দুপুর থেকেই তুমুল বৃষ্টি দুর্গাপুরে। টানা প্রায় দু’ঘন্টা। বৃহস্পতিবারই দুর্গাপুরের দু’প্রান্ত থেকে দু’টি মিছিলের ডাক দিয়েছিল সিপিআই(এম)। বর্ধমান-দুর্গাপুর লোকসভা কেন্দ্রের প্রার্থী সুকৃতী ঘোষালের সমর্থনে। তার মদ্যে বিধাননগর থেকে মিছিলে নেতৃত্বে ছিলেন সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির সদস্য মীনাক্ষী মুখার্জি।
টানা বৃষ্টির পর সংশয় ছড়াচ্ছিল আদৌ মিছিল হবে কিনা। বৃষ্টি খানিক ধরতেই জমতে শুরু করল একে একে মুখ। মুখ থেকে সারি। হাতে লাল ঝান্ডা। লাল বেলুনও। আর এসেছে রণ-পা নৃত্যের শিল্পীগোষ্ঠী।
এই কেন্দ্রে দুর্গাপুরের দু’টি বিধানসভার পাশাপাশি পূর্ব বর্ধমানের পাঁচটি বিধানসভাও রয়েছে। সর্বত্র চলছে প্রচার। সিপিআই(এম) পশ্চিম বর্ধমান জেলা সম্পাদকমন্ডলীর সদস্য পঙ্কজ রায় সরকার জানালেন বিধাননগর থেকে মিছিল যাবে বেশ দূরে। তার মধ্যে কিছু এলাকায় সন্ত্রাস চালিয়েছে তৃণমূল। তবু যাবে।
দুর্গাপুরেও শেষ পৌর নির্বাচনে ভোট দিতে পারেননি মানুষ। অবাধে গণতন্ত্র হত্যা নিয়ে ক্ষোভ রয়েছে চা-দোকানে, বাস বাসস্ট্যান্ডের গল্প গুজবে। আপাত বিচারে শহর শান্ত। কে বলবে ১৩ মে ভোট এই কেন্দ্রে। প্রার্থীদের নাম নিয়ে বড়বড় ব্যানার হোর্ডিং নেই তেমন। তবে বহু জায়গায় রয়েছে হনুমানের ছাপ দেওয়া পতাকা।
শিল্পশহর দুর্গাপুর। ভূগোল বইয়ে এ রাজ্যে স্কুলেই জানতে পারে ছাত্রছাত্রীরা দুর্গাপুর, বার্নপুর, কুলটি, আসানসোলের কথা। উদারনীতির চালু হওয়ার পর থেকে দীর্ঘ সময়েরই প্রবণতা সরকারি কারখানা বন্ধ হওয়া, অথবা বেচে দেওয়ার ব্যবস্থা করা। নরেন্দ্র মোদীর মেয়াদে দশ বছরে এই প্রবণতা তীব্র মাত্রা নিয়েছে, বলছেন বাসিন্দারাই।
বর্ধমান দুর্গাপুর কেন্দ্রে প্রচার শেষ হচ্ছে শনিবার। গত নির্বাচনে এখানে জয়ী হয়েছিল বিজেপি। তবে প্রার্থী বদলেছে। সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়ার বদলে দলের প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ প্রার্থী এবার।
দুর্গাপুর শহরের কেন্দ্র সিটি সেন্টারের চারপাশে ত্রিকোণ লাল পতাকা লাগানো, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যেমন দেখা যাচ্ছে। দুর্গাপুরে প্রচারে এসে দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ। বলেছেন, দিলীপ ঘোষ জিতলে খুলে যাবে কারখানার দরজা।
এমন ঘোষণায় প্রশ্ন তুলেছেন সব অংশের শ্রমিক কর্মচারীরা। সিপিআই(এম)’র প্রচারে বড় বিষয় বন্ধ কলকারখানা। অ্যালয় স্টিল প্ল্যান্টের বিলগ্নির চেষ্টা রুখেছে শ্রমিক কর্মচারীদের একজোট লড়াই। এই আন্দোলন কারখানার জন্য বাম প্রা্থীকে জয়ী করার ডাক দিয়ছে । দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টকে উৎপাদন করছে হচ্ছে ক্ষমতার চেয়ে অনেক কম মাত্রায়। বন্ধই রয়েছে এমএএমসি। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার সার কারাখানা চালু করেনি।
বড় কারখানা, রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা বন্ধ হওয়ায় ছোট বা মাঝারি বেসরকারি কারখানাও বন্ধ হয়েছে অনেক। শিল্পাঞ্চলে অন্যতম প্রবণতা হলো, ঠিকায় কাজ করানো। এমনই একটি বেসরকারি ইস্পাত কারখানায় ৬০০ শ্রমিকের মধ্যে মাত্র ২৮ জন স্থায়ী। কেননা ডিএসপি’র মতো সরকারি উদ্যোগ চালানো হচ্ছে ৬ হাজার ঠিকা শ্রমিক দিয়ে। শ্রমিক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ মনে করাচ্ছেন, বারবার কারখানায় দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন এই ঠিকায় কাজ করা সবচেয়ে অসুরক্ষিত শ্রমিকরা। খুলে আম শ্রমিকের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।
কারখানা খোলার চেষ্টা করেনি রাজ্যের তৃণমূল সরকারও। দুর্গাপুর কেমিক্যালস বন্ধ। সংসদে তৃণমূল সাংসদরাও বা কতবার রাজ্যের শিল্পনগরীকে শুকিয়ে মারার চেষ্টার বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন? কতবার কারখানা বন্ধের বা বিলগ্নি নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা হয়েছে? এই প্রশ্ন কেবল সিপিআই(এম) তুলছে।
তৃণমূল ঠিকা শ্রমিক নিয়োগেও জোরজুলুমে হাত পাকিয়েছে। একেবারে মাথা না নোয়ালে কাজ বন্ধ। প্রতিবাদ দেখলেই কেড়ে নেওয়া হচ্ছে কাজ। শ্রমিক অসুরক্ষিত হলে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টায় রয়েছে বিজেপি এবং তৃণমূল দু’পক্ষই।
সিপিআই(এম) নেতৃবৃন্দ বলছেন, বর্ধমান-দুর্গাপুর কেন্দ্রে গ্রামে বা শহরে কাজ বন্ধ করার রাজনীতিকে চিনিয়ে দেওয়া গিয়েছে। সে কারণে অমিত শাহকে দশ বছর পর কারখানা খোলার প্রতিশ্রুতি দিতে হচ্ছে। কিন্তু এত সহজে ফাঁকি দেওয়া যাবে না। জবাব দেবে জনতা।
সেই স্লোগানই উঠেছে শহরের আরেক প্রান্তে বেনাচিতির মিছিলেও। এই মিছিলে অংশ নিয়েছেন প্রাক্তন বিধায়ক বিপ্রেন্দু চক্রবর্তী, সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির সদস্য দেবাশিস চক্রবর্তী, পশ্চিম বর্ধমান জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য পার্থ দাস প্রমুখ। অংশ নেন বহু মানুষ। মহিলা এবং কমবয়সীদের উপস্থিতি ছিল বড় সংখ্যায়। সোচ্চার ছিল শ্রমজীবী জনতা।
Comments :0