‘সমাজতন্ত্র’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দ দু’টিতে আরএসএস’র ভীষণ রকমের অ্যালার্জি। শব্দ দু’টি তারা কোনও অবস্থাতেই সহ্য করতে পারে না। তাই সুযোগ পেলেই সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে সরব। আরএসএস যখন রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিল না তখন একেবারে সরাসরি তাদের মতাদর্শগত অবস্থান সোচ্চারে প্রকাশ করত। কারণ তখন তাদের ক্ষমতা হারানোর আতঙ্ক ছিল না। কিন্তু এখন তারা রাষ্ট্র ক্ষমতায়। তাই অনেক কথাই তাদের কিছুটা রেখেঢেকে বলতে হয়। পাছে মানুষ বিরক্ত হয়ে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে না দেয়। তথাকথিত হিন্দুত্ববাদের মূল সংগঠন আরএসএস। ভারতে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা তাদের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা। সেই অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নের দায়িত্ব তাদেরই রাজনৈতিক শাখা বিজেপি’র। আরএসএস’র মূল অ্যাজেন্ডা রাজনৈতিক হলেও তারা নিজেদের অরাজনৈতিক খোলসের মধ্যে ঢেলে রাখে। তাছাড়া তাদের বেশিরভাগ দাবি, অবস্থান ভারত রাষ্ট্রের চরিত্র ও তার সাংবিধানিক ব্যবস্থার বিপরীত বিন্দুতে অবস্থান করে। এই অবস্থায় পদে পদে যাতে রাষ্ট্র বিরোধিতার তীর তাদের দিকে তাক না হয় তাই নিজেদের যথাসম্ভব আড়াল করার চেষ্টা করে। এখন ক্ষমতায় থাকার ফলে অনেক সতর্কতার সঙ্গে কৌশলে নিজেদের কাজ হাসিল করার চেষ্টা করছে।
আরএসএস ভারতকে হিন্দুদের দেশ বলে মনে করে। হিন্দুরাই হবে এদেশের প্রথম শ্রেণির নাগরিক। অন্য ধর্মের কেউ ভারতে থাকতে হলে হিন্দু ধর্মীয় সংস্কারের আধারে নিজেদের মানিয়ে নিতে হবে। থাকতে হবে দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসাবে। ধর্ম ও রাষ্ট্রের মধ্যে কোনও বিভাজন রেখা মানে না আরএসএস। হিন্দু ধর্মীয় সংস্কার-কুসংস্কারের জালে বন্দি থাকবে রাষ্ট্র। তাই ধর্মনিরপেক্ষতা তাদের চোখের বিষ। ধর্ম নিরপেক্ষতা ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে। রাষ্ট্রের উপর কোনও ধর্মের প্রভাব থাকবে না। ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত পরিসরে ও ধর্মস্থানে সীমাবদ্ধ থাকবে। ধর্ম নিরপেক্ষতা সব ধর্মকে সমান চোখে দেখে। সব ধর্মাবলম্বীরাই সমানাধিকার ভোগ করেন। কিন্তু আরএসএস হিন্দু ছাড়া অন্য কোনও ধর্মকে মান্যতা দেয় না, স্বীকারও করে না। ভারতকে যদি তাদের কাঙ্ক্ষিত হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করতে হয় তাহলে সবার আগে ধর্মনিরপেক্ষতার ধারণাকে বর্জন করতে হবে এবং সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতা শব্দটিকে উৎখাত করতে হবে।
‘সমাজতন্ত্র’ শব্দের মধ্যে লুকিয়ে আছে আর্থ-সামাজিক ভাবনার অনন্ত গভীরতা। একদিকে সামাজিক ন্যায়ের প্রণোদনা যেমন জাগায় এই শব্দ, তেমনি আর্থিক সাম্য ও ন্যায়ের ভাবনাও উসকে দেয়। আর এই জায়গাতেই সর্বাধিক ভয় আরএসএস’র। আরএসএস কমিউনিজম দূরের কথা সমাজতান্ত্রিক ভানাকে তাদের চিন্তায় জায়গা দিতে রাজি নয়। তেমনি সমাজে শ্রেণি বৈষম্যকে আড়ালে রাখতে চায় ধর্মের অন্ধ বিশ্বাসের মোহ দিয়ে। জন্মান্তর, কর্মফল, মোক্ষলাভ ইত্যাদি ধর্মান্ধতায় মানুষকে ডুবিয়ে রেখে শ্রেণি সংগ্রাম, ন্যায়ের সংগ্রাম, অধিকারের সংগ্রামকে স্তব্ধ করতে চায়। আরএসএস বুর্জোয়া তথা পুঁজিবাদী রাজনৈতিক দর্শনের অতি দক্ষিণ পন্থার শরিক। পুঁজির শোষণকে তারা শুধু প্রসারিত করতে চায় না, তারা চায় একচেটিয়া পুঁজিবাদ তথা পুঁজির অতি কেন্দ্রীভবন। যার অনিবার্য পরিণতি সমাজে অসাম্যের ভয়াবহতা। এর বিপরীতে সমাজতান্ত্রিক ভাবনা শোষিত শ্রমজীবী মানুষের অধিকারবোধ জানায়, লড়াইয়ে প্রাণিত করে। সমাজতন্ত্র পুঁজির কেন্দ্রীভবনের বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করে, সমাজে সমতার স্বপ্ন দেখায়। তাই আরএসএস সমাজতন্ত্র সহ্য করতে পারে না। আরএসএস সম্পাদক সেজন্য সংবিধান থেকে সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ শব্দ দু’টি বাদ দেবার দাবি করেছেন। কিন্তু ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বাধীন ভারতের আত্মপ্রকাশ, গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে চলার ছত্রে ছত্রে মিলে মিশে একাকার হয়ে আছে শব্দ দুটি। এগুলি বাদ দেবার সাধ্য কারও নেই।
Editorial
আরএসএস’র অ্যালার্জি

×
Comments :0