যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর মধ্যে প্রসারিত ও বিকেন্দ্রীকৃত সংসদীয় গণতন্ত্রকে কেন্দ্রীভূত আধিপত্যবাদী গণতন্ত্রে সঙ্কুচিত করার মূল লক্ষ্যকে সামনে রেখে নির্বাচনী সংস্কারের নামে আরএসএস-বিজেপি সংবিধানের মূল ভাবনা ও কাঠামোকেই নস্যাৎ করে দিতে উদ্যোগী হয়েছে। তারজন্যই লোকসভা ও বিধানসভার ভোট একসঙ্গে করতে মোদী সরকার সংসদে পেশ করেছে ১২তম সংবিধান সংশোধনী বিল। একইসঙ্গে কেন্দ্রশাসিত পুদুচেরি, দিল্লি এবং জম্মু কাশ্মীরের ভোটও যাতে করা যায় তারজন্যও পেশ হয়েছে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল আইন সংশোধনী বিল। আরএসএস’র হিন্দুত্ববাদী অতিদক্ষিণপন্থী মতাদর্শে উদার গণতন্ত্রের কোনও জায়গা নেই। তারা স্বৈরাতান্ত্রিক মনোভাব দ্বারা চালিত কেন্দ্রীভূত ক্ষমতায় বিশ্বাস করে। তারজন্য যেটুকু গণতন্ত্র দরকার সেটুকুই তারা ছাড়তে পারে। তাছাড়া তারা চায় কেন্দ্রীভূত অতিশালী রাষ্ট্র। কেন্দ্র থেকে গোটা দেশ, সমাজ ও নাগরিকদের নিয়ন্ত্রণ করতে চায়। বৈচিত্র, ভিন্নতা ও স্বাতন্ত্র্যের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের যে ঔজ্জ্বল্য ও বিকশিত রূপ তাকে একেবারেই পছন্দ করে না। তারা হিন্দুত্বের এক ছাঁচে সব ধর্ম, বর্ণ, জাত, ভাষা, সংস্কৃতিকে বেঁধে ফেলতে চায়। রাজ্যে রাজ্যে রাজ্যে সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভিন্নতাকে তারা নাকচ করতে চায়। রাজ্যের মানুষের ভিন্ন ভিন্ন চাহিদা ও প্রত্যাশাকেও তারা মর্যাদা দিতে রাজি নয়। তাই এক দেশ এক ভোটের শৃঙ্খলে বহুত্বের স্বাতন্ত্র্যকে বন্দি করতে চায়।
লোকসভার ভোটে যেসব ইস্যু গুরুত্ব পায় বিধানসভার ভোটে তার সবগুলি সমান গুরুত্ব পায় না। তেমনি বিধানসভাগুলির ক্ষেত্রে ভিন্ন ভিন্ন ইস্যু বাড়তি গুরুত্ব পায়। কোনও রাজ্যে যখন বিধানসভা ভোট হয় তখন তাতে কেন্দ্রীয় বা জাতীয় ইস্যুগুলি মুখ্য হয়ে ওঠে না। বরং মুখ্য হয় রাজ্যের ও রাজ্যবাসীর নিজস্ব ইস্যুগুলি। এক এক রাজ্যে এই দাবি আবার ভিন্ন ভিন্ন হয়। এটাই যুক্তরাষ্ট্রীয় গণতন্ত্রের প্রধান বৈশিষ্ট্য যা অনেকটাই বিকেন্দ্রকৃত ও প্রসারিত। লোকসভা বিধানসভা ভোট একসঙ্গে হলে জাতীয় ইস্যুগুলির চাপে রাজ্যের নিজস্ব ইস্যুগুলি চাপা পড়ে যাবে। মানুষের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফল ঘটবে না নির্বাচনে। অর্থাৎ গণতন্ত্র সঙ্কুচিত হয়ে যাবে।
সরকার দাবি করছে একসঙ্গে ভোট হলে নাকি খরচ কমবে। ভোটের জন্য আদর্শ আচরণবিধির জেরে উন্নয়নের কাজ ব্যাহত হয়। এসব আসলে ছেঁদো যুক্তি। অঙ্কের হিসাবে যে পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হবে সেটা আহামরি কিছু নয়। গণতন্ত্র প্রসারে এবং তার পূর্ণ বিকাশের জন্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে এটুকু কেন আরও বেশি অর্থ ব্যয় করা উচিত। আর আদর্শ আচরণবিধি বড়জোর একমাস থাকে। সেই সময় নতুন নীতি ঘোষণা বা প্রকল্প ঘোষণা করা যায় না। আগে ঘোষিত প্রকল্পের কাজ চলতে পারে। বাস্তবে দেখা যায় আচরণবিধি চালুর আগে অন্তত এক বছরের প্রকল্প সরকার ঘোষণা করে দেয়। তাছাড়া প্রকল্প রূপায়ণে যদি এক মাস সামান্য গতি কমে পরবর্তী পাঁচ বছরে তা পূরণ করা কোনও সমস্যা নয়। ইচ্ছে থাকলে করাই দায়। আসলে এসব অবাস্তব কথা বলে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে দুর্বল করে কেন্দ্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা ও ক্ষমতার অতি কেন্দ্রীভবন করাই লক্ষ্য। তাছাড়া পদে পদে ব্যর্থ সরকার মানুষের ক্ষোভ চাপা দিতে এবং আলোচনার মোড় অন্যদিকে ঘোরাতে এমন অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে মাতামাতি করছে। আপাতত একসঙ্গে ভোটের কথা বললেও আগামীদিনে তারা সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে ভেঙে রাষ্ট্রপতি প্রধান শাসন ব্যবস্থার দিকে যাবে। রাজ্যে রাজ্যেও চালু করতে চাই রাজ্যপাল প্রধান শাসন ব্যবস্থা।
Editorial
গণতন্ত্র সঙ্কোচনের প্রথম ধাপ
×
Comments :0