প্রসঙ্গ ৩৭০নং ধারা:
৩৭০ ধারা বাতিল করার সময়েই সংসদ থেকে দলীয় সভায় মোদী-শাহরা দাবি করেছিলেন, ৩৭০ ধারার জন্যেই কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ রয়েছে। ৩৭০ ধারা বাতিল হলে সন্ত্রাসবাদ আর থাকবে না। ভারতের সংবিধানে ৩৭০ ধারা যুক্ত হওয়ার পরে ৫০- ৮০- চার দশকে তো সন্ত্রাসবাদ ছিল না। আটের দশকের শেষ থেকে নয়ের দশকের শুরুতে সন্ত্রাসবাদের সূচনা হলো কেন, তার নানাবিধ কারণ চেপে গিয়ে ৩৭০ ধারাকেই সন্ত্রাসবাদের জন্য কাঠগড়ায় তোলা হয়েছে।
২০১৯ সালের ৫ আগস্ট ৩৭০ধারা বাতিল করার আগেই কাশ্মীরকে অবরুদ্ধ করা হয়েছিল। দুনিয়ার সবথেকে বেশি সেনা-আধাসেনা মোতায়েন ছিল কাশ্মীরে।
১১ ডিসেম্বর, ২০২৩, সুপ্রিম কোর্টে রায়ের পর
অমিত শাহ
এক্স হ্যান্ডলে জানান, ‘‘এই রায়ের ফলে গরিব এবং বঞ্চিতদের অধিকার পুনরুদ্ধার হবে। বিচ্ছিন্নতাবাদী কার্যকলাপ, পাথর ছোঁড়ার মতো ঘটনা এখন থেকে অতীত হয়ে যাবে। গোটা অঞ্চলে এখন ঐক্যের সুর বাজবে। জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ ছিল, এবং তা থাকবেও। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে আমাদের সরকার জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখে শান্তি ফিরিয়ে আনতে বদ্ধপরিকর।’’
৩জানুয়ারি, ২০২৫
‘‘জম্মু ও কাশ্মীরের জন্য থাকা বিশেষ ক্ষমতা উপত্যকায় বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সন্ত্রাসের বীজ বপন করেছিল। ৩৭০ অনুচ্ছেদ প্রত্যাহার করে নেওয়ায় উপত্যকায় সন্ত্রাসের ঘটনা আগের চেয়ে প্রায় ৭০ শতাংশ কমে এসেছে। নরেন্দ্র মোদী সরকার সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপ দমন করার পাশাপাশি সন্ত্রাসে মদতদাতাদের ধ্বংস করতে সক্ষম হয়েছে।’’
৩৭০ নং ধারা কী ছিল?
২০১৯-র ৫আগস্ট সংসদে ভোটাভুটিতে ৩৭০নং ধারা বাতিল করে বিজেপি সরকার। সুপ্রিম কোর্টও এই পদক্ষেপকে বৈধ বলে ঘোষণা করে ২০২৩-এর ১১ ডিসেম্বর।
কিন্তু কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দপ্তরের তথ্য বলছে, ২০১৯ থেকে ২০২৪-র সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কাশ্মীরে ২৬২জন সেনা এবং ১৭১জন নাগরিক নিহত হয়েছেন। ২০২৯-এর পুলওয়ামা হামলা ধরে পাঁচ বছরে প্রায় ৬৯০ হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে কাশ্মীরে।
ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাবার সময়ে ব্রিটিশ সংসদে পাশ হয় ভারতের স্বাধীনতা আইন, ১৯৪৭। আইনি দিক থেকে এই আইনে পুরানো রাজন্য শাসিত রাজ্যগুলির শাসকরা তাঁদের অধিকার ফিরে পান। স্বাধীনতার সময়ে এমন রাজন্য শাসিত বা ‘নেটিভ’ রাজ্য ছিল ৫৬৫। জম্মু কাশ্মীর ছিল তেমনই এক রাজ্য। এই রাজ্যগুলির সামনে তিনটি বিকল্প খোলা ছিল: পুরো স্বাধীন হয়ে থাকা, ভারতে অন্তর্ভুক্তি, পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তি। জম্মু কাশ্মীরের ডোগরা রাজবংশের রাজা হরি সিং ১৯৪৭-র আগস্টে ভারত বা পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্তির সিদ্ধান্ত নেননি। কাশ্মীরের পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠে যখন ১৯৪৭-র অক্টোবরে পাকিস্তান সীমান্তের দিক থেকে উপজাতিরা কাশ্মীর উপত্যকায় আক্রমণ চালায়। নিজস্ব শক্তিতে তা মোকাবিলা করতে না পেরে রাজা হরি সিং গভর্নর জেনারেলের মাধ্যমে ভারতের সাহায্য চান। এইসঙ্গেই কাশ্মীরের মধ্যেই ভারতভুক্তির আন্দোলনে শামিল হন শেখ আবদুল্লাহ সহ নেতারা। ভারতীয় সেনা কাশ্মীরে যায়। হরি সিং ভারতভুক্তির চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। ভারত সরকার ও রাজার মধ্যে ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশন স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৪৭-র ২৭ অক্টোবর সেই চুক্তি অনুযায়ী তিনটি বিষয় ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়: বৈদেশিক সম্পর্ক, প্রতিরক্ষা ও যোগাযোগ। ওই চুক্তির ৮নং পরিচ্ছেদ অনুযায়ী বাকি সমস্ত বিষয়ে রাজ্যের স্বাধীনতা অক্ষুণ্ণ থাকে। তদানীন্তন জম্মু কাশ্মীর সংবিধান আইন, ১৯৩৯ মোতাবেক বাকি ক্ষমতা জম্মু কাশ্মীর রাজ্যের হাতেই থাকে।
এই সময়ে ভারতের সংবিধান পরিষদ নতুন সংবিধান রচনার আলোচনা চালাচ্ছিল। ১৯৫০-র ২৬ জানুয়ারি ভারতের নতুন সংবিধান চালু হয়। সংবিধান পরিষদ জম্মু কাশ্মীরের ভারতভুক্তির চুক্তিকে মান্যতা দিয়ে সংবিধানের ৩৭০ নং ধারায় তা অন্তর্ভুক্ত করে। সেকারণে সংবিধান চালুর সময়ে শুধুমাত্র ১নং ধারা ও ৩৭০ নং ধারা জম্মু কাশ্মীরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়।
ভারতের সংবিধান পরিষদ বা গণপরিষদ গঠনের সময়ে জম্মু কাশ্মীরের প্রতিনিধি ছিলেন না। ১৯৪৯ সালে শেখ আবদুল্লা সহ চারজন মনোনীত হন। তাঁরা গণপরিষদেই স্পষ্ট করে দেন ইনস্ট্রুমেন্ট অব অ্যাকসেশনের দ্বারাই ভারতের সঙ্গে জম্মু কাশ্মীরের সম্পর্ক নির্ধারিত হবে। সেই মতোই ৩০৬-ক ধারা যা পরে ৩৭০নং ধারা হিসাবে পরিচিত তা অন্তর্ভুক্ত হয়। কোনও রাজনৈতিক দল নয়, ভারতের সংবিধান প্রণেতারা গণপরিষদেই এই ধারার মান্যতা দিয়েছিলেন। বরং গণপরিষদে বলা হয়েছিল কাশ্মীরের ভারতভুক্তি গণভোটের ওপরে নির্ভর করবে, এ বিষয়ে গণপরিষদ প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
১৯৪৮-র মার্চে হরি সিং সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জম্মু কাশ্মীরের নতুন সংবিধান ঘোষণার জন্য জাতীয় পরিষদ বা সংবিধান পরিষদ গঠনের ঘোষণা করেন। সেই সংবিধান পরিষদ গঠিত হতে আরও কিছু সময় লাগে। ১৯৫৪ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি রাজ্যের সংবিধান পরিষদ জম্মু কাশ্মীরের ভারতভুক্তিকে অনুমোদন করে। সংবিধানে লেখা হয় ‘জম্মু কাশ্মীর রাজ্য ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হবে’। একাধিকবার ভারতের শীর্ষ আদালত জম্মু কাশ্মীর রাজ্যের বিশেষ আইনি অধিকার এবং ৩৭০নং ধারাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে। সুপ্রিম কোর্টে ১৯৫৯ সালের প্রেমনাথ কল বনাম জম্মু কাশ্মীর রাজ্য মামলা, ১৯৬০সালে রেহমান শাগু বনাম জম্মু কাশ্মীর রাজ্যের মামলা প্রণিধানযোগ্য। ২০১৮সালেও সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে ৩৭০নং ধারা অস্থায়ী নয়। আদালতের এই রায়গুলি এসেছে ৩৭০ নং ধারাকে যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার অন্যতম উপাদান হিসাবে বিবেচনা করেই।
সংবিধানের ৩৫-ক ধারায় জম্মু কাশ্মীরকে যে বিশেষ অধিকার দেওয়া হয়েছে ( জমি ক্রয়, স্থায়ী বসবাস, রাজ্যের বৃত্তির সুযোগ ইত্যাদি) তা নাগাল্যান্ড, মিজোরাম, আসাম, মণিপুর, সিকিম, অরুণাচল প্রদেশ, গোয়ার ক্ষেত্রেও নানা ভাবে প্রযোজ্য। অন্য রাজ্য এই ধারার সুবিধা পেয়েছে ৩৬৮নং ধারা থেকে। জম্মু কাশ্মীর পেয়েছে ৩৭০নং ধারা থেকে।
৩৭০নং ধারাকে বর্ণনা করা হয় ভারতের সঙ্গে জম্মু কাশ্মীরের সেতুবন্ধন হিসাবে। বারংবার এই ধারা আক্রান্ত হয়েছে। জম্মু কাশ্মীরের মানুষকে প্রাপ্য স্বাধিকার থেকে বঞ্চনা করা হয়েছে। তার ফলে কাশ্মীরে বিচ্ছিন্নতার শক্তিই জোরদার হয়েছে, উগ্রপন্থীরা প্রচারের সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু সাধারণভাবে ভারতের মূলস্রোতের রাজনৈতিক দলগুলি এই ধারাকে মান্যতা দিয়েই কাশ্মীরকে দেশের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। ব্যতিক্রম রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ। আরএসএস, ভারতীয় জনসঙ্ঘ, হিন্দু মহাসভা, পরবর্তীকালে বিজেপি এই ধারা বাতিলের পক্ষে সওয়াল করেছে। সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে তারা বরাবর কাশ্মীর প্রশ্নকে বিচার করেছে। কাশ্মীরের সমগ্র জনসমাজকে ‘ভারত-বিরোধী’ বলে প্রচার করেছে সঙ্ঘ।
দেশে মুসলমান দ্রুত বাড়ছে?
২০০১-র জনসমীক্ষা অনুসারে ভারতে ১০২ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষ ছিলেন। তাঁদের মধ্যে হিন্দু ছিলেন ৮২কোটি ৭০লক্ষ (৮০.৫%)। মুসলমান ছিলেন ১৩ কোটি ৮০ লক্ষ (১৩.৪%), খ্রিস্টান ছিলেন ২ কোটি ৪০ লক্ষ (২.৪%), শিখ ছিলেন ১ কোটি ৯০ লক্ষ (১.৯%)। এছাড়া ৮০লক্ষ (০.৮০%) বৌদ্ধ এবং ৪০ লক্ষ (০.৪০%) জৈন ছিলেন সেই সময়ে।
২০১১-র সমীক্ষা জানাচ্ছে, দেশের জনসংখ্যা ১২১কোটি। এই সমীক্ষার রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ২০১৪-তে। তার রিপোর্ট জানাচ্ছে দেশবাসীর মধ্যে হিন্দু আছেন ৯৬ কোটি ৬২লক্ষ (৭৯.৮০%)। মুসলমান আছেন ১৭ কোটি ২২ লক্ষ (১৪.২৩%), খ্রিস্টান আছেন ২ কোটি ৭৮ লক্ষ (২.৩০%), শিখ আছেন ২ কোটি ৮লক্ষ (১.৭২%), বৌদ্ধ ছিলেন ৮৪লক্ষ ৪৩ হাজার (০.৭০%), জৈন ছিলেন ৪৪ লক্ষ ৫২ হাজার (০.৩২%)।
এই ক্ষেত্রে লক্ষণীয় ২০০১-র তুলনায় ২০১১-তে দেশের জনসংখ্যা বেড়েছে ১৮ কোটি ২০ লক্ষ প্রায়। তার মধ্যে হিন্দু জনসংখ্যা বেড়েছে ১৩ কোটির বেশি। মুসলমান জনসংখ্যা বেড়েছে ৪ কোটির কম। আগের সমীক্ষার তুলনায় হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১৬.৭৬% এবং মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২৪.৬%। যদিও আগের দশ বছরে, অর্থাৎ ১৯৯১ থেকে ২০০১-র মধ্যে হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১৯.৯২% এবং মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২৯.৫২%। অর্থাৎ দুই ধর্মের মানুষের মধ্যেই জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমছে। হিন্দুদের ক্ষেত্রে প্রায় ৩%, মুসলমানদের ক্ষেত্রে কমছে প্রায় ৫% হারে।
ফলে মুসলমানরা দারুণ বাড়ছে এই বক্তব্য অঙ্ক, যুক্তির হিসাবে দাঁড়াচ্ছে না। বরং জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে মুসলমানরাও অনেকটা সচেতন হয়ে উঠছেন, তা রিপোর্ট জানাচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গ –জনসংখ্যা:
১৯৪১-এ অবিভক্ত বাংলার জনসংখ্যা ছিল ৬ কোটি ২০লক্ষ। তার মধ্যে ৫৩.৪% ছিল মুসলমান। ৪১.৭% ছিলেন হিন্দু। কলকাতা, ভাটপাড়া, হাওড়া এবং ঢাকা — চারটি শহরেই হিন্দুরা ছিলেন সিংহভাগ। কলকাতায় বসবাস করতেন ২ কোটি ১০ লক্ষ মানুষ। তাঁদের ৭২.৭% ছিলেন হিন্দু। হাওড়ার জনসংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ ৭৯ হাজার। তার ৮১.৮% শতাংশ ছিলেন হিন্দু। ভাটপাড়ার ১লক্ষ ১৭ হাজার বাসিন্দার ৬৯.২% এবং ঢাকার ২ লক্ষ ১৩ হাজার বাসিন্দার ৬০.৭% ছিলেন হিন্দু।
২০১১-র জনসমীক্ষা অনুসারে পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার ৭০.৫৪% হিন্দু। মুসলমান জনসংখ্যা ২৭.০১%। খ্রিস্টান আছেন ০.৭২%। গ্রামে মুসলমান ৩০.৭৯%, শহরে ১৮.৯৩%। ২০০১-এ পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা ছিল ৮ কোটি ১ লক্ষ ৭৬ হাজার ১৯৭। মুসলমান ছিলেন ২৫.২৫%।
১৯৫১-তে রাজ্যে মুসলমান ছিলেন ১৯.৮৫%।
১৯৭১-এ তা ছিল ২০.৪৬%। ১৯৯১-এ ২৩.৬১%।
একটি নির্দিষ্ট সময় (সাধারণত ১০ বছর)-এ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারকে ডিকেডাল গ্রোথ রেট বলে। পশ্চিমবঙ্গে ১৯৫১ থেকে ১৯৬১ — এই সময়ে মুসলমানদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল সর্বাধিক — ৩৬.৪৮%। তাঁদের সর্বনিম্ন জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ২০০১ থেকে ২০১১-য়। তা ছিল ২১.৮০%।
এই জনসংখ্যা বৃদ্ধি কী শুধু পশ্চিমবঙ্গেরই অঙ্গ?
উত্তর প্রদেশ কী বলছে? ২০১১-র জনসমীক্ষা অনুসারে উত্তর প্রদেশে হিন্দু আছেন ৭৯.৭৩%। মুসলমান আছেন ১৯.২৬%। ২০০১-এ সেখানে হিন্দু ছিলেন ৮০%। মুসলমান ছিল ১৮% কাছাকাছি। অর্থাৎ একই হারে বেড়েছে।
সন্ত্রাসবাদী মানেই মুসলিম?
হুগলীর যতীন চ্যাটার্জিই অসীমানন্দ। তিনি ডাঙ জেলায় শবরী আশ্রম চালাতেন। মালেগাঁও সহ একাধিক বিস্ফোরণে অন্যতম এই অভিযুক্তকে অবশ্য সব অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়েছে আদালত। ২০০৭-এর ফেব্রুয়ারিতে অমৃতসর-লাহোর সমঝোতা এক্সপ্রেস বিস্ফোরণেও অসীমানন্দ ঘনিষ্ঠদের যোশীর হাত থাকার অভিযোগ উঠেছিল। হরিয়ানার দিওয়ানা গ্রামের কাছে ওই বিস্ফোরণে ৬৮জন যাত্রীর মৃত্যু হয়েছিল, যার মধ্যে ৪২জনই পাকিস্তানের নাগরিক।
২০১২-তে জামিয়া ইসলামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে গিয়েছিলেন দেশের তৎকালীন উপরাষ্ট্রপতি হামিদ আনসারি। সেখানেই তাঁকে খুন করার চেষ্টা করেছিলেন ড. আর পি সিং। অভিযোগ এমনই। পনেরো লিটার পেট্রোল নিয়ে গিয়েও শেষ পর্যন্ত কিছু করে উঠতে পারেননি দিল্লির অ্যাপোলো হাসপাতালের এই এন্ডোক্রিনোলজিস্ট। মাস তিনেক পর ২০০৮-এর জানুয়ারিতে এক গোপন বৈঠকে স্বঘোষিত শঙ্করাচার্য দয়ানন্দ পাণ্ডের কাছে সেই ব্যর্থতার কথা কবুল করেন ড. সিং।
অভ্যাস বশেই আগের সব মিটিংগুলোর মতো এই কথোপকথনও পাণ্ডে রেকর্ডিং করে রেখে দেন তাঁর ল্যাপটপে। মালেগাঁও বিস্ফোরণের তদন্তের সূত্র ধরে ‘স্বামীজী’র সেই ল্যাপটপ ২০০৮-এ মহারাষ্ট্র এ টি এস-র প্রধান হেমন্ত কারকারের হাতে না আসা পর্যন্ত এসবের কিছুই জানা যায়নি। স্বামীজীর সেই ল্যাপটপে ধরে রাখা অডিও, ভিডিও ফাঁস না হলে আজও অজানাই থেকে যেত হিন্দুত্ববাদী সন্ত্রাসের জাল কী সুদূর বিস্তৃত। জানাই যেত না, ওই বিস্ফোরণগুলি ‘অভিনব ভারত’-এর সুবিশাল চক্রান্তের নমুনা মাত্র। জানাই যেত না ২০০৫-০৬ সালে পুনেতে গজিয়ে ওঠা এই চরম দক্ষিণপন্থী সংগঠন ভারতকে বিশুদ্ধ ‘হিন্দু রাষ্ট্র’ বানাতে নেপাল, ইজরায়েলের নানা গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে শুরু করেছে। জানাই যেত না, অভিনব ভারতের লোকজনকে প্রশিক্ষণ ও তাঁদের শিবির চালানোর জন্য ২০০৭ সালে যোগাযোগ করা হয়েছিল নেপাল রাজা জ্ঞানেন্দ্রর সঙ্গে।
ল্যাপটপে ধরে রাখা একটা রেকর্ডিংয়ে দিল্লির হিন্দু মহাসভার প্রধান অযোধ্যা প্রসাদকে ত্রিপাঠীর মুখে শোনা গেল ব্রিটেনের ইসলামবিরোধী গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে তাঁর কেমন যোগাযোগ। ওঁর নিজের কথায়, ‘ইংল্যান্ডের স্টিফেন গাউসের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে। স্টিফেন মারাত্মক অ্যান্টি-কমিউনিস্ট আর অ্যান্টি-ইসলামিক।’ সেই বৈঠকেই স্বামীজীকে বলতে শোনা গেল, দরকার পড়লে রাষ্ট্রসঙ্ঘের সচিব পদে কর্মরত এক ব্রিটিশ মহিলার সাহায্যও পাওয়া যেতে পারে।
‘স্বামীজী’ ওরফে দয়ানন্দ পাণ্ডে ওরফে সুধাকর উদয়ভান দ্বিবেদী ওরফে স্বামী অমৃতানন্দ দেবতীর্থ এখন নাসিক জেলে। ২৬/১১-র রাতে মুম্বাই হামলায় রহস্যজনকভাবে খুন হয়ে যাওয়ার আগে কারকারে মালেগাওঁ বিস্ফোরণের সূত্র ধরে স্বামীজীর আরও কয়েকজন সঙ্গী-সাথিকে গরাদে ঢুকিয়ে যেতে পেরেছেন। আর পাণ্ডেকে তো তাঁর স্কোয়াড গ্রেপ্তার করে ঠিক তাঁর মৃত্যুর দিন কয়েক আগে। প্রজ্ঞা সিং ঠাকুর বা লেফটেন্যান্ট কর্ণেল শ্রীকান্ত পুরোহিতকে ধরা গেলেও গ্রেপ্তার করা যায়নি দিল্লির চিকিৎসক আর পি সিংকে। মহারাষ্ট্র এটিএস’র সূত্র বলছে, ড. সিংয়ের সঙ্গে মালেগাঁওয়ের সরাসরি যোগাযোগের প্রমাণ না মেলায় ওকে ধরা যায়নি।
কারকারের স্কোয়াড ওকে গ্রেপ্তার করতে না পারলেও সিবিআই-তো পারতো। স্বামীজীর ল্যাপটপ থেকেই তো ড. সিংয়ের ভয়ানক চক্রান্তের কথা জানা গিয়েছিল। তার একটা নমুনা তুলে ধরা যাক। এক বৈঠকে কর্নেল পুরোহিতকে ড. সিং বলছেন, ‘আমার চাই গ্রেনেড, হাইভোল্টেজ ডিটোনেটর, ব্যাটারি, আর ডি এক্স। এগুলি হাতে পেয়ে গেলে আমরা একটা ‘গ্লোরিয়াস ওয়ার’ শুরু করতে পারি। জম্মু থেকে আমি আপনাকে ১০০ জনের একটি সুইসাইড স্কোয়াড দিতে পারবো।’’
সেই একই টেপে পুরো বলছে, ‘আমরা যে কিছু করেছি, তার প্রমান চাইছে ইজরায়েলীরা। আর কী প্রমাণ ওদের দরকার? আগে আমরা এমন দুটো অপারেশন করেছি যা সাকসেসফুল হয়েছে! হ্যাঁ ইকুইপমেন্ট সব ওদের থেকেই আমি পেয়েছি।’ খানিক পরে রমেশ উপাধ্যায়কে বলতে শোনা যাচ্ছে, ‘হায়দরাবাদ মে যো বম্ব ব্লাস্ট কিয়া থা ওহ আপনা হি আদমি থা। ওহ কর্নেল আপকো বাতায়েঙ্গে কিসনে কিয়া থা।’ এই রমেশ উপাধ্যায় সেনাবাহিনী থেকে ১৯৮৮তে অবসর নিয়েছেন। মুম্বাইয়ে বিজেপি’র এক্স সার্ভিসমেন সেলের প্রধান ছিলেন। মালেগাঁওয়ের ছক কষার সব কটা বৈঠকেই উপাধ্যায় হাজির ছিল।
এছাড়াও বৈঠকগুলিতে ছিলেন দিল্লির বিজেপি নেতা বিএলশর্মা, অভিনব ভারতের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। প্রেম সিং শের নামেও পরিচিত এই শর্মা ৯১ ও ৯৬তে পূর্ব দিল্লি থেকে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। ২০০৯-এ দিল্লি উত্তর-পূর্ব থেকে দাঁড়ালেও জয় প্রকাশ আগরওয়ালের কাছে হেরে যান শর্মা। নাসিকের এক মন্দিরের গোপন বৈঠকের ভিডিও চিত্রে শর্মাকে দেখা গেছে পাণ্ডে আর পুরোহিতের সঙ্গে মুসলিমদের বিরুদ্ধে টেরর স্কোয়াড বানানোর সলা করতে। ড. সিংয়ের মতো শর্মাকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
Comments :0