দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতির বাসভবনে নগদ ভরা বস্তা উদ্ধারে প্রশ্নের মুখে পড়ছে শীর্ষ আদালতও। সুপ্রিম কোর্ট ঘটনার পরপরই কী ব্যবস্থা নিয়েছিল তা স্পষ্ট নয়। বরং প্রাথমিকভাবে বিষয়টি গুজব বলা হয়েছিল শীর্ষ আদালতের ওয়েবসাইটে। পরে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়ে পড়ার পর সাময়িক ব্যবস্থা ঘোষণা করেছে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি।
গত ১৪ মার্চ হোলির দিন দিল্লি হাইকোর্টের বিচারপতি যশবন্ত ভার্মার দিল্লির বাসভবন থেকে উদ্ধার হয় বস্তাবন্দি নোট। প্রায় ১৭ ঘণ্টা পর, ১৫ মার্চ, দিল্লির পুলিশ কমিশনার বিষয়টি জানান দিল্লি হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে। প্রধান বিচারপতি ডিকে উপাধ্যায় সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নাকে ছবি ও ভিডিও দিয়ে বিষয়টি জানান। কিন্তু ২১ মার্চও সুপ্রিম কোর্ট দাবি করে বিষয়টি ঘিরে ‘গুজব’ ও ‘বিভ্রান্তি’ ছড়াচ্ছে। এর পর সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতি ভার্মাকে তাঁর পুরানো কর্মস্থল এলাহাবাদ হাইকোর্টে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। তার প্রতিবাদে কর্মবিরতিতে শামিল হয়েছে এলাহাবাদ হাইকোর্টের বার অ্যাসোসিয়েশন। মঙ্গলবার দিল্লি হাইকোর্ট পরপর দু’টি নির্দেশিকা জারি করে জানায় যে আপাতত এই বিচারপতিকে বিচারের দায়িত্ব দেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু বিচারব্যবস্থার এমন পদক্ষেপে অস্বচ্ছতার অভিযোগ যথেষ্ট জোরালো। অতীতে একটি ব্যাঙ্ক তছরুপ মামলায় জড়িয়েছিল এই বিচারপতির নাম। তখন এলাহাবাদ হাইকোর্ট বলেছিল এই ঘটনা বিচারব্যবস্থার বিবেকে ধাক্কার সমান। সিবিআই তদন্তেরও নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু তদন্ত আটকে গিয়েছিল শীর্ষ আদালতেরই নির্দেশে।
২০১৮-তে ওই চিনিকল সংস্থা ‘সিমভাওলি সুগার মিল’-র বিরুদ্ধে জালিয়াতির তদন্তে নেমেছিল সিবিআই। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক ওবিসি’র অভিযোগের ভিত্তিতে শুরু হয় তদন্ত। ওবিসি’র অভিযোগ, ৫ হাজার ৭৬২টি কৃষককে বীজ ও সার কেনার জন্য ২০১২ সালে ১৪৮.৫৯ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। ঋণের জামিনদার হয় ওই সিমভাওলি সুগার মিল। যার নন এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর ছিলেন বিচারপতি যশবন্ত ভার্মা। দেখা যায় ভুয়ো পরিচয় দাখিল করেছে সংস্থা। ঋণগ্রাহকদের অনেককে খুঁজেই না পাওয়ায় লোপাট হয় ৯৭.৮৫ কোটি টাকা। ২০২৩-এ ফের এই মামলায় এলাহাবাদ হাইকোর্ট বলে যে বিচারব্যবস্থার বিবেক নাড়িয়ে দিয়েছে ঘটনাক্রম। তদন্ত নতুন করে শুরু করার নির্দেশও দেয়। সিবিআই নতুন করে তদন্তে নামে ২০২৪’র গোড়ায়। কিন্তু সেই তদন্তের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করে সুপ্রিম কোর্ট। এই রায় নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
ঘটনা ঘিরে প্রতিক্রিয়া সব অংশে একরকম নয়। সাধারণ জনমত বিচারবিভাগের স্বচ্ছতার পাশাপাশি তার স্বাধিকারের পক্ষেও। কিন্তু বিচারপতির ভার্মার ঘটনার উল্লেখ করে জাতীয় বিচারবিভাগীয় নিয়োগ সংক্রান্ত আইনের প্রসঙ্গ তুলেছেন। ২০১৪’র এই আইন সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে ২০১৫-তে। সুপ্রিম কোর্ট এবং হাইকোর্টে নিয়োগ করে সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন কলেজিয়াম। মোদী সরকারের মেয়াদে বিভিন্ন সময়ে কলেজিয়ামের সুপারিশ আইনমন্ত্রক ফিরিয়ে দিয়েছে একেবারেই রাজনৈতিক কারণে। নিয়োগ ঘিরে অচলাবস্থা হয়েছে।
রাজ্যসভার চেয়ারম্যান এবং উপরাষ্ট্রপতি জগদীপ ধনকড় বলেছেন ওই আইন পাশ হলে বিচারপতি ভার্মার মতো ঘটনা ঘটত না। তাঁর আরও অভিমত, রায়ে সংসদের স্বাধিকার ক্ষুণ্ণ হয়েছে। বিচারপতি নিয়োগ কলেজিয়ামের হাতেই থাকবে নাকি বিচারব্যবস্থার সংবিধানসম্মত স্বাধিকার অক্ষুণ্ণ রেখে আরও গণতান্ত্রিক পদ্ধতি খোঁজা হবে তা নিয়ে আলোচনা নিশ্চয় দরকার। কিন্তু প্রশ্ন উঠবে যে এই সুযোগে কেন্দ্র বিচারবিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করার আরও কোনও রাস্তা খুঁজছে কি না। সংসদে বিরোধীদের বলতে না দেওয়ার অভিযোগ প্রবল। প্রধানমন্ত্রী ইচ্ছা মতো সংসদকে অগ্রাহ্য করছেন, এমন দৃষ্টান্তেরও অভাব নেই। বিচারপতির বেনিয়ম ঘিরে এই অভিযোগে সুপ্রিম কোর্ট দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে বিপদ বড় চেহারা নেবে।
Editorial
বিচারপতির বিচার

×
Comments :0