Bangladesh Movement

কোটা সংস্কার কি বলছে বাংলাদেশ

আন্তর্জাতিক বিশেষ বিভাগ ফিচার পাতা

এম এম আকাশ
 

ভূমিকা
সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের মাধ্যমে তাকে যৌক্তিক করার জন্য বর্তমানে সারা দেশে বীরত্বপূর্ণ ছাত্র আন্দোলন চলছে। এই আন্দোলন দ্রুত কল্পনাতীত গতিতে সাধারণের মধ্যে ব্যাপকতা অর্জন করেছে। ছাত্ররা ইতিমধ্যে রাষ্ট্র ও তার পেটোয়া বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে প্রচুর আত্মত্যাগ ও সাহসী উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। বর্তমান সরকারের অবিমৃষ্যকারিতার জন্য এই আন্দোলনটি রক্তক্ষয়ী রূপ নেয় এবং অকুতোভয় আবু সাঈদ সহ মল্যবান ছয় ছয়টি প্রাণের বলিদান হয়। কথিত আছে এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ‘‘আমি কে? তুমি কে? রাজাকার-রাজাকার’’ স্লোগান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকেও অপমান করেছেন। কথাটা হু-ব-হু সত্য নয় । ছাত্রদেরও এই স্লোগানের শেষাংশে ছিল, ‘‘কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার- স্বৈরাচার” । সুতরাং ছাত্ররা নিজেরা নিজেদেরও রাজাকার আখ্যা দিয়েছে এই ব্যাখ্যা অধিকাংশ সাধারণ ছাত্রের জন্য সঠিক নয়। তবে সরকারকে তারা স্বৈরাচার বলেছে একথা ঠিক। এছাড়া যে কোনও “ক্রাউডের” বা ভিড়ের মধ্যে ঘোলা পানিতে মাছ শিকারকারী খারাপ লোক থাকতে পারেও তারাও কখনো কখনো এই আন্দোলনকে ‘‘জামাত-শিবিরের” ধারায় নিয়ে যেতে চেয়েছে। কিন্তু এগুলি এর মূলধারা ছিল না ৷
সব দিক থেকেই এই আন্দোলনে বিপুল শক্তি প্রদর্শন করেছেন আসলে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা। তারাই এর নায়ক। তারা স্বতঃস্ফুর্তভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো থেকে শাসকদলের সন্ত্রাসীদেরও নিরস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে বিতাড়িত করেছেন, শাসক দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকেও তারা ঐক্যবদ্ধ প্রেসারের মাধ্যমে বাধ্য করেছেন হলে সুশাসনের প্রতিশ্রুতি দিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হলের ছাত্রীদেরও ভূমিকা ছিল এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য। অবশ্য রাষ্ট্র যখন সদলবলে বাহিনী নিয়ে হস্তক্ষেপ করেছে তখন তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়েছেন। হল ত্যাগ করেও যার যার বাসায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন ৷ সে সময় তাদেরও লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে।। কিন্তু এর পরেও এই ধরনের নির্দলীয় শক্তিশালী অভূতপুর্ব ছাত্র আন্দোলনে শাসক দল, বিরোধী দল, প্রগতিশীল শক্তি সকলের জন্যই একটি অভিনব বার্তা দিতে সক্ষম হয়েছে। সেটা হচ্ছে যে কোনও ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠানে শাসক দলীয় দুঃশাসন সেই প্রতিষ্ঠানের সাধারণ সদস্যরা বেশিদিন নিশ্চুপ ভাবে মেনে নেয় না। সব মিলিয়ে নিশ্চিতভাবে বলা যায় ২০২৪ সালে বাংলাদেশের ছাত্রদেরও কোটা আন্দোলন ইতিহাসের একটি অনন্য শিক্ষণীয় অধ্যায় হিসাবে সকল রাজনৈতিক নেতাদের মনে দুঃস্বপ্ন বা অপ্রত্যাশিত বিস্ময়ের মতো চিরজাগরুক থাকবে ।
 

কোটা আন্দোলনের ইতিহাস
২০১৮ সালেও কোটা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তীব্র ছাত্র আন্দোলন হয়েছিল। তার প্রেক্ষিতে ১২ এপ্রিল জাতীয় সংসদে ভাষণদানকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর ভাষায় ‘‘বিরক্তির’’ বশববর্তী হয়ে সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সম্পূর্ণ বাতিলের ঘোষণা দেন। একই বছর ৪ অক্টোবর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় কোটা বাতিল করে বিজ্ঞাপন জারি করে। এরপর গত ৫ জুন ছয়জন ছাত্রের দায়েরকৃত রিটের প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট মুক্তিযোদ্ধা কোটা বাতিলের পরিপত্র অবৈধ ঘোষণা করে। হাইকোর্ট  তার রায়ে সকল প্রকার কোটা বহাল ও সেগুলি কম বেশি করার তথা সংস্কারের সুযোগও উন্মুক্ত রেখে রায়টি দেন। ৫ জুলাই সরকার সুপ্রিম কোর্টে রায়ের বিরুদ্ধে পুনরায় আপিল করলে আগামী ৫ আগস্ট আপিল শুনানির দিন ধার্য় করা হয়। তাই ইস্যুটি এখন পর্যন্ত বিচারাধীন রয়েছে।
ইতোমধ্যে ১ জুলাই থেকে শুরু হয় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন যা এখনো চলমান রয়েছে । আমাদেও মুক্তিযুদ্ধেও অন্যতম মূলনীতি হচ্ছে সকল নাগরিকের ‘‘সুযোগের সমতা’’। সমাজে সাম্য এবং সমতা বিধান নিশ্চিত করাই প্রগতিশীলদের উদ্দেশ্য। ১৯৭২ সালে প্রণীত রাষ্ট্রীয় সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদেও দফা ৪ এ আছে-- রাষ্ট্র সমাজে যারা অনগ্রসর তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা দিতে পারবে এবং সংবিধানের অন্য যে কোনও বিধান এক্ষেত্রে কোনও বাধা হতে পারবে না। ইতিবাচক স্বীকৃতির (Affirmative Recognition) এই বিধান সভ্য অনেক দেশে চালু রয়েছে যাতে অনগ্রসর গোষ্ঠীর সদস্যরা বৈষম্যের বাধা দূর করেও আর দশজন মানুষের মতো সমাজে মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে পারে। রাষ্ট্র তাদের যদি বিশেষ সুবিধা দেয় তাহলে তাই কোনও ক্ষতি নেই। ১৯৭২ সালে সর্বপ্রথম সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি চালু করা হয়। এরপর একাধিক বার কোটা পদ্ধতিতে পরিবর্তন সাধন করা হয়। ১৯৯৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধার স্বজনদের জন্য দেওয়া কোটা বৃদ্ধি করা হয়। কোটা ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাহৃত হোক বা উঠে যাক এরকম কোনও আন্দোলনকে জাতীয়ভাবে বর্তমানে কেউই সমর্থন করেন না। আমি মনে করি, কোটা ব্যবস্থা থাকতে পারে তবে তার ব্যাপক সংস্কার করা প্রয়োজন। অর্থাৎ আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই কোটা ব্যবস্থা প্রত্যাহার করা নয় বরং প্রয়োজনীয় সংস্কার সাধনের মাধ্যমে তাকে হালনাগাদ এবং সময়োপযোগী করা যেতে পারে। চলমান ছাত্র আন্দোলনের লক্ষ্যও তাই ।
 

কোটা সংস্কার কেন দরকার?
প্রশ্ন হলো, কোটা আইন সংস্কার কেন চাই? ১৯৭২ সালে যখন কোটা পদ্ধতির আইনটি প্রণীত হয়েছিল তখন দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা যেমন ছিল এখন তা অনেকটাই পরিবর্তিত হয়ে গেছে। কাজেই আগের কোটা পদ্ধতি অবিকলভাবে বহাল রাখার সুযোগ নেই। যখন মুক্তিযুদ্ধ হয় তখন যারা যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন তাদের মধ্যে একটি বড় অংশই ছিল তরুণ এবং ছাত্র। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ এমনকি স্কুলের ছাত্ররাও ক্ষেত্র বিশেষে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন। তারা এবং অন্য যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেন তাদের অনেকেরই বাড়ি-ঘর পাক বাহিনী এবং তাদের দোসররা পুড়িয়ে দেয় । লুটপাট চালায় । ফলে মক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে অনেকেই নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিল । স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে তারা অর্থনৈতিকভাবে চরম বিপর্যয়ের মুখোমুখি হন। এই অবস্থায় তাদের বিশেষ সুযোগ দিয়ে সমাজে টিকে থাকার ব্যবস্থা করা অত্যন্ত জরুরি ছিল। পরবর্তীতে সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের দেওয়া কোটা সুবিধা বাড়ানো হয় । বর্তমানে হাইকোর্টে ও রায়ের পর সরকারি চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের পোষ্যদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা নির্ধারিত আছে। অন্যান্য অনগ্রসর কোটা মিলিয়ে সরকারি চাকরিতে বর্তমানে কোটা সুবিধার হার হচ্ছে ৫৬ শতাংশ। অর্থাৎ সরকারি চাকরিতে মাত্র ৪৪ শতাংশ পদে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পূরণ করা হচ্ছে। ৫৬ শতাংশের মধ্যে ৩০ শতাংশই মুক্তিযোদ্ধাদেও জন্য নির্ধারিত। স্বাধীনতার পরবর্তী কয়েক বছর হয়তো মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা সুবিধা সংরক্ষিত রাখার প্রয়োজন ছিল। কারণ সেই সময় মুক্তিযোদ্ধারা সবে মাত্র যুদ্ধ করে ফিরেছে। তাদের আর্থিক অবস্থা খারাপ ছিল । অনেকেই শিক্ষা অসমাপ্ত রেখেই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। কিন্তু যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে তাদের পক্ষে আর শিক্ষাঙ্গনে যোগ দেওয়া সম্ভব হয়নি। কারণ তাদের সংসারের দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়েছে। সরকারি চাকরিতে যোগ দিতে পারাটা আত্মনির্ভর হবার একটি উপায় বা কৌশল হিসাবে তখন গণ্য করা হচ্ছিল। সেই সময় সরকারি চাকরিতে ৩০ শতাংশ কোটা সংরক্ষণ করার যুক্তি ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে তারা সরকারি চাকরিতে প্রবেশের মাধ্যমে তাদের আর্থিক অবস্থার উন্নতি সাধন করতে সমর্থ হন। তখন তাদের পরিবারের অন্যান্য সদস্যদেরও আর অনগ্রসর বলা যাবে না। ৫৪ বছর পর মুক্তিযোদ্ধাদের সন্তানের সন্তানদেরও কোটা সুবিধা পাওয়াটা নিয়ে তাই স্বাভাবিকভাবেই বর্তমানে প্রশ্ন উঠেছে। অবশ্য একজন মানুষ মুক্তিযুদ্ধ করেছে বলে তাকে সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধা দেওয়া হচ্ছে বিষয়টি আত্মসম্মানসম্পন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য তেমন ছিল না। বরং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে তারা আর্থিক এবং শারীরিকভাবে সামর্থ্যহীন হয়ে পড়েছিলেন। তাই সমাজের একজন সামর্থ্যহীন মানুষকে বেঁচে থাকার অবলম্বন নিশ্চিত করার জন্যই সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধার প্রবর্তন করা হয়েছিল। কারণ সেই সময় এটা ছাড়া কোনও তাৎক্ষণিক বিকল্প তাদেরও সামনে ছিল না। ৭২-এর সংবিধানে তখনো সাধারণভাবে বলা হয়েছিল,সমাজের সুবিধা বঞ্চিত মানুষকে (কোটা) সুবিধা দিতে হবে। তখন এমন একটি বিশেষ সুবিধা প্রদানের প্রয়োজন ছিল । অর্থনৈতিক ও আদর্শগত প্রয়োজন দু’দিক থেকেই মুক্তিযোদ্ধারা কোটা সুবিধা পাবার জন্য উপযুক্তও ছিল। বিশেষ করে যারা বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের ছাত্র থাকা অবস্থায় মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন তারা এরপর রাষ্ট্রীয় কোটা সুবিধা ভোগ করতে সক্ষম হয়। তবে বাস্তবে এমনিতেই জীবিত মুক্তিযোদ্ধা ও তাদের সন্তানদেরও সংখ্যা কমে এসেছে। সুযোগ থাকলেও কোন কোন হিসাবে কোনও কোনও বছরেও বিসিএস চাকরির মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের কোটায় চাকরি পেয়েছেন এরকম সুবিধাভোগীর সংখ্যা ৯ শতাংশেরও কমে নেমে এসেছে।
 

মুক্তিযুদ্ধ কোটার অপব্যবহার
স্বাধীনতার পর মুক্তিযোদ্ধারা যেভাবে সুবিধা বঞ্চিত হয়েছিলেন সেই অবস্থা এখন আর নেই । কারণ যারা সেই সময় কোটা সুবিধার আওতায় সরকারি চাকরি লাভ করেছিলেন তারা নিশ্চিতভাবেই আর আর্থিক বঞ্চনার মধ্যে নেই। কাজেই মুক্তিযোদ্ধাদেরও সন্তান এবং নাতি বা পোষ্যদের সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধা পাবার কোনও সুযোগ সংবিধান মোতাবেক থাকছে না। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য যে কোটা সুবিধা আছে তা কমানো যেতে পারে। এখানে একটি বিষয় মনে রাখতে হবে, একজন মুক্তিযোদ্ধা হলেই তিনি সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধা পাবেন এটা হতে পারে না। দেখতে হবে মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে যাকে কোটা সুবিধা দেওয়ার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে তিনি প্রকৃতই সুবিধা বঞ্চিত কি না। আগে যদি কোটা সুবিধা পেয়ে থাকেন তা তিনি ব্যবহার করতে পেরেছেন কি না। অর্থাৎ কোটা সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে সুবিধা ঞ্চিত কিনা সেটাই মূল বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিত। এ সংক্রান্ত নিয়ম-কানুন তৈরি না করে ঢালাওভাবে ঘরে ঘরে মুক্তিযোদ্ধাদের কোটা সুবিধা প্রদানের কোনও যুক্তি থাকতে পারে না। কোটা সুবিধা প্রদানের ক্ষেত্রে যাতে কোনও ধরনের দুর্নীতি না হয় কঠোরভাবে তা নিশ্চিত করতে হবে। দুর্নীতির মাধ্যমে কেউ যাতে কোটা সুবিধার সুযোগ গ্রহণ করতে না পারে সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখতে হবে। দেশে প্রায় ৫ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেটধারি আছেন বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়। এরা জাল সার্টিফিকেট গ্রহণ করে সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিচ্ছেন। এদের পোষ্যরা যাতে কোনোভাবেই কোটা সুবিধা পেতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু তাই নয়, যারা মুক্তিযোদ্ধার জাল সার্টিফিকেট গ্রহণ করে সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে চলেছেন তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন ।
 

অন্যান্য কোটার সুবিধা ও করণীয়
কোটা আন্দোলনকারীরা এখনো আদিবাসীরা কোটা সুবিধা পেতে পারেন। কারণ তারা মূল ধারার জনগণ থেকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছেন। কাজেই তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের জন্য সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। উল্লেখ্য, চাকরি বা কর্মসংস্থান ছাড়া সহজে দারিদ্র বিমোচন তাদের জন্যও সম্ভব নয়। কাউকে কিছু আর্থিক বৃত্তি সহায়তা করার চেয়ে একটি চাকরির ব্যবস্থা করা হলে তার বেশি উপকার হবে। প্রতিবন্ধীরা সরকারি চাকরিতে কোটা সুবিধা পেতে পারেন। কারণ তারা সমাজে অত্যন্ত অবহেলিত অবস্থায় কর্মহীন রয়েছেন। নারীরাও কোটা সুবিধা পেতে পারেন। তবে আগে নারীরা সরকারি চাকরি পাবার ক্ষেত্রে যেরকম সুবিধা বঞ্চিত ছিলেন এখন তা নেই। নারীরা এখন পুরুষের পাশাপাশি সরকারি চাকরিতে দাপটের সঙ্গে কাজ করে চলেছেন । নারীরা এখন ঘর থেকে বেরিয়ে আসছেন। সরকারি চাকরি সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা কর্মসংস্থানের মাধ্যমে সংসারের ব্যয় নির্বাহ করছেন। কাজেই নারীদের কোটা আগের চেয়ে কমানো যেতে পারে। বর্তমানে ছাত্র সমাজ যে আন্দোলন করছে তার স্বরুপ বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। ইতিপূর্বে আন্দোলনরত ছাত্ররা একবার কোটা সুবিধার সম্পূর্ণ বিলুপ্তি চেয়েছিল । তখন খুব বাজে স্লোগানও মিছিল থেকে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ আছে ( মুক্তিযোদ্ধাদেরও গালে চপেটাঘাত করার আওয়াজ তোলার ধৃষ্টতাও আমরা দেখেছি!) সেই সময় সরকার প্রধান ভুল করে অথবা বিরক্ত হয়ে কোটা সুবিধা সম্পূর্ণ বিলুপ্ত করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এই সিদ্ধান্তটি ছিল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার ফল। পরবর্তীতে কোটা সুবিধা রক্ষা করার ন্য যখন আদালতে রিট হলো তখন সরকার তার দেওয়া সিদ্ধান্তকে রক্ষা করার জন্য কোনও চেষ্টা করেনি। সরকারের এই পরবর্তী অবস্থানকে আমি সমর্থন করি। কারণ কোটা বিলুপ্তি কোনও সমাধান নয়। বরং সংস্কার করা যেতে পারে। আদালত সামগ্রিক বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় সংস্কারের ব্যবস্থা রেখে একটি রায় প্রদান করে। আদালত তার পর্যবেক্ষণে বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংরক্ষিত কোটা বিলুপ্ত করা ঠিক হবে না। স্থিতাবস্থা আরও ৪ সপ্তাহ তথা ৫ আগস্ট পর্যন্ত চালু রাখার ঘোষণা দেয় আদালত।
এতে সাধারণ ছাত্রদের মাঝে তীব্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। আন্দোলনরত ছাত্ররা বলছে, এখন তো আর চাকরি প্রার্থী মুক্তিযোদ্ধা নেই। তাদের সন্তান বা নাতি-পুতিদের কোটা সুবিধা দেবার কোনও যুক্তি থাকতে পারে না। আন্দোলনরত ছাত্ররা কোটা বাতিল চাচ্ছে না, তারা এখন কোটা সংস্কার চাচ্ছে, যার অবশ্যই যুক্তি আছে।
আমরা যদি উন্নত দেশ হতে চাই তাহলে আমাদের প্রশাসন ব্যবস্থাকেও উন্নত করতে হবে। প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে উচ্চ শিক্ষিত, প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ জনবলের সমাবেশ ঘটাতে হবে। কোটা সুবিধা তাদেরও জন্য প্রযোজ্য হয় যারা প্রাথমিক যোগ্যতা প্রদর্শন করতে সমর্থ হয়েছে। অর্থাৎ যারা পরীক্ষায় পাশ করেছে তাদের জন্য। যারা পরীক্ষায় অকৃতকার্য হয় কোটা সুবিধা তাদের কোনও উপকারে আসে না । কাজেই যোগ্যতার একটি ন্যূনতম মাপকাঠি তো আমরা ধরেই নিচ্ছি। তারপর আসে কোটার প্রশ্ন। হয়তো চাকরির আবেদনকারীর মধ্যে যিনি অধিক যোগ্য তিনি কোটার কারণে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতায় চাকরিটি পেল না। আর একজন তুলনামূলকভাবে কম যোগ্যতা সম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও কোটা সুবিধার কারণে চাকরিটা পেয়ে গেলেন। এক্ষেত্রে হয়তো আমরা মেরিট বা যোগ্যতাকে কম মূল্য দিলাম। তুলনামূলক কম যোগ্যতা সম্পন্ন প্রার্থী যদি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ পান তাহলে প্রশাসনের জন্য তা কিছু না কিছু ক্ষতির কারণ হতে পারে। বর্তমানে সরকারি চাকরিতে ৫৬ শতাংশ কোটার ব্যবস্থা রয়েছে। এটা অবশ্যই মেধাবী হয়েও চাকরি পেলেন না তাদের জন্য ক্ষোভের কারণ হবে। তাই এরকম ক্ষোভ কমানো ও দক্ষতাকে আরও গুরুত্ব দিয়ে কোটার এই অতি উচ্চ হার কমানো দরকার। যারা সমাজে পশ্চাৎপদ হয়ে আছেন এটা তাদের ব্যক্তিগত কোনও দোষ নয়। কারণ সমাজ তাদের উপযুক্ত হয়ে গড়ে উঠার সুযোগ দিতে পারেনি। তাই কোটার মাধ্যমে তাদের একটি সাময়িক সুযোগ করে দেওয়া হচ্ছে। তাই বলে যেনোতেনোভাবে কোটা সুবিধার কারণে যদি অতিমাত্রায় অযোগ্য ব্যক্তি সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সুযোগ পান সেটা কোনোভাবেই দেশের জন্য ভালো হবে না। কোটা সুবিধা থাকতে পারে। তবে এটাও বিবেচনায় রাখতে হবে কোটা সুবিধার কারণে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে মেধাশূন্য হয়ে না পড়ে। কত শতাংশ কোটা সুবিধা রাখলে তা দেশের জন্য মঙ্গলজনক হবে তা নির্ধারণ করতে হবে। কোটা সুবিধা হয়তো ১০ শতাংশ রাখা যেতে পারে। অথবা প্রয়োজন মনে হলে ২০ শতাংশ বা ৩০ শতাংশ রাখা যেতে পারে। এ ব্যাপারে যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সমাজের সুবিধা বঞ্চিত শ্রেণিকে উঠে আসার সুযোগ দিতেই হবে। কিন্তু এটা করতে গিয়ে আবার সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে অযোগ্য কর্মীর ভারে ভারাক্রান্ত করা যাবে না। অবশ্যই মেধাকে প্রধান গুরুত্ব দিতে হবে। আমার বিবেচনায় ৭০ (বা ক) শতাংশ মেরিটের ভিত্তিকে এবং ৩০ (বা খ )শতাংশ কোটার ভিত্তিতে সরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের ব্যবস্থা নিয়ে ভাবা যেতে পারে। আদালতের হাতে এটা ছেড়ে দেওয়া ঠিক হবে না। বিশেষজ্ঞদের ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সমন্বয়ে গঠিত একটি টাস্কফোর্সকে এটা নির্ধারণের দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে ।
(অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)
 

 

Comments :0

Login to leave a comment