অনিল কুণ্ডু: জয়নগর
সন্দেশখালির লড়াইয়ের পাশে থাকতে চায় জয়নগরের দলুয়াখাকি। সন্দেশখালিতে তৃণমূলের লুম্পেন বাহিনীর সন্ত্রাসে দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া গ্রামের মহিলারা ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। ঘৃণার আগুন জ্বলছে। অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে কিভাবে সাহসের সঙ্গে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হয় সেই পথ দেখিয়েছে অত্যাচারিত জয়নগরের দলুয়াখাকিও। তৃণমূল, পুলিশি সন্ত্রাস, অত্যাচারের বিরুদ্ধে সর্বস্ব হারানো দলুয়াখাকি গ্রামের মহিলারা ঐক্যবদ্ধভাবে রুখে দাঁড়িয়েছেন। প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। ঘুরে দাঁড়িয়েছে সেই দলুয়াখাকি গ্রাম। প্রতিরোধ করেই এখন স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ফিরেছেন গ্রামের বাসিন্দারা। তবে সেই দুর্বৃত্তরা এখনও গ্রেপ্তার না হওয়ায় প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা। তাঁদের কথায়, এফআইআর করা সত্ত্বেও মূল অভিযুক্ত গফ্ফার মোল্লা সহ দুষ্কৃতীরা আর কবে গ্রেপ্তার হবে?
পড়ন্ত বিকেল। নিস্তব্ধ দলুয়াখাকি গ্রামে ছুটে বেড়াচ্ছে শিশুরা। এখনও ধ্বংসস্তূপের চিহ্ন গোটা গ্রাম জুড়ে। তৃণমূলের সশস্ত্র দুষ্কৃতী বাহিনী পরিকল্পিতভাবে আক্রমণ চালিয়েছে গোটা গ্রামে। বেছে বেছে সিপিআই(এম) কর্মী, সমর্থকদের বাড়িতে চড়াও হয়ে আক্রমণ সংগঠিত করেছে। বাড়িঘর ভাঙচুর, নির্বিচারে লুটপাটের পর অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়েছে। আগুনে দাউদাউ করে জ্বলে সবকিছু পুড়ে খাক হয়েছে। সব কিছুই চোখের সামনে দেখেছেন গ্রামের আবাল বৃদ্ধবণিতারা। তাঁরা দেখেছেন তৃণমূলী সন্ত্রাসের ভয়াবহ চেহারা। তৃণমূলের দুষ্কৃতী, পুলিশের যৌথ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধও গড়ে তুলেছেন ঐক্যবদ্ধ মহিলারাই। গত ১৩ নভেম্বরের সেই বর্বরোচিত ঘটনার পর গ্রাম ছেড়েছেন আক্রান্ত পরিবারের পুরুষরা। দলুয়াখাকির মহিলাদের প্রতিরোধ, লড়াইয়ের বার্তা ছড়িয়েছে গোটা রাজ্যে। এখনও সেই ঘটনার ইনসাফ চায় দলুয়াখাকি।
সন্দেশখালির অত্যাচারের ঘটনায় তৃণমূলের সেই সন্ত্রাসের কথা মনে পড়ছে দলুয়াখাকি গ্রামের আক্রান্ত মহিলাদের। সৈরফ বিবি, আমিনা লস্কররা এদিন ফের বললেন ঘটনার কথা। গত বছরের অভিশপ্ত ১৩ নভেম্বর। জয়নগরের বামনগাছি অঞ্চলের বাঙালবুড়ির মোড়ে তৃণমূলের অঞ্চল সভাপতি সইফুদ্দিন লস্কর খুন হয়। ঘটনাস্থল থেকে প্রায় ৪ কিলোমিটার দূরে দলুয়াখাকি গ্রামে পুলিশের উপস্থিতিতে তৃণমূলের সশস্ত্র বাহিনী হামলা, আক্রমণ করে। তাঁদের কথায়, প্রতিদিনের মতোই ঘুম থেকে উঠে সকালে যে যার ঘরের কাজ করছিলাম। আচমকা আক্রমণ। অশ্রাব্য গালিগালাজ, মানুষের হই হট্টগোলে শিশু কোলে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে দেখি পুলিশ, তৃণমূলের সশস্ত্র দুষ্কৃতীরা গ্রামে আক্রমণ করেছে। প্রাণ বাঁচাতে ঘরের পুরুষ মানুষেরা যে যার মতো দৌড় দিল। ঘরে ঢুকে নির্বিচারে লুটপাট চলালো। গবাদি পশু পর্যন্ত লুট করে নিয়ে যাচ্ছে। একটার পর একটা বাড়ি ঘর ভাঙচুর করল। এভাবে ৩১টি বাড়ি ভেঙে দেওয়া হলো। দরকারি কাগজপত্র, জমির দলিল। ওরা সবকিছু পুড়িয়ে দিয়েছে। শিশুদের পাঠ্যপুস্তকও বাদ দেয়নি। পরণের পোশাক ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না। পুরুষ শূন্য গ্রাম। খোলা আকাশের নিচে শীতের ঠান্ডায় দিনের পর দিন রাত কাটাতে হয়েছে। ভয়ঙ্কর এই সন্ত্রাসের খবর বাইরের মানুষ যাতে জানতে না পারে তারজন্য গ্রামে ঢোকার মেইন রাস্তার মুখে প্রায় ১ কিলোমিটার দূরে গুদামের হাট মোড়ে জয়নগর থানার পুলিশ ব্যারিকেড করে পথ আটকায়। এমনকি ত্রাণ সামগ্রী নিয়ে আসা মানুষদেরও ফিরিয়ে দেওয়া হয় গুদামের হাট মোড় থেকে। দিনের পর দিন পুলিশ নজরদারি চালিয়েছে রাস্তায়, গ্রামে। তরপরও গ্রামে অব্যাহত ছিল দুষ্কৃতীদের হুমকি। ঘটনার কথা বলতে বলতে শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছে নিয়ে আসিদা, মনোয়ারা জাহানারা লস্কররা বললেন, প্রতিরোধই একমাত্র বাঁচার রাস্তা। এই ভাবনায় তারপর আমরা গ্রামের মহিলারা সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিরোধ শুরু করি।
ঘটনার পর প্রায় সাড়ে ৩ মাস পেরিয়েছে। ভেঙে যাওয়া ঘর মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। ঘরের মাথায় ছাউনি উঠেছে। নিজেদের জীবন জীবিকায় ফিরেছেন দলুয়াখাকির আক্রান্ত পরিবারের মানুষেরা। ছন্দে ফিরেছে গ্রাম। এখনও সেই ভয়াবহ সন্ত্রাসের চিহ্ন গোটা গ্রামে। গ্রামের মহিলাদের সাহস আর প্রতিরোধে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দলুয়াখাকি গ্রাম।
তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতী বাহিনীর সন্ত্রাস, অত্যাচার আর পুলিশি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন সন্দেশখালির মহিলারা। এই প্রতিরোধের আগুন একদিন গোটা রাজ্যে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বে। এমনটাই মনে করেন দলুয়াখাকি গ্রামের বাসিন্দা জাহানারা লস্কর, আমিনা বিবি, আসিদা বিবি, মনোয়ারা লস্কররাও। তাঁদের কথায়, অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে একমাত্র বাঁচার রাস্তা ঐক্যবদ্ধ লড়াই, প্রতিরোধ আর প্রতিরোধ।
Comments :0