TMC INFIGHTING

'ভালো' প্রার্থী বাছাইয়ের ভোটেও ছাপ্পা, হাঙ্গামা!

রাজ্য জেলা

CPIM west bengal panchayat election TMC BJP BENGALI NEWS

জয়ন্ত সাহা ও অমিত দেব: দিনহাটা, মাথাভাঙা

দলের প্রার্থী নির্বাচনেও ভোট লুট করল তৃণমূল নেতা, কর্মীরা!

সোমবারই কোচবিহারের মন্দির থেকে বেরিয়ে অভিষেক ব্যানার্জি ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি ‘ভালো মানুষ’ খুঁজতে বেরিয়েছেন। ‘রক্তপাতহীন’ পঞ্চায়েত নির্বাচন তাঁর লক্ষ্য। গণতন্ত্রের জন্য মানুষই তৃণমূলের প্রার্থীদের বেছে নেবেন।


সেই ‘ভালো মানুষ’ সন্ধানের ভোট হয়েছে মঙ্গলবার। মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো কাছাকাছিই তখন ছিলেন। সেই ভোটে হাঙ্গামা করলেন তৃণমূল কর্মীরা। ভোটের ব্যালট ভরার বাক্সই ভেঙে গেল। উড়লো ব্যালট। হলো ভোট লুটও। এদিন সাহেবগঞ্জের ফুটবল মাঠ এবং গোসানিমারি হাইস্কুলের মাঠে প্রার্থী ঠিক করার গোপন ব্যালটে সেই ভোটকে ঘিরে ধুন্ধুমার অবস্থা হয়।

সাহেবগঞ্জ, গোসানিমারি ও শীতলকুচিতে এদিন প্রার্থী মনোনয়নের জন্য যাঁরা সভায় এসেছিলেন তাঁরা কেউই সাধারণ মানুষ নন, সবাই শাসকদলের কর্মী। তাঁরাই গত পঞ্চায়েত ভোটে বুথের পর বুথে বিরোধীদের দাঁড়াতে দেননি, দখল করেছিলেন পঞ্চায়েত।


সোমবার রাতে বামনহাটে ছিলেন তৃণমূলের অভিষেক ব্যানার্জি। এদিন বামনহাট থেকে বেরিয়ে সিতাইয়ের গোসানিমারি হাইস্কুলের সভার দিকে রওনা দিতেই প্রার্থী ঠিক করার ব্যালট বিলি শুরু হয়। শুরু হয় ব্যালট নিয়ে কাড়াকাড়ি আর মারামারি। ভোট দেওয়ার লাইনেও শুরু হয় ধাক্কাধাক্কি। 

যাঁরা ভোট নিচ্ছিলেন তাঁরা সামলাতে পারেননি। প্লাইউডের ভোটবাক্স ভেঙে যায়। দেখা যায় বাক্সের ভেতরে রয়েছে প্রচুর প্রার্থীর ও বুথের নাম লেখা চিরকুট। যাঁরা ভোট দিতে এসেছিলেন তাঁদের বক্তব্য, ‘ওই চিরকুট বাক্সের ভেতরে কী করে এল?’ সন্দেহ করা হচ্ছে ভোটের আগেই ভোট দিয়ে রেখেছিল শাসক গোষ্ঠীরই একাংশ।


বামনহাটের সভায় আসা তৃণমূলের বামনহাট-২ নং গ্রাম পঞ্চায়েতের ৭/১০৪ বুথের ভোটার মজনু শেখ, ৭/২২১ বুথের তৃণমূল কর্মী মহম্মদ আলম হোসেন মিঁয়া, ওই বুথেরই শাহজাহান শেখ বলেন, ‘‘আমরা ভোট দেওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছিলাম। ভোট দেওয়ার আগেই শুরু হয় ঝামেলা। আমাদের চোখের সামনেই দেখলাম যারা ভোট নেওয়ার দায়িত্বে ছিল তারা নিজেরাই ব্যালট বাক্স ভেঙে ফেললো। আমাদের আগে যারা ভোট দিয়েছিল তার থেকে বেশি ভোট ছিল বাক্সে। সম্ভবত আগেই পছন্দের প্রার্থীদের নামে ভোট দিয়ে রাখা হয়েছিল। বাক্স না ভাঙলে সেটা আমরা বুঝতেই পারতাম না।’’


অভিষেক ব্যানার্জি সিতাই পৌঁছেই শুনতে পান বামনহাটে ভোট বাক্স ভেঙে দিয়েছে দলের কর্মীরাই। তিনি গোসানিমারি হাইস্কুলের মাঠের সভা থেকে একটি ফোন নম্বর ঘোষণা করে বলেন, যাঁরা ভোট দিতে পারবেন না তারা যেন ওই নাম্বারে ফোন করে প্রার্থী  নির্বাচনের ভোট দেয়। 

বামনহাট ছিল মন্ত্রী উদয়ন গুহের নির্বাচনী এলাকা। স্বভাবতই অভিযোগ ওঠে ভোট কেলেঙ্কারির পেছনে রয়েছে তার অনুগামীরা। অন্যদিকে সিতাইয়ের গোসানিমারি বিধায়ক জগদীশ রায় বসুনিয়ার এলাকা। যার সঙ্গে আবার উদয়ন গুহর সম্পর্ক আদায়-কাঁচকলায়। 

গোসানিমারি থেকে অভিষেক ব্যানার্জির ক্যারাভ্যান বেরিয়ে যেতেই প্রার্থী নির্বাচনের ব্যালট বিতরণ শুরু হয়। সেখানেও এরপরেই শুরু হয় বিশৃঙ্খলা। মঞ্চ থেকে ব্যালট পেপার বিলি করা হচ্ছিল। সেই ব্যালট পেপার লুট করে নেয় একদল তৃণমূল কর্মী। মঞ্চে ও গোটা মাঠ জুড়ে তখন চরম বিশৃঙ্খলা শুরু হয়। এরই মধ্যে একদল তৃণমূল কর্মী মঞ্চে উঠে অপর পক্ষকে ধাক্কাধাক্কি করে মঞ্চ থেকে ঠেলে ফেলে দিতে শুরু করে। 

তৃণমূলের কর্মীদের রোষের হাত থেকে রেহাই পাননি সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরাও। বৈদ্যুতিন মাধ্যমের এক প্রতিনিধিকে মঞ্চ থেকে নিচে ফেলে দেওয়া হয়। যখন এই এসব চলছে তখন মঞ্চের ওপর মাত্র দু’জন পুলিশকর্মীকে অসহায়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। গোটা মাঠে আর কোনও পুলিশকর্মী ছিলেন না। বামনহাটের মাঠেও শাসকদলের কাজিয়ার সময় কোনও পুলিশকর্মীকে আশপাশে দেখা যায়নি।

 
শীতলকুচির দিকে রওনা দেওয়া অভিষেক ব্যানার্জির কাছে এই খবর পৌঁছাতেই তিনি শীতলকুচির জনসভার মাঠে না ঢুকে সোজা চলে যান সেখানকার দলীয় অফিসে। সেখান থেকে প্রায় আধ ঘণ্টা পরে জনসভার মাঠে গিয়ে বক্তব্য রাখার সময় ঘোষণা করেন, ‘গোসানিমারির প্রার্থী নির্বাচনের ভোট বাতিল করা হলো।’ বৃহস্পতিবার ফের ওই স্কুলের মাঠে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত ভোট হবে। মঞ্চ থেকেই তিনি পুলিশকে নির্দেশ দেন বৃহস্পতিবার ভোট যেন শান্তিপূর্ণ হয় সেটা দেখতে।


একজন সাংসদ এভাবে দলীয় সভার মঞ্চ থেকে দলীয় ভোটে পুলিশকে নির্দেশ দিতে পারেন কিনা সে নিয়েও প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। এদিকে গোসানিমারি হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক তৃণমূল শিক্ষা সেলের নেতা। তিনি এদিন নাম ডেকেই স্কুল ছুটি দিয়ে দেন। ফের বৃহস্পতিবার ওই স্কুলের মাঠে ভোট হলে স্কুল বন্ধ থাকবে। 

শীতলকুচির জনসভায় অভিষেক ব্যানার্জি বলেন, ‘‘আমি জানতাম কোথায় কোথায় দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে এরকম হতে পারে। আমি জানি কোথায় সন্ত্রাস হতে পারে। যদি কেউ ভাবে গায়ের জোরে ভাবে আমরা ব্যালট বাক্স ভেঙে নিজের গোষ্ঠীর প্রার্থী করব, তবে তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছে।’’ মোদীর ঢঙে তিনি নিজেকে পাহারাদার বলে উল্লেখ করেন।


যুবরাজ শীতলকুচি থেকে মাথাভাঙার উদ্দেশ্যে রওনা হতেই শীতলকুচিতে ভোটের মাধ্যমে প্রার্থী নির্বাচন। এখানে ব্যালট পেপার সবাই পেলেন না। ব্যালট পেপারের গোছা চলে গেল অঞ্চলের সভাপতির অনুগামীর হাতে। তিনিই পছন্দের লোকদের দিয়ে ভোট দেওয়ালেন। মাঠে অনেককেই বলতে শোনা গেল, ‘‘আমাদের ভোট দিতেই দেওয়া হলো না। পেলাম না ব্যালট পেপারও!’’

সিপিআই(এম) কোচবিহার জেলা সম্পাদক অনন্ত রায় বলেন, ‘‘এদের নবজোয়ারের প্রথম দিনেই বাংলার মানুষ বুঝলো দলে কোনও গণতন্ত্রের নাম গন্ধ নেই। আসলে তৃণমূলের শেষের সময় এসে গেছে।’’
 

Comments :0

Login to leave a comment