CPI(M)

লাল ঝান্ডার প্রার্থী হওয়ায় কাজ ‘খেয়ে’ নিলেও,
লড়াই ছাড়েননি বাবলুদা-রবি

রাজ্য পঞ্চায়েত ২০২৩

CPIM west bengal panchayat election TMC BJP

রণদীপ মিত্র: ইলামবাজার 

বিরোধিতার খেসারত। তৃণমূলের রোষে ‘দু-আনার’ কাজ থেকেও উৎখাত বাইশ থেকে বাহাত্তর! 
উদাহরণ, ইলামবাজারের বাহাত্তর বছরের বাবলুদা, মহম্মদবাজারের বছর বাইশের রবি। দুজনেই প্রার্থী পঞ্চায়েতে। তৃণমূলের চোখে চোখ রেখেই লড়ছেন তাঁরা।


যথেচ্ছ হুমকি, শাসানি টলাতে পারেনি বছর বাহাত্তরের প্রবীর রাহাকে। ইলামবাজার এক ডাকে যাঁকে চেনে ‘বাবলুদা’ বলেই। কারণ ইলামবাজারের বুকে প্রথম অটো নামিয়ে ছিলেন এই বাবলুদা। গাঁ গঞ্জের মানুষের রাতবিরেতে বাড়ি পৌঁছে যাওয়ার ভরসা ছিলেন বাবলুদাই। তিনিই এবার লাল ঝান্ডার প্রার্থী ইলামবাজার গ্রাম পঞ্চায়েতে। 


অটো নেই বছর দশেক হলো। স্ত্রীর ক্যানসারের চিকিৎসা করাতে গিয়ে হয়েছিলেন সর্বস্বান্ত। দেনা মেটাতে বেচতে হয় সাধের অটো। তারপর নিঃসন্তান বাবলুদা ভাইপোর আশ্রয়ে। দু-বেলা ভাত দেন ভাইপো। 

কিন্তু বাকি খরচ? নিজের হাই সুগার। আরও নানা উপসর্গ নিয়ে দিন কাটাচ্ছেন তিনি। অগত্যা কাজ নিয়েছিলেন ইলামবাজারের এক ওষুধের দোকানে। বাবলুদা ওরফে প্রবীর রাহার কথায়, ‘‘ভাইপোর কাছে খাই। ওষুধের দোকান থেকে যা পাই তা নিজের ওষুধ কিনতেই চলে যায়। ডাক্তারবাবুরা কখনও কখনও দু-একশো টাকা দেন। আজ সে কাজও চলে গেল।’’ 


কাজ চলে গেল কারণ, বাবলুদা সিপিআই(এম)’র প্রার্থী হয়েছেন। তৃণমূল জায়গিরে পরিণত করেছে ইলামবাজারকে। সেখানে থাকবে বিরোধী প্রার্থী! তাও আবার লাল ঝান্ডার। মানতে পারেনি তৃণমূল। তাই মনোনয়ন জমা করতেই হুমকি গিয়েছে বাবলুদার কাছে। বাবলুদা বুদ্ধি করে ফোনটাই দিয়েছিলেন বন্ধ করে। আজও খোলেননি। জেদ নিয়েছিলেন, যাই হোক মনোনয়ন তুলবেন না। তোলেননি। কাজ হয়নি দেখে তৃণমূল হয়েছে আরও নির্লজ্জ। বাবলুদার মালিককে দিয়েছে হুমকি, ‘বাবলু যেন আর কাজে না আসে’।

বাবলুকে অপত্য স্নেহ করা বেচারা মালিকেরই বা কী করার ছিল? বাবলুদা নিজেই বন্ধ করে দিয়েছেন দোকানে যাওয়া। দুশ্চিন্তা আর জেদের মিশেলে নতুন বাবলুদা এখন ভোটের ময়দানে। প্রচার শুরু করেছেন। তার মাঝেই জানিয়েছেন,‘‘জানি এখন আমার খরচটুকুর জোগান হবে না। তবুও মাথানত করব না। কী হবে? মরব। কিন্তু কেউ বলতে পারবে না বাবলু হেরে মরেছে।’’ 

বীরভূমের গত পাঁচ বছরের সভাধিপতি, ইলামবাজার থেকেই জেলা পরিষদের প্রার্থী তৃণমূল নেতা বিকাশ রায়চৌধুরি দাবি করেন,‘‘এটা সিপিএম-র অপপ্রচার। তৃণমূল কখনও কারও পেটে লাথি মারে না।’’


জেলার একপ্রান্ত যখন বাহাত্তরের বৃদ্ধের জেদের সাক্ষী হয়েছে, একই রকম প্রত্যয়ী মেজাজ অপরপ্রান্ত মহম্মদবাজারের লোহাবাজারে। সেখানে বছর বাইশের কলেজ পড়ুয়া রবি বায়েনও মনোনয়ন টিকিয়ে রেখেছেন পঞ্চায়েত সমিতিতে। এসএফআই’র সক্রিয় কর্মী। বছর চারেক হলো বাবাকে হারিয়েছেনে। অসহায় মাকে নিয়ে দিনগুজরান হতদরিদ্র ছাত্রের। পড়তে পড়তেই বেছেছেন টিউশনির পেশা। 

কিন্তু তাতে চলে না আর। একটু বাড়তি রোজগারের জন্য এক উকিলের কাছে মুহুরির কাজের আরজি জানিয়েছিলেন। কাজ পাকা হয়ে গিয়েছিল। 
তারপর কী হলো? 

রবি বায়েনের কথায়,‘‘যেই শুনল আমি সিপিএম করি, ব্যস। ওমনি বলে দিলেন কাজ দেওয়া যাবে না। তৃণমূল করলে কোনও অসুবিধা ছিল না।’’ 

নির্লজ্জতা আর এক নজির শাসক দল রেখেছে সামান্য মুহুরির কাজ খেয়েও। নুন আনতে পান্তা ফুরানো পরিবারের যুবকের বরং জেদ তাতে বেড়েছে। 

মনোনয়ন দাখিলের পরই অসহায় মায়ের কাছে চড়াও হয়েছিল শাসকের বাহিনী। হুমকি সেই একই, ‘মনোনয়ন না তুললে, ফল খুব খারাপ হবে’। মা ভয় পেয়েছিলেন। ছেলে আশ্বস্ত করেছে, যা হয় দেখা যাবে। 

কেন এত প্রতিকূলতার মধ্যেও লাল ঝান্ডার প্রার্থী হলেন? 

উত্তরে স্নাতক পর্যায়ের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আবেতাড়িত কণ্ঠে জানান, ‘‘ধানমাঠে ধুলো মেখে কাজ করতে করতে বাবার শ্বাসকষ্টের রোগ ধরেছিল। এখানে কিছু হয়নি। সিউড়ি নিয়ে গিয়েছিলাম। চিকিৎসা যেটুকু পেরেছিলাম করিয়ে ছিলাম। সত্যি কথা বলতে, পয়সার জন্য ভালো জায়গায় নিয়ে যেতে পারিনি। বাবার মুখটা এখনও ভেসে ওঠে থেকে থেকেই। তাই আমাদের মতো অসহায় ছেলে-মেয়েরা ভালো পরিবেশ পাক। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর মাটি শক্ত করুক, এই আমার লক্ষ্য।’’  

Comments :0

Login to leave a comment