Recruitment scam money invested in tollywood

নিয়োগ দুর্নীতির টাকা ধৃত তৃণমূলীরা ঢেলেছে টলিউডে

রাজ্য

 চাকরিপ্রার্থী জোগাড় করা থেকে টাকা তোলা— নিয়োগ দুর্নীতির গোটা চক্রে আপাদমস্তক আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে শাসক তৃণমূল। মন্ত্রী থেকে এজেন্ট- গোটা নেটওয়ার্কে এখনও পর্যন্ত সিবিআই ও ইডি’র হাতে শিক্ষক নিয়োগকাণ্ডে যে কজন গ্রেপ্তার হয়েছে সকলেই শাসক তৃণমূলের সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত।
শুক্রবার শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতিতে একসঙ্গে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছিল সিবিআই। মূলত সকলেই এজেন্ট কিংবা সাব এজেন্ট হিসাবে টাকার বিনিময়ে সরকারি চাকরি পাইয়ে দেওয়া এই চক্রে যুক্ত ছিল।


ধৃতদের মধ্যে অন্যতম রঞ্জন ওরফে চন্দন মণ্ডল। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জির ঘনিষ্ঠ। পার্থ চ্যাটার্জির স্ত্রী প্রয়াণের পরে নিয়মভঙ্গের অনুষ্ঠানে সমস্ত মাছ পাঠিয়েছিলেন ধৃত চন্দন মণ্ডল। বাগদায় মামাভাগিনা গ্রামে তাঁর কালীপুজোতে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর ভাই কার্তিক হাজির থাকতেন। থাকতেন জেলার আরও এক দাপুটে মন্ত্রী।
ধৃতদের তালিকাতেই রয়েছে কৌশিক ঘোষ। নিয়োগকাণ্ডে চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে টাকা তোলার চক্রে সাব এজেন্টের কাজ করত। 
সেই কৌশিক ঘোষের ফেসবুক পোস্টেই দেখা যাচ্ছে মুর্শিদাবাদের বড়ঞার বিধায়ক জীবন কৃষ্ণ সাহার সঙ্গে বিধানসভার লবিতে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। শিক্ষক নিয়োগকাণ্ডে ধৃত সাব এজেন্ট কৌশিক ঘোষের বিধানসভাতেও ছিল যাতায়াত! এলাকায় দাপুটে তৃণমূল কংগ্রেস কর্মী বলেই পরিচিত কৌশিক। জেলার বাইরে বেসরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং সংস্থার চাকরি ছেড়ে নেমেছিলেন চাকরি বিক্রির পেশায়। স্কুলে চাকরি করেন কৌশিকের একাধিক আত্মীয়। দাপট, সম্পত্তি বৃদ্ধি শুরু ২০২১ সাল থেকেই। ২০২১ এর নির্বাচনে তৃণমূল প্রার্থী জীবন কৃষ্ণ সাহাকে জেতাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে কৌশিক। পৌঁছে গিয়েছিল বিধানসভার অন্দরেও। গ্রামবাসীদের দাবি, শুধু গ্রামে দোতলা বাড়িই নয়, বোলপুরেও ফ্ল্যাট আছে কৌশিকের।


যদিও এদিন তৃণমূলী বিধায়ক জীবন কৃষ্ণের সাফাই, ‘ওই ব্যক্তি আমার ঘনিষ্ঠ নয়। আমি যে বিধানসভার বিধায়ক তারও বাড়ি বড়ঞা। অনেকে এমএলএদের কাছে আসে। ছবি তোলে’। যদিও বিধানসভাতে যে কেউ আসতে পারেন না। প্রয়োজন হয় অনুমোদনের।
গ্রেপ্তারির খবরের পরেই তালা পড়েছে বড়ঞার ভড়ঞা গ্রামের কৌশিক ঘোষের পেল্লাই দোতলা বাড়িতে। গ্রামের বাসিন্দাদের অভিযোগ এলাকায় যতজনের সরকারি চাকরি হয়েছে সবার থেকে টাকা তুলেছে এই কৌশিক। তৃণমূলের দাপুটে নেতা, ফলে কেউ মুখ খুলতে পারেনি ভয়ে। বড় বড় নেতা, মন্ত্রীর সঙ্গেও তার যোগাযোগের কথা বলে বেড়াতো। এমনকি হাওড়া জেলা থেকেও চাকরিপ্রার্থীরা এসে তার বাড়িতে টাকা দিয়ে যেত। পরিবারের সবাই সরকারি চাকরি করে।
সিবিআই’র হাতে ধৃত ছয়জনের তালিকায় অন্যতম আরেক কীর্তিমান শাহিদ ইমাম। আরামবাগের দাপুটে তৃণমুল নেতা তথা হুগলী জেলা তৃণমূলের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক শাহিদ ইমাম।


রাজ্যে পালাবদলের পরেই রাতারাতি ওষুধের দোকান থেকে উত্থান হতে থাকে শাহিদের। হাওড়ার উদয়নারায়ণপুরের খলৎপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের চাকরি পান শাহিদ। ক্রমে কলকাতা ও মুম্বাই এ একাধিক বিলাসবহুল ফ্ল্যাট আছে। তিনটি বাংলা সিনেমার প্রযোজনা করেছে ও অভিনয় করেছে শাহিদ ইমাম। টলিউডের পাশাপাশি বলিউডে শাহিদের শুভম নামে আত্মপ্রকাশ হয়। মুম্বাইতে শুভম নামে তার বেশকয়েকটি মিউজিক ভিডিও এবং সিনেমাও বাজারে আসে। বর্ধমান শহরে ডাউনটাউন নামে ড্যান্সবার, আরামবাগে বিলাসবহুল বাড়ি। সিবিআই’র দাবি গ্রেপ্তারির পরে লাগাতার জেরায় শাহিদ ইমাম শাসক তৃণমূলের প্রভাবশালী মহল সম্পর্কে একাধিক তথ্য দিয়েছে। কয়লা, গোরুর পরে এবার শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির টাকাও বেমালুম খেটেছে টলিউডে, সেই তথ্যও সামনে এসেছে।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই’র দাবি, দুর্নীতির যেন মহাসমুদ্র। কুন্তল থেকে চন্দন মণ্ডল, শাহিদ ইমাম, কৌশিক ঘোষ— রাজ্যের প্রতিটি জেলা ধরে এমন চক্র কাজ করেছিল। প্রত্যেকের সঙ্গে শাসক দলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, মন্ত্রীদের সখ্য ছিল। তদন্তকারী আধিকারিকদের কথায়, কার্যত যেন ‘স্টেট স্পনসরড কোরাপশন’।


এর আগে নিয়োগকাণ্ডে ধৃত যুব তৃণমূলের অন্যতম রাজ্য সম্পাদক কুন্তল ঘোষকে গ্রেপ্তারের পরে ইডি’র তরফে আদালতে দাবি করা হয়েছিল - সরকারি চাকরি বেচার টাকা একাধিক ভুয়ো, শিখণ্ডী সংস্থাতেও ঢুকেছে। শুধু একাধিক অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে টাকা পাচারই নয়, নিয়োগ দুর্নীতির টাকায় টলিউডেও খাটানো হয়েছিল। একটা মিউজিক কোম্পানিও পার্টনারশিপে খুলেছিল এই যুব তৃণমূল নেতা। সেখানেও ঢোকে নিয়োগের টাকা। সেই সূত্রেই আসে শাহিদ ইমামের প্রসঙ্গ। ধৃত কুন্তল ঘোষ, নিয়োগ দুর্নীতিতেই জেরার মুখে পড়া হুগলী জেলা পরিষদের তৃণমূলী কর্মাধ্যক্ষ শান্তনু ব্যানার্জিরও ঘনিষ্ঠ শাহিদ ইমাম। জেলা তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদকও হয়েছিলেন এক সময়। তারপরেই হাত পাকানো শুরু অযোগ্যদের চাকরি পাইয়ে দেওয়ার নাম করে টাকা তোলা। সেখান থেকেই যোগ কুন্তলের সঙ্গে। ততক্ষণে কোটি কোটি টাকা বাজার থেকে তোলা হয়ে গেছে। নামে সিনেমাতেও। বিপুল সম্পত্তির মালিক বনে যায়। যোগ ছিল মানিক ভট্টাচার্য, পার্থ চ্যাটার্জির সঙ্গেও। একাধিক দামি গাড়ি আছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের কথায়, অডি, মার্সিডিজের বিলাসবহুল গাড়িতেও তাঁকে চড়ে বেড়াতে দেখা যেত। মুম্বাইতেও ফ্ল্যাটের মালিক। তৃণমূলের এক শীর্ষ প্রভাবশালী সাংসদের অনুগামী বলেই পরিচিত ছিল দলের অন্দরে।


ইতিমধ্যেই এদিন আদালতের তোলার সময় শাহিদ ইমাম ইঙ্গিত দিয়েছে, সব কিছু জানাতে চায়! আলিপুর আদালতে ঢোকার সময় সাংবাদিকদের সামনেই এই প্রতারক বলে ‘কোর্টকে সব বলব, যা সত্যি তাই বলব, সাক্ষ্য দেব'! সিবিআই সূত্রে জানা গেছে, কীভাবে টাকা তোলা হতো, কোথায় যেত, কীভাবে অবৈধ মেধা তালিকায় নাম ঢোকানো হতো তা অনেকটাই গোয়েন্দা আধিকারিককের কাছে জেরায় জানিয়েছে শাহিদ ইমাম। 
ধৃত দালাল, এজেন্টদের এমন উত্থানের গতি রীতিমতো চমকপ্রদ। সিবিআই’র তদন্তকারী আধিকারিকদের দাবি, সংগঠিতভাবেই ২০১২ সাল থেকে প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক, নবম-দশম, একাদশ-দ্বাদশে শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী নিয়োগের এই অপারেশন চলেছে। একবারে শীর্ষ মহল থেকে তা নিয়ন্ত্রণ করা হতো। এজেন্টদের দায়িত্ব ছিল ব্লক ভিত্তিক চাকরিপ্রার্থীদের নাম সহ তথ্য জোগাড় করা, টাকা সংগ্রহ করা। তারপর মেধা তালিকায় নাম ঢোকানোর জন্য খসড়া তালিকাও যেত জেলা থেকে। স্তরে স্তরে ভাগ ছিল, টাকা পৌছাতে স্তরে স্তরে। কর্পোরেট মডেলে চলত দুর্নীতি। শিক্ষা দপ্তর থেকে পুলিশ প্রশাসন, বিধায়ক-মন্ত্রী যোগ ছাড়া গত দশ বছর ধরে এই চক্র এত নিশ্চিতে এই কারবার চালিয়ে যেতে পারত না। 
যেমন ‘সৎ রঞ্জন’ ওরফে চন্দন মণ্ডল। টাকার বিনিময়ে গ্যারান্টি দিয়ে চাকরি পাইয়ে দিত। তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ, তাঁর নাকতলার একাধিকবার গেছেন এই চন্দন মণ্ডল। সিবিআই’র দাবি প্রাথমিকে শিক্ষকের চাকরির জন্য অন্তত ১২ -১৫ লক্ষ টাকা নিতেন চন্দন মণ্ডল। ২০-২৫ লক্ষ টাকা নিতেন উচ্চপ্রাথমিকে চাকরি দেওয়ার জন্য।  এবার চন্দন মণ্ডলের গ্রেপ্তারির পরে বাগদার প্রাক্তন বিধায়ক দুলাল বরের দাবি ২০১২ সাল থেকে বাগদার ৯৫ শতাংশ চাকরি চন্দনের মাধ্যমে টাকা দিয়ে হয়েছে, চন্দন মণ্ডলই টাকা নিত। সিবিআই’র দাবি সেই টাকাই গাড়ি ভর্তি করে পাঠানো হতো কলকাতায়।
তাৎপর্যের হলো আদালতেই এর আগে ইডি জানিয়েছিল পার্থ চ্যাটার্জি নয়, আর বড় প্রভাবশালী আছেন যিনি এই কুন্তলদের নিয়োগ চক্রে সাহায্য করত এবং তা বিপুল টাকার বিনিময়েই।
 

Comments :0

Login to leave a comment