ICDS

তিন মাস ধরে ডিম-সবজির টাকা বন্ধ আইসিডিএস কেন্দ্রে

রাজ্য

ICDS

তিন মাস ধরে এরাজ্যে অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রের শিশুদের ডিম ও সবজি খাতের বরাদ্দ টাকা বন্ধ করে রেখেছে রাজ্য সরকার!
সরকারের সীমাহীন উদাসীনতার মধ্যেও এতদিন নিজেদের ঘরের টাকায়, বাজার থেকে ধার করে শিশুদের মুখে ডিম ও সবজি জুগিয়ে যাচ্ছেন আইসিডিএস কর্মীরা। রাজ্যের শিশু কল্যাণ দপ্তরের কাছে বারংবার চিঠি দিয়ে বরাদ্দের টাকা আসেনি সেন্টারে। বাধ্য হয়ে ১ সেপ্টেম্বর থেকে শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের জন্য আর ডিম ও সবজি রান্না বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা। 
তাঁদের অভিযোগ, ‘‘ আমাদের পক্ষে আর ঘরের টাকা খরচ করে সেন্টার চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। মেয়েদের যার যেখানে যতটুকু ছিল সব চলে গেছে। বাজারে ৬০ থেকে ৮০ হাজার টাকা পর্যন্ত ধার হয়ে গেছে। ডিমের দোকান আর ধার দিচ্ছে না। আমাদের মান সম্মান নিয়ে টানাটানি শুরু হয়েছে। তাই আমরা ১ সেপ্টেম্বর থেকে নিজের খরচে আর ডিম সবজি কিনবো না।’’ সরকারের তরফ থেকে আইসিডিএস সেন্টারে আসা চাল, ডাল, নুন আর হলুদ দিয়ে ফুটিয়ে রান্না করা খাবারই শুধু দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে একপ্রকার বাধ্য হয়েছেন আইসিডিএস কর্মীরা। প্রশাসনের একটি সূত্রে জানা গিয়েছে, রাজ্য সঠিক তথ্য না পাঠানোর জন্য কেন্দ্র বরাদ্দ বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু কেন তিন মাস ধরে শিশুদের ডিম ও সবজি খাতে কোনও টাকা রাজ্য দিচ্ছে না, তা নিয়ে প্রশাসনের কেউই মুখে খুলতে চাননি। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের আশঙ্কা, ১০০ দিনের মতোই অঙ্গনওয়াড়িতেও বাসা বেঁধেছে আর্থিক দুর্নীতি। 


২২ আগস্ট পুজোর অনুদান না চাইতেই ১০ হাজার টাকা বাড়িয়ে দিয়েছে রাজ্য সরকার। প্রায় ২৮০ কোটি টাকা মমতা ব্যানার্জি পুজোর জন্য খরচ করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছেন। কিন্তু এরাজ্যের আইসিডিএস সেন্টারে ৮৫ লক্ষ শিশুর মুখে ডিম আর সবজির জন্য বরাদ্দ টাকা তিন মাস ধরে বন্ধ হয়ে পড়ে আছে। অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের অভিযোগ, ‘‘সারা রাজ্যে জুন মাস থেকে আগস্ট মাস পর্যন্ত কোথাও ডিম আর সবজির টাকা সেন্টারে আসেনি। নদীয়ার চারটি ও বাঁকুড়া জেলার গরিব আদিবাসী নিবিড় সিমলিপাল প্রজেক্টে মে মাস থেকে বরাদ্দ বন্ধ হয়ে আছে।’’ 
রাজ্যের প্রায় ১ লক্ষ ২০ হাজারের কাছাকাছি অঙ্গনওয়াড়ি কেন্দ্রে শিশুদের সোমবার, বুধবার ও শুক্রবার এই তিনদিনে গোটা ডিম সিদ্ধ দেওয়ার কথা। তারজন্য দিনপিছু শিশুদের বরাদ্দ ৬টাকা ৫০ পয়সা। ওই একইদিনে সেন্টারে নথিভুক্ত গর্ভবতী মায়েদের জন্য ডিম ও সবজি খাতে বরাদ্দ ৭টাকা ৩৪ পয়সা। মায়েদের জন্য বাড়তি ৮৪ পয়সা বরাদ্দ আলুর জন্য। 
সপ্তাহের মঙ্গলবার, বৃহস্পতিবার ও শনিবার— এই তিনদিনের জন্য শিশুদের মাথাপিছু বরাদ্দ ডিমের জন্য ৪ টাকা ৩৪ পয়সা। ওই পয়সায় অর্ধেক ডিমের সঙ্গে ১ টাকা ৯ পয়সা সবজির জন্য বরাদ্দ। ওই তিনদিনই গর্ভবতী মায়েদের জন্য দিনপিছু বরাদ্দ ৮ টাকা ১৩ পয়সা। ওই টাকায় গোটা ডিমের সঙ্গে ১ টাকা ৬৩ পয়সা বরাদ্দ সবজি আর আলুর জন্য। গত জুন মাস থেকে সেন্টারে আসা শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের জন্য ডিম ও সবজি খাতের কোনও টাকা রাজ্য পাঠাচ্ছে না। কিন্তু মা ও শিশুদের মুখে পুষ্টিকর খাবার তুলে দিতে নিজেদের উদ্যোগে টাকা খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা। 


সরকারের চরম অপদার্থতা সত্ত্বেও শিশুদের মুখে ডিম সবজি তুলে যাঁরা দিচ্ছেন তাঁদের সঙ্গেও বঞ্চনা করে যাচ্ছে রাজ্যের নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তর। গত ২০২১ সালের জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় সরকার গোটা দেশের সঙ্গে এরাজ্যের অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীদের স্মার্টফোন কেনার জন্য ৮ হাজার টাকা করে বরাদ্দ করেছিল। আড়াই বছর পার হওয়ার পরও সেই ফোনের টাকা এরাজ্যে কোনও অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী পাননি। দপ্তরের আধিকারিকদের নির্দেশে আইসিডিএস কর্মীরা বাধ্য হয়েছেন স্মার্টফোন কিনতে। নিজের খরচে ফোন কিনে তাতে কেন্দ্রীয় সরকারে ‘পোষণ’ অ্যাপ ডাউনলোড করে তাতে নথিভুক্ত করতে হয়েছে সেন্টারের মা ও শিশুদের নাম। আধার লিঙ্ক করতে হয়েছে। কারণ, কেন্দ্রের ফরমানে এখন ‘পোষণ’ অ্যাপের মধ্যেই সেন্টারের যাবতীয় কাজকর্মের ওপর নজরদারি চালায় কেন্দ্র ও রাজ্যের দুই সরকারই। কেন্দ্রীয় সরকারের একতরফা সিদ্ধান্তে এরাজ্যে প্রান্তিক এলাকার অনেক সেন্টারে আইসিডিএস কর্মীরা ফোন কিনতে পারেননি। কিন্তু রাজ্য সরকার বরাদ্দ টাকা তাঁদের হাতে তুলে না দিয়ে সেই কর্মীদের স্মার্টফোন ব্যবহার না করার জন্য সাময়িক বরখাস্তের শাস্তি দিয়েছিলেন। বাঁকুড়ার রানিবাঁধ প্রজেক্টের আইসিডিএস কেন্দ্রের মহিলা কর্মীদের ফোন না থাকার জন্য সাসপেন্ড করা হয়েছিল। কর্মীদের আন্দোলনের চাপে তা স্থানীয় প্রশাসন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। আইসিডিএস কর্মী সংগঠনের নেত্রী ইন্দ্রাণী মুখার্জি অভিযোগ করেন, ‘‘রানিবাঁধ এলাকায় আইসিডিএস কর্মীরা কীভাবে পাবেন স্মার্টফোন? গরিব এলাকায় পাড়া থেকেও তাঁরা ফোন জোগাড় করতে পারেননি। ১০০ দিনের কাজ বন্ধ থাকায় খেটেও টাকা রোজগার করার সুযোগ ছিল না। ওই এলাকার ২১ জন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীকে সরকার সাসপেন্ড করেছিল। কিন্তু আমাদের আন্দোলনের পর তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়।’’


পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য আইসিডিএস কর্মী সমিতির রাজ্য সম্পাদিকা শীলা মণ্ডল জানান,‘‘ দেশের সব রাজ্যের আইসিডিএস কর্মীরা কেন্দ্রের টাকায় মোবাইল ফোনে পোষণ অ্যাপ ব্যবহার করে কাজ করেছেন। অনেক রাজ্যে পুরানো ফোন বদলে দিয়ে নতুন ফোন কেনার পর্যন্ত টাকা দিয়েছে। আর আমাদের রাজ্য সরকার ২০২১ সাল থেকে ফোনের টাকা পর্যন্ত হাতিয়ে নিয়েছে।’’ 
শিশুদের জন্য ডিম সবজির বকেয়া টাকার জন্য দু’বার রাজ্যের নারী শিশু কল্যাণ মন্ত্রী শশী পাঁজার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন অঙ্গনওয়াড়ি কর্মীরা। চারবার গিয়েছিলেন আইসিডিএস প্রকল্পের শীর্ষ আধিকারিকের কাছে। কোনও জায়গা থেকেই সাড়া আসেনি। এবারও শিশু ও গর্ভবতী মায়েদের জন্য তিন মাস বকেয়া টাকার দাবিতে আগামী ২৯ আগস্ট সল্টলেকের নারী ও শিশু কল্যাণ দপ্তর অভিযানের ডাক দিয়েছে আইসিডিএস কর্মীরা। একইসঙ্গে নিজেদের জন্য সরকারের বরাদ্দ করা স্মার্টফোনের দাবিতেও সরব হবেন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য আইসিডিএস কর্মী সমিতি।

Comments :0

Login to leave a comment