মধুসূদন চ্যাটার্জি-রানীবাঁধ
রবিবার বিকেলে বাকুড়ার গোঁসাইডিহি গ্রামের ঝোপে ঘুম পাড়ানি গুলিতে ক্লান্ত হয়ে বনদপ্তরের খাঁচায় বন্দি হয় বাঘিনী জিনাাত। ওই দিন রাতেই গ্রিন করিডর করে বাঁকুড়া থেকে আলিপুর চিড়িয়াখানায় নিয়ে আসা হয় বাঘিনী জিনাতকে। বিশেষ কনভয় তাকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয়। তারপর থেকে সে ছিল আলিপুর চিড়িখানার পশু চিকিৎসা হাসপাতালের খাঁচায়। মঙ্গলবার চিকিৎসকরা জানিয়েছেন জিনাত সুস্থ আছে। জানা গেছে, এদিনই কলকাতা থেকে ওড়িশার সিমলিপালের পথে রওনা দিয়েছে জিনাত। গ্রিন করিডর করে তাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থা হয়েছে। বুধবার জিনাত ওড়িশার সিমলিপালে পৌঁছবে এমনটাই জানা গেছে বনদপ্তর সূত্রে।
৩ বছর বয়সি বাঘিনী জিনাতের সৌজন্যে এখন রাজ্যের মানুষের কাছে গোপালপুর- গোঁসাইডিহি গ্রামের নাম ছড়িয়ে পড়েছে। গত শনিবার ও রবিবার এই দুদিন সংবাদমাধ্যম, রাজ্যের প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিরা, পুলিশ, বনদপ্তরের নানাস্তরের কর্মীদের ভিড়ে হারিয়ে গিয়েছিলেন গোঁসাইডিহি গ্রামের মানুষগুলো। কারণ এত মানুষ তো কোনদিন এখানে আসেননা। গ্রামের মানুষের বক্তব্য ছিল ‘‘আমরা এখন ভি আই পি’’ কার্যত বিচ্ছিন্ন এক এলাকায় বাস করা এই গ্রামের মানুষজন ভাবতেও পারেননি এত নামি দামী গাড়ি, সাজ পোষাকের বন্দুকধারী পুলিশ, বিরাট বিরাট ক্যামেরা হাতে সাংবাদিকরা এই ১৫টি পরিবারের বাস করা গোঁসাইডিহি গ্রামে ৪৮ঘন্টা বিনিদ্র কাটাবেন। যাঁরা এখানে এসেছিলেন তাঁরা কি বুঝতে পারলেন কিভাবে এখানকার আদিবাসী ও বেশ কয়েকটি তপসীলি জাতীভুক্ত পরিবার একদিন প্রতিদিন দিন কাটায়? কিভাবে এঁরা খাবার সংগ্রহ করে? অসুস্থ হলে চিকিৎসা করায় কোথায়? কোথায় এঁদের ছেলে মেয়েরা পড়াশোনা করতে যায়? এঁদের জীবনের দিনলিপি বহুকাল আগে যেভাবে লেখা হয়েছিল তা এখনও পরিবর্তনের কোন উদ্যোগ নেই কেন? এভাবেই কি মানুষগুলো দিন কাটাবেন? এখন তো জিনাত চলে গেছে, আর কি কেউ গোঁসাইডিহির খবর রাখবে? নিশ্চিত নয়।
বাঘিনী জিনাতের দুদিন আশ্রয় নেওয়া রানীবাঁধের বিচ্ছিন্ন গোঁসাইডিহি গ্রামের মানুষজন।
বাঁকুড়া জেলার রানীবাঁধ ব্লকের মুকুটমনিপুর জলাধারের গায়েই এই গোঁসাইডিহি গ্রাম। ৫৬ সালে যখন এই জলাধার তৈরী হয়েছিল তখন এই গ্রামের একটা বড় অংশ জলাধারের তলায় ডুবে যায়। যাঁরা তখন বেঁচে ছিলেন তাঁদের কেউ এখন আর পৃথিবীতে নেই। তাঁদের উত্তরসূরিরা আছেন। এশিয়ার বৃহত্তম মাটির এই বাঁধ ও দেশের অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র মুকুটমনিপুর জলাধারের সামনে এঁরা বাস করলেও এঁরা খালি সেই নীল জলের শোভাই দেখতে পান। এই জলাধার থেকে চাষের জন্য এক ঘটি জলও এই গোপালপুর- গোঁসাইডিহির জমিতে আসেনা। গোপালপুর, গোঁসাইডিহি ও বারুলিয়া এই তিনটি গ্রাম নিয়ে গোপালপুর সংসদ। গোঁসাইডিহিতে যে ১৫টি পরিবার বাস করেন তাঁরা সকলেই সাঁওতাল আদিবাসী জনগোষ্টির মানুষ। পাশের বারুলিয়ায় ৪৭টি পরিবার আছেন, তাঁদের মধ্যে ৪৫টি পরিবার আদিবাসী অধ্যুষিত ও ২টি পরিবার তপসীলিজাতিভুক্ত এবং গোপালপুরে ৬টি আদিবাসী ও ৭টি তপসীলিজাতিভুক্ত মানুষ বাস করেন। রানীবাঁধের পুড্ডি গ্রামপঞ্চায়েতের মধ্যে এটি পড়ে। তবে এই গ্রাম থেকে পু্ড্ডির দুরত্ব ১৫কিমি। সহজে সেখানে পৌঁছানোও যায়না। এই গোপালপুর যেতে গেলে মুকুটমনীপুর থেকে নৌকায় চেপে ডিয়ারপার্ক নারকোলি ঘাটে আসতে হবে। সেখান থেকে আবার ১৪কিমি গেলে এই গোপালপুর, গোঁসাইডিহি। আবার এখানকার মানুষজনকে ব্লক কেন্দ্র রানীবাঁধে আসতে গেলে এই নদীপথ ও রাস্তার ২৪কিমি দুরত্ব পেরিয়ে আসতে হয়। সন্ধ্যার পর বন্ধ নৌকা। কিভাবে তাঁরা রানীবাঁধে আসবেন? এই প্রশ্ন এখন আর কেউ করেননা, কারণ কেউ’ই তো এর সমাধান করেননি। জানান গ্রামের বাসিন্দা মহেশ্বরী হাঁসদা। অন্যদিকে গোপালপুর থেকে রাস্তা পথে পুরুলিয়ার মানবাজার হয়ে হিড়বাঁধের হাতিরামপুর পেরিয়ে এঁদের রানীবাঁধ আসতে হয়। তার দুরত্ব প্রায় ৪০কিমি। ‘‘ রানীবাঁধের সরকারি কাজের জন্য বাধ্য হয়ে কষ্ট করে আমাদের যেতে হয়, কিন্তু আমাদের ছেলে মেয়েদের লেখাপড়া, মানুষজনের চিকিৎসা সব কিছুই পুরুলিয়ার মানবাজারে হয়, তারও দুরত্ব ২৪ কিমি। তবে রাস্তার থাকার জন্য যেতে সুবিধা হয় মানবাজার’’ জানান প্রতিভা বাস্কে, তুলসিমনী বাস্কে। এঁরা জানান, রাতেভিতে যদি মানুষ অসুস্থ হয়ে হন, কিভাবে মুকুটমনিপুরের বিশাল জলাধার ডিঙিয়ে আমরা রানীবাঁধ যাব? তখন তো নৌকা বন্ধ। আবার মুকুটমনিপুর থেকে রানীবাঁধ ১২কিমি। সব দিক দিয়েই এখানকার মানুষ কার্যত বিচ্ছিন্ন হয়ে আছেন। এঁদের অনেকেরই বক্তব্য এই মৌজা এলাকা যদি পুরুলিয়া জেলা সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়া হয় তাহলে অনেকটাই সুবিধা হবে। বাঁকুড়া জেলা প্রশাসনের লোকজনও এখানে আসেননা। কোন কাজ করলে ঠিকাদারও আসতে চায়না। কারন নৌকা করে মালপত্র কিভাবে নিয়ে যাবেন? এখানকার বাসিন্দারা মুলত মুকুটমনিপুর জলাধার থেকে মাছ ধরে জীবিকা চালান। দরিদ্রতা, জনবিচ্ছিন্ন হয়েই এঁদের দিন কাটে। নেহাত গ্রামে বাঘিনী ঢুকেছিল তাই পরিচিত হল গোপালপুর- গোঁসাইডিহি। কতদিন মানুষ আর সেই স্মৃতি মনে রাখবেন? যে অবস্থায় বছরের পর বছর এখানকার ৭৫টি পরিবার বাস করে আসছেন সেই অবস্থা কি পরিবর্তন হবেনা। বাঘিনী জিনাত এসে সেই প্রশ্ন আবার ছুঁড়ে দিল।
Comments :0