Social Media

লড়াই চলছে সোশাল মিডিয়াতেও

ফিচার পাতা

শুদ্ধসত্ব গুপ্ত

ডোনাল্ড ট্রাম্প খুলেছেন নিজের সোশ্যাল মিডিয়া ‘ট্রুথ সোশাল’। বিশ্বের ধনীতম ব্যক্তি এলন মাস্ক এখন পুরোদমে আরেক সোশ্যাল মিডিয়া সংস্থা টুইটারের মালিক। ব্রিটিশ সংবাদপত্র ‘গার্ডিয়ান’-এর একটি নিবন্ধে খুঁজে দেখা হয়েছিল বিশ্বের অতি ধনীরা সোশাল মিডিয়ার মালিকানার পেছনে ছুটছেন কেন। 
উত্তরের জন্য যদিও পশ্চিমী সংবাদমাধ্যমের পিছনে ছুটতে হবে না। আমাদের দেশের দিকে তাকালেই বোঝা যাবে। কারণ, সোশাল মিডিয়া ভাষ্য নির্মাণের কাজ করছে।  
একটি ডাহা মিথ্যা ছড়ানো হলো। দিল্লির সরকারের বিজ্ঞাপনে, সোশাল মিডিয়ায় সঙ্ঘ পরিবারের একগুচ্ছ ‘অ্যাকাউন্ট’, ‘পেজ’ বা ‘হ্যান্ডেল’ থেকে। বলা হলো, জি-টোয়েন্টি বৈঠকের আয়োজক হওয়ার সম্মান ভারত আদায় করল নরেন্দ্র মোদীর প্রধানমন্ত্রিত্বে। এই স্বীকৃতি বুঝিয়ে দিচ্ছে বিশ্বমঞ্চে ভারত কতটা গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে গত ৮-৯ বছরে। বিজেপি এবং আরএসএস’র ‘নতুন ভারত’ স্লোগানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলল প্রচার। 


বক্তব্যটি একেবারেই মিথ্যে। কারণ দেশের নামের ইংরেজি আদ্যক্ষর অনুযায়ী পরপর আয়োজক দেশের নাম ঠিক হয়। গত বছর এই দায়িত্ব পেয়েছিল ইন্দোনেশিয়া, এবার পেয়েছে ভারত। বরং গত বছরই ভারতের করার কথা ছিল, ভারতই পিছিয়ে ইন্দোনেশিয়াকে জায়গা ছেড়ে দেয়। 
সোশাল মিডিয়ার বহু অ্যা কাউন্টে নরেন্দ্র মোদীর ছবি দিয়ে এই ডাহা মিথ্যে প্রচারের জন্য ফেসবুক বা টুইটার বা ইউটিউব কাউকেই আপনি দায়ী করতে পারবেন না। কোন সংস্থায় তার অ্যালগরি দিনকে ব্যবহার করবে না বা করেনি যাতে এই ডাহা মিথ্যা প্রচার অন্তত চিহ্নিত করা যায়। অথচ প্রত্যেকটি আলাদা আলাদা সোশাল মিডিয়া সংস্থা নিজেদের কমিউনিটি গাইডলাইন প্রকাশ করে। বিভিন্ন সময়ে সংবাদ মাধ্যমে এই সংস্থাগুলি জানায় যে ভুয়ো খবর বা ফেক নিউজ ঠেকাতে তারা সর্বোচ্চ সতর্কতা নেবে। 
রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িক হিন্দুত্ব এবং কর্পোরেট জোট সংবাদমাধ্যম এবং গণমাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে দিয়েছে নিজেদের ভাষ্য প্রচারের জন্যই। ক্ষমতার প্রতিস্পর্ধী শক্তিগুলিকেও বিকল্প ভাষ্যের প্রচারে সক্রিয় থেকে সোশাল মিডিয়াতেই পালটা যুক্তি হাজির করতে হচ্ছে। নিজেদের চলার পথ ব্যাখ্যাও করতে হচ্ছে। খুঁজতে হচ্ছে সোশাল মিডিয়ার চরিত্র আসলে কী। চালায় কারা, কেনই বা মোটা টাকা খরচ করে জনতাকে কথা বলার, দ্রুত মত জানানোর সুযোগ করে দিচ্ছে এই মাধ্যম। সত্যিই কী প্রচারে ‘সবার সমান সুযোগ’ থাকে, নাকি এখানেও অর্থ নিয়ন্ত্রণ করে কোন ভাষ্যের প্রসারে কতটা গুরুত্ব দেওয়া হবে। 
গুগলের সম্পদের অর্থমূল্য আমাদের ভারতের মোট জাতীয় উৎপাদনের প্রায় অর্ধেক। ন্যাসড্যাকের তথ্য জানাচ্ছে গুগলের মোট সম্পদ ১.২১ লক্ষ কোটি ডলার। ভারতের মোট জাতীয় উৎপাদন, অর্থনৈতিক সমীক্ষা অনুযায়ী, ৩.১৮ লক্ষ কোটি ডলার। গুগল সোশাল মিডিয়া নয়। কিন্তু সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে পৌঁছাতে হয় গুগলকে ধরেই। ভারতে সবচেয়ে চালু সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম ফেসবুক। সাধারণ ব্যবহারের জন্য পয়সা দিতে হয় না। কিন্তু ফেসবুকের ন্যাসড্যাকের তথ্যই জানাচ্ছে, ফেসবুকের সম্পদের বাজারমূল্য, ৫০ হাজার ৩শো কোটি ডলার। মাইক্রো ব্লগিং সাইট টুইটারের সম্পদ ৪ হাজার ১০০ কোটি ডলার ছাড়িয়ে। 


সোশাল মিডিয়া-কে বাংলায় ‘সামাজিক মাধ্যম’ বলতে পারেন। তবে তার নিয়ন্ত্রণ কাঠামো একেবারেই ‘প্রাইভেট’। যেমন আর পাঁচটা ব্যবসা চলে তেমনই সংস্থার মালিকানা বেসরকারি কোনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর। এখানেও প্রধান লক্ষ্য মুনাফা কামানো, পুরোদস্তুর মিডিয়া ব্যবসার মতোই। সংবাদমাধ্যমের মতোই সোশাল মিডিয়ার মালিক সংস্থাগুলির আয়ের প্রধান উৎস বিজ্ঞাপন। 
গুগলের মোট আয়ের ৮১ শতাংশ আসে বিজ্ঞাপন থেকে, ফেসবুকের ৯৭.৪ শতাংশ। বিজ্ঞাপনের আর্থিক প্রবাহের পাল্লা আপাতত সোশাল মিডিয়ার দিকে ঝুঁকে রয়েছে। ২০১৫'তে সংবাদপত্র এবং টিভির হাতে ছিল বিজ্ঞাপনের মোট আয়ের অর্ধেক। মাত্র সাত বছরে, ২০২২-এ আয় চার ভাগের এক ভাগে। এই বিশ্লেষণের নিরিখেই ‘নিউজক্লিক’ সংবাদ ওয়েবসাইটের সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থের পর্যবেক্ষণ, সোশাল মিডিয়া বলে আদালা পরিচিতি তৈরি করা হয়েছে ঠিকই। তবে সামগ্রিক গণমাধ্যম এবং সংবাদমাধ্যমের অংশ সোশাল মিডিয়া। 
কেন বিজ্ঞাপনে এগিয়ে যাচ্ছে সোশাল মিডিয়া? সোশাল মিডিয়ায় পণ্যই বা কে? পণ্য আমরা প্রত্যেকে, যারা ব্যবহার করি। আমাদের পছন্দ অপছন্দের প্রতিটি ধরন, ইন্টারনেটে আমরা কী খুঁজি সার্চ ইঞ্জিনে, এমন খুঁটিনাটি প্রতিটি তথ্যই পণ্য। সেই তথ্য ধরে রাখে ডিজিটাল প্রযুক্তির বন্দোবস্ত। 
পণ্য বা পরিষেবা উৎপাদকরা বেছে নিচ্ছেন ডিজিটাল মিডিয়াকে। কারণ, পণ্যের নির্দিষ্ট ক্রেতার কাছে পৌঁছানো যায় অনেক সহজে। পাশাপাশি দু’টি মোবাইলে একই খবর দেখছেন দু’জন। অথচ একেকজনের যন্ত্রে একেকটি বিজ্ঞাপন! সংবাদপত্রে বা টেলিভিশনে সকলের জন্য একই বিজ্ঞাপন নয়। সোশাল মিডিয়া বা ডিজিটাল মিডিয়া আদ্যোপান্ত মিডিয়া ব্যবসা, ধরন আলাদা হলেও। 
এখানেও সবার জন্য সমান সুযোগ আদৌ নেই। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা হয় মালিক গোষ্ঠীর মুনাফার পক্ষে প্রয়োজনীয় বিষয়বস্তুর প্রচার বাড়াতে, অপছন্দের বিষয়বস্তুর প্রচার কমাতেও। বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, তথ্যপ্রযুক্তি জনিত ব্যবস্থাপনা 'অ্যালগরিদম' ব্যবহার করা হয় সেই লক্ষ্যেই। 
পরিচিত সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে সোশাল মিডিয়ার ফারাকও রয়েছে। দ্রুত মন্তব্য করা, পরিচিতদের মধ্যে ছড়ানো, বিষয়বস্তুর প্রচারের জন্য কেবল কোনও সংবাদ প্রতিষ্ঠানের ভরসায় অপেক্ষা করতে না হওয়ার মতো বাস্তবতা রয়েছে। ক্ষমতার এবং প্রতিস্পর্ধী চিন্তার, দু'য়ের কাছেই, সোশাল মিডিয়া গুরুত্বপূর্ণ। জনমনে প্রভাব খাটাতে পুরো আলাদা লক্ষ্যে তাকে ব্যবহার করবে এবং করতে চাইবে দু'পক্ষই।
সংশ্লিষ্ট সংস্থা কী করবে? অপছন্দের রাজনৈতিক বিষয়বস্তুর প্রসার বা ‘রিচ’ কমিয়ে দিতে চাইবে। বামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠনের বহু কর্মী, যাঁরা শোশাল মিডিয়ায় সক্রিয়, এমন অভিজ্ঞতা রয়েছে। এই অভিজ্ঞতা রয়েছে প্রতিবাদী অন্য আন্দোলনের কর্মীদেরও। 


আবাস যোজনায় ঘর চাইতে গিয়ে মার খেলেন গ্রামবাসীরা। প্রকাশ্যে পুলিশ লাঠিপেটা করল মহিলাকেও। আপনার ভিডিও অনেকে দেখেও ফেললেন। পরের দিনই আপনার অন্য ভিডিও’কে আটকে দেওয়া হতে পারে। পুরানো কোনও পোস্ট দেখিয়ে বলা হতে পারে, বলা হয়, রিপোর্ট রয়েছে বা কমিউনিটি গাইডলাইন অমান্য করছে। হুমকি দেওয়া হয়, চ্যানেল বা পেজ খোয়াতে পারেন আপনি। এগুলি কোনোটিই কল্পিত নয়। 
অথচ এই ইউটিউবে বা ফেসবুকে অজস্র ঘৃণাভাষণ ছড়ানো হয়। ছড়ানো হয় মিথ্যা সংবাদ। কেবল এদেশ নয়, পশ্চিমেও। ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ একটি নিবন্ধে দেখিয়েছিল যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মধ্যবর্তী নির্বাচনে কিভাবে মিথ্যা সংবাদ বিনা বাধায় ছড়িয়ে। এক প্রার্থী অন্যজনকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য বলে প্রচার করেছেন। সেই অর্থে কোনও কমিউনিটি গাইডলাইনে আটকায়নি। 
এদেশে তো বিজেপি এবং আরএসএস বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে অর্থ দিয়ে ‘ট্রোল বাহিনী’ চালায়। বিরুদ্ধে স্বর থাকলেই জঘন্য ভাষায় আক্রমণ চলতে থাকে। ধর্ষণের হুমকি চলতে থাকে। এমনকি প্রাণনাশের হুমকিও অজস্র আসতে থাকে। সেগুলি আটকানোর কোনও ব্যবস্থা নেই। কোনও নিরপেক্ষতা নেই। ঠিক যেমন, প্রতিবাদীর পোস্ট হলে ‘ভাবাবেগে আঘাত’ দেখিয়ে গ্রেপ্তার করে নেওয়া হয়। অথচ ঘৃণাভাষণের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না প্রশাসনিক স্তরে। দেশে বিজেপি এ কাজ করে দেখাচ্ছে সারা দেশে। এ রাজ্যে তৃণমূল আসীন হওয়ার গোড়া থেকে প্রশাসনিক স্তরে এমন প্রবণতা দেখা গিয়েছে বারবার।   
কেবল বিষয়বস্তুর রাজনৈতিক ধরনই নিয়ন্ত্রিত হয় এমন নয়। অর্থের বিনিময়ে প্রসার বাড়ানো যায়, বাড়ানো হয়। 'পেইড প্রোমোশন' বা 'বুস্ট প্যাকেজ’-র প্রস্তাব থাকে খোলাখুলি।
কিন্তু সেই বাধা কাটিয়েই প্রতিবাদীরা প্রচার করছেন। প্রতিবাদী আন্দোলনের প্রধান রসদ রাস্তা। রাস্তার লড়াইয়ের প্রচারও জরুরি। সোশাল মিডিয়াকে সে কাজে ব্যবহার করার চেষ্টা চলছে সর্বত্রই। দুইয়ের মধ্যে সমন্বয়ও গুরুত্ব পাচ্ছে।


তথ্য হলো, ভারতে ২০১৫ তে সোশাল মিডিয়া ব্যবহার করত ১৪ কোটি ২০ লক্ষ। স্ট্যাটিস্টা'র তথ্য, ২০২২-এ সংখ্যা হয়েছে ৭৫ কোটি ৫০ লক্ষ ৪৭ হাজার। ২০৪০-এ সংখ্যা পৌঁছাবে ১৫২ কোটি ৯০ লক্ষে। বিশ্বে, বা এ দেশে সোশাল মিডিয়া ঘিরে প্রতিরোধের লড়াইও বাড়তি মাত্রা পেয়েছে। বিদ্বেষ এবং ঘৃণাভাষণের জন্য এই মাধ্যমকে কাজে লাগাচ্ছে ফ্যাসিস্ত লক্ষণ সম্পন্ন আরএসএস, তার রাজনৈতিক শাখা বিজেপি। কর্পোরেট হিন্দুত্ব জোট টাকার জোগান অবাধ করেছে। 'মিথ্যা চেতনা',  আমাদের এখানে যেমন 'গর্বিত হিন্দু', তার প্রচারে হাতিয়ার সোশাল মিডিয়া। 
আবার পালটাও আছে, কৃষকদের লঙ মার্চ বা সিএএ এনআরসি বিরোধী লড়াইয়ে পালটা যুক্তি, মিথ্যাকে হারানোর লড়াইয়ে এই মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে অবশ্যই। দিল্লির কৃষক আন্দোলনের সময়েও তা হয়েছে।
দেখা যাচ্ছে, সাংগঠনিক প্রচার কাঠামোকে ব্যবহার করে ডিজিটাল প্রচার কাজ করছে ব্যক্তিগত প্রচারের তুলনায় বেশি। সেই কারণে সাংগঠনিক মুখপত্রের প্রচার বা বিষয়বস্তু বিবেচনায় রাখাও জরুরি বলে মনে করছেন প্রতিবাদী আন্দোলনের সংগঠকরা। কেন না, ক্ষমতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিজে থেকে সহায়তা দেবে না কোনও সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম। লড়াই চালাতে হবে সংগঠিত কায়দায়।
কতজন দেখছেন সেটি অত্যন্ত জরুরি বিবেচনা ঠিকই। সেই সঙ্গে সংগঠকরা মনে করছেন বিকল্প কেন, কোনটি- যুক্তি দিয়ে তা বলাও জরুরি। প্রতিবাদী, কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত রাজনীতির বিপক্ষে সেই প্রচার গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে। বিকল্প ভাষ্য মানে বিকল্পের যুক্তি, বিকল্প চিন্তা হাজির করাও।
 

Comments :0

Login to leave a comment