালো শিক্ষার প্রতিশ্রুতিতে নিজেদের বাড়ির ছেলে মেয়েদের সরকারি স্কুলে না পাঠানোটাই উপযুক্ত মনে করেছেন, এমনই মত গ্রামের বাসিন্দাদের।
পূর্ব মেদিনীপুর জেলার প্রবেশ পথ শহীদ মাতঙ্গিনী এবং মাঝে অবস্থিত নন্দকুমার ব্লক। এই দুটি ব্লকের দুটি স্কুলের উদাহরণ দেওয়ার কারণ এই দুটি ব্লক থেকে চার থেকে পাঁচ কিলোমিটারের মধ্যে বিগত আট থেকে দশ বছরে মধ্যে নামকরা বেশ কয়েকটি বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যার কয়েকটি তমলুক শহরেই অবস্থিত। এছাড়া মহিষাদল এবং মেচেদাতেও বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির বাড়বাড়ন্ত। পাশাপাশি শিক্ষক নিয়োগের দুর্নীতিতে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার একাধিক ব্লকের বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়গুলির শিক্ষক বাতিল হওয়াটা সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করেছে। যার ফলে সাধারণ মানুষ মনে করেছেন সরকারি শিক্ষা ব্যবস্থার হাল শোচনীয়, তাই নিজেদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ যাতে ধ্বংস না হয় তার জন্য বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উপযুক্ত।
স্কুল শিক্ষা দপ্তর রাজ্যে ৮২০০টি বিদ্যালয় বন্ধের সুপারিশ করেছে তার মধ্যে পূর্ব মেদিনীপুর জেলায় ৩৬৮ টি বিদ্যালয় রয়েছে।


 

Comments :0

Login to leave a comment