দেবদাস ভট্টাচার্য
ইস্কো বাঁচাও আন্দোলনের পর রাষ্ট্রায়ত্ত ইস্পাত শিল্পের শ্রমিক আন্দোলনে আরও একটি সফল লড়াইয়ের দৃষ্টান্ত তৈরি করলেন অন্ধ্র প্রদেশের রাষ্ট্রীয় ইস্পাত নিগম লিমিটেডের (আরআইএনএল) বিশাখাপত্তনম স্টিল প্ল্যান্টের (ভিএসপি) শ্রমিক কর্মচারীরা। মোদী সরকারের ক্যাবিনেট কমিটি অন ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স (সিসিইএ) ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ভিএসপি’র ১০০ শতাংশ স্ট্রাটেজিক ডিসইনভেসমেন্ট বা কৌশলগত বিলগ্নিকরণের। আদানির হাতে আরআইএনএল’র ভিএসপি’কে পুরোপুরি তুলে দিতে চেয়েছিল। প্ল্যান্টের কাছেই গঙ্গাভরম সমুদ্র বন্দর। এই বন্দর ইতিমধ্যেই তুলে দেওয়া হয়েছে আদানির হাতে। বন্দরের নতুন নামকরণ হয়েছে আদানি গঙ্গাভরম পোর্ট লিমিটেড।
কিন্তু বিজেপি সরকারের হয়তো ‘বিশাখা উক্কু’র (বিশাখাপত্তনমের ইস্পাত) অতীত খেয়ালে ছিল না। বিশাখা উক্কু বা ইস্পাত কারখানার জন্য অন্ধ্র তেলেঙ্গানা বিধানসভা থেকে ছয়ের দশকে ৬৭ জন কমিউনিস্ট বিধায়ক বিধানসভা থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। ৭ জন বামপন্থী সাংসদ পদত্যাগ করেছিলেন। ১৯৬৬ সালের নভেম্বরে ইস্পাত কারখানার দাবিতে আন্দোলনে পুলিশ গুলি চালিয়েছিল। সেদিন ৩২ জন পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন, মৃতদের মধ্যে অনেক ছাত্রও ছিল। আন্দোলনের পথ বেয়ে ১৯৭১ সালের ২০ জানুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিশাখা উক্কুর শিলান্যাস করেন। কিন্তু তৎকালীন কংগ্রেস সরকার কারখানার জন্য অর্থ অনুমোদন করেনি। ১৯৭৭ সালে জনতা সরকার গঠিত হয়, ইস্পাতমন্ত্রী হন বিজু পট্টনায়েক। তখন ১০০০ কোটি টাকা বিশাখাপত্তনম স্টিল প্ল্যান্টের জন্য বরাদ্দ হয়।
দেশের একমাত্র সমুদ্র বন্দরের সুবিধা যুক্ত ইস্পাত কারখানা ভিএসপি। সমুদ্র বন্দর ছাড়াও রয়েছে জাতীয় সড়ক, বিমান বন্দর এবং রেলওয়ে স্টেশন। সর্বোচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ইস্পাত কারখানা। উৎপাদন ক্ষমতা বার্ষিক ৭.৩ মিলিয়ন টন। ভাইজাগ শহরের প্রাণকেন্দ্রে মূল্যবান ২০ হাজার একর জমির ওপর প্ল্যান্ট ও টাউনশিপ এলাকা। সবমিলিয়ে বর্তমান বাজার দর ৩ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি।
এমন সোনার খনি বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য মোদী সরকার পরপর তিনটি কমিটি করেছিল। এই কমিটি নাকি প্ল্যান্ট পরিদর্শন করে খতিয়ে দেখবে সেখানে কী কী রয়েছে।
চার বছর আগে মোদী সরকারের নেওয়া ভিএসপি’র স্ট্রাটেজিক সেলের সিদ্ধান্ত যে কমিটি নিয়েছিল, সেই ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স কমিটির বৈঠক বসেছিল মোদীর সভাপতিত্বে ১৬ জানুয়ারি। এই কমিটি সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছে ভিএসপি পুনরুজ্জীবনের। বিশাখাপত্তনম স্টিল প্ল্যান্টের জন্য ১১৪৪০ কোটি টাকার স্পেশাল প্যাকেজ বরাদ্দ করা হয়েছে।
ইস্কো কারখানা বেসরকারি মালিক মুকুন্দের কাছে মাত্র ১২০ কোটি টাকায় বিক্রি করে দিতে চেয়েছিল কেন্দ্রীয় সরকার। ১৯৮৫ সালে গড়ে উঠেছিল ইস্কো বাঁচাও কমিটি। লাগাতার ২০ বছরেরও বেশি ধারাবাহিক সংগ্রাম জারি রেখেছিল ইস্কো বাঁচাও কমিটি। কারখানার জন্য এলাকার মানুষ, সমগ্র শিল্পাঞ্চলের মানুষ, জেলার মানুষ এক হয়েছিলেন। মানুষের ঐক্যবদ্ধ লড়াই সফল হয়েছিল। ২০০৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ইস্কো স্টিল অথরিটি অব ইন্ডিয়া (সেইল)-এ অন্তর্ভুক্ত হয়। সেইল ১৬০০০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করে ইস্কোতে। নতুন নামকরণ হয় ইস্কো স্টিল প্ল্যান্ট (আইএসপি)।
ভাইজাগ তথা অন্ধ্র প্রদেশও চুপ করে থাকেনি। ইস্কো বাঁচাও কমিটির আদলে এখানে গড়ে উঠেছে ‘বিশাখা উক্কুপরিরক্ষণা পোরাটা’। ১৬টা শ্রমিক সংগঠন এবং সর্বস্তরের মানুষকে নিয়ে গড়ে উঠেছে এই কমিটি। ধারাবাহিক লড়াই জারি রেখেছে বিশাখা উক্কু। কমিটির আহ্বায়ক সিআইটিইউ নেতা অযোধ্যা রামু বলেন, আমরা দু’বার দিল্লির যন্তর মন্তরে ধরনা দিয়েছি। বিশাখাপত্তনম স্টিল প্ল্যান্ট থেকে বিমান বন্দর ১১ কিলোমিটার রাস্তায় মানব বন্ধন করেছি। কারখানার খরিদ্দার এবং কেন্দ্রীয় সরকারের কমিটির লোকজন আসবে হাইওয়ে দিয়ে, আমরা ১০ হাজার মানুষ নিয়ে হাইওয়েতে অবরোধ তৈরি করেছি। সেখানেই রান্না এবং খাওয়া দাওয়া হয়েছে। কারখানার গেটে লাগাতার পিকেটিং, ধর্মঘট, বিক্ষোভ সভাও হয়েছে।
লড়াই জারি রাখার আহ্বান জানিয়ে বিশাখা উক্কুর আহ্বায়ক অযোধ্যা রামু বলেন, এই প্যাকেজই যথেষ্ট নয়। ভিএসপিকে সেইলের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। উৎপাদনের কাঁচামালের (লৌহ আকরিক ও কয়লা) জন্য ক্যাপটিভ খনি চাই। প্ল্যান্টে তিনটি ব্ল্যাস্ট ফার্নেস। দুটি চলতি জানুয়ারিতেই পূর্ণ উৎপাদনক্ষম হবে। উৎপাদন ক্ষমতা প্রতিদিন ১৫ হাজার হট মেটাল। তৃতীয় ফার্নেসে আগস্ট মাসে উৎপাদন শুরু হবে। ১২৩০০ স্থায়ী শ্রমিক এবং ১৪০০০ ঠিকা শ্রমিক, মোট ২৬৩০০ জন শ্রমিক কাজ করেন এই কারখানায়। ভিএসপি বা বিশাখা উক্কু কেবল একটা প্ল্যান্ট নয়। মানুষের আবেগ। মানুষের রুজিরুটি, বেঁচে থাকা এবং বেঁচে থাকার লড়াই। সেটা বেসরকারি ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না।
VSP: resisting privatisation
বিশাখাপত্তনমে লড়াইয়ের দৃষ্টান্ত দেখালেন ইস্পাত শ্রমিকরা
×
Comments :0