Lalgola passanger

সুহানার খিদে, ধান আর কাজের গল্প

ফিচার পাতা

অনির্বাণ দে

১।
স্টেশনের নাম পীরতলা। বহরমপুর থেকে লালগোলা যেতে  ভগবানগোলার ঠিক পরে। সেই স্টেশন থেকেই ভোরের  ট্রেনে উঠেছেন ফুলবানু বিবি। সাথে ছোট্ট সুহানা। অনেক দূর যেতে হবে। বলছিল সুহানা।
কতদূর ? সেই যেতে একটা বেজে যাবে। খিদে পাবে।
নেমে ভাত খাবো মা । কলকাতায়। পাশ থেকে আশ্বাস দিচ্ছেন ফুলবানু বিবি। যদিও সেই খাবার মা, মেয়ে কারোরই খুব একটা পছন্দের নয়।
তবে অত সকালে উঠে তো রান্না করা যায় না। বলছেন  ফুলবানু।
সকালের ট্রেন কলকাতা চলেছে। 
অসুখ নিয়ে।
এমনটাই বলছেন ভগবানগোলা থেকে ওঠা ফতেমা বিবি, সেলিমা বিবিরা। কারো সাথে অসুস্থ মেয়ে। কারো সাথে বৌমা। সকলেই চলেছে শহরে।
শহর মানে বহরমপুর ? মুর্শিদাবাদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ?  নাহ। ওখানেও হয়নি চিকিৎসা । ডাক্তার দেখাতে ভরসা এখনও কলকাতা। সেদিকেই ছুটছে সকালের ট্রেন।
২০২০-২১ সালের গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিসংখ্যান অনুযায়ী  পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে গ্রামীণ প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে (পিএইচসি) ডাক্তারের শূন্যপদ রয়েছে ৫৭৮টি । এছাড়া গ্রামীণ অঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলির মোট ঘাটতি ৫৮ শতাংশ। 
সম্প্রতি মুর্শিদাবাদের বিড়ি শ্রমিকদের নিয়ে একটি ওয়েবসাইটে একটি লেখা প্রকাশ করেছেন সাংবাদিক স্মিতা খাটোর। সেখানেই সামনে এনেছেন গ্রামে স্বাস্থ্যের বেহাল দশা। স্মিতা জানাচ্ছেন,  মুর্শিদাবাদ জেলায় ১৫-৪৯ বছর বয়সি মহিলাদের মধ্যে শতকরা ৭৭.৬ শতাংশ রক্তাল্পতার শিকার। তিনি লিখছেন, “চার বছর আগের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষায় উঠে আসা হার শতকরা ৫৮ শতাংশের তুলনায় নতুন সমীক্ষায় রক্তাল্পতায় বৃদ্ধি হয়েছে বহুগুণ। রক্তাল্পতার শিকার যে সব মায়েরা, তাঁদের সন্তানদের ক্ষেত্রেও রক্তাল্পতা হওয়ার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি থাকে। প্রসঙ্গত, সাম্প্রতিকতম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা (এনএফএইচএস-৫) বলছে সার্বিকভাবেই মুর্শিদাবাদ জেলার মহিলা এবং শিশুদের মধ্যে রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া বেড়েছে। এরই পাশাপাশি, এই জেলায় ৫ বছরের কমবয়সি শিশুদের মধ্যে শতকরা ৪০ শতাংশই অপুষ্টির জেরে দৈর্ঘ্যে খাটো (‘স্টান্টেড’), ভয়ের কথা এটাই যে চার বছর আগে, ২০১৫-১৬ সালের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা থেকে উঠে আসা পরিসংখ্যানে শিশুদের সার্বিক বিকাশ ব্যাহত হওয়ার যে ছবি উঠে এসেছিল, তাতে কোনও বদল হয়নি” ।
গ্রামে স্বাস্থ্যের বেহাল দশার ফুটে ওঠে এই শিয়ালদহ লালগোলা রুটের এই সব ট্রেনেই ।
বিকেল ৪ টে ৪০’এর  সময় শিয়ালদহ থেকে ছাড়ে লালগোলা প্যাসেঞ্জার। সেটা নাকি পেশেন্ট ট্রেন ! এমন পরিহাস জোটে অনেকের কাছ থেকেই। সেই ট্রেনে ওঠা মানে, মারপিট করতেই হবে।
এর পর আবার সেই ৬টা ২০’র ট্রেন। তাও এক্সপ্রেস। বেশি  ভাড়া। ৭৫  টাকা। তাই শিয়ালদহ থেকে ছাড়া এই ট্রেনই ভরসা কলকাতা ফেরত রোগী, রোগীর আত্মীয়দের। ৪৫ টাকায় পৌঁছে যাওয়া যায় শিয়ালদহ থেকে বহরমপুর। কলকাতা যাওয়ার জন্য অনেকেরই ভরসা লালগোলা থেকে ভোর সাড়ে তিনটের রানাঘাট মেমু আর ভোর পাঁচটার শিয়ালদহ মেমু।


বদলে গিয়েছে ট্রেন। অন্তত তেমনটাই বলছেন হরিহরপাড়ার সালেম শেখ। সেই পনেরো বছর বয়স থেকে ট্রেনে কলকাতা যাচ্ছেন। দেখেছেন অনেক চড়াই উৎরাই। এক সময় ঘুরে বেড়ানোর শখ ছিল। এখন ব্যবসার কাজেই সপ্তাহে তিন দিন না হোক দু’দিন তো কলকাতা যেতেই হয়। গামছা নিয়ে যান হরিহরপাড়া থেকে কলকাতা। এটাই এখন রুজি। কিন্তু করোনার পর থেকে এখনও তেজী হয়নি বাজার। এখন মাঝে মাঝে বয়ে নিয়ে যাওয়া গামছা ফেরতও নিয়ে আসতে হচ্ছে।
ছেলে থাকে বহরমপুরের মেসে। চাকরির পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। কিন্তু চাকরি হবে কী ?
ট্রেনের হাওয়ায় প্রশ্ন উড়লে জবাব আসছে উলটোদিকে বসা রুবেলের কাছ থেকে। রুবেলের দাবি, এসএসসি’র ইন্টারভিউতে বসেও চাকরি মেলেনি। পরে ঢুকেছেন একটা বেসরকারি কোম্পানিতে। ছুটি শেষে ফিরছেন কাজে। বদলে গিয়েছে গ্রামও। জুড়লেন তরুণ রুবেল।

কেমন বদল ?

৩।

সেটা মাঠে গেলেই বুঝতে পারি। অভিজ্ঞতা নবগ্রামের প্রণব মণ্ডলের। তিন প্রজন্মের কৃষক প্রণবরা। এবারও দুই ভাই , বাবা মিলে ধান চাষ করেছেন।
ধান কাটাও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বিক্রি ? এখনও সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না।
এই বছর ধানের সরকারি দাম ঠিক হয়েছে ২০৪০ টাকা কুইন্টাল। সরকারি কেন্দ্রে দাম ২০ টাকা বেশি, ২০৬০ টাকা কুইন্টাল। কিন্তু খোলা বাজারে ধানের দাম নেই।
কিষান মান্ডিতে ধান বিক্রি হলে কিছুটা লাভ হবে। কিন্তু সেই সিস্টেমটাই দালালদের দখলে। তার উপর আছে ঢলতার জুলুম।
এখন সে সব অনলাইনে। তারপরেও দালালরা কীভাবে কাজ করে ?
টাকা থাকলে সবই হয়। নির্ভেজাল উত্তর সহযাত্রী প্রণবের। ধান বিক্রির জন্য অনলাইনে টিকিট কাটতে হচ্ছে। কিন্তু আসলে অনেক আগের টিকিট কেটে রেখেছে দালালরা। ফলে, চাষিরা ধান বিক্রির সুযোগই পাবেন না । ফের ফিরতে হবে দালালদের কাছে। কম দামে ধান দিয়ে দেওয়া ছাড়া এবাররেও উপায় নেই।
উপরি চিন্তা হচ্ছে সার, বিষের দাম। কালোবাজারি। খাতায় কলমে ১০২৬ সালের ৫০ কেজির বস্তার দাম হওয়ার কথা ১৪৭০ টাকা। কিন্তু রেজিনগরের বিকাশ ঘোষ সেই সার কিনেছেন ২১৫০ টাকা দিয়ে। ১৮০০ টাকা দাম পটাশ সারের। কিন্তু বাজারে পটাশের দাম ২২০০ পার করেছে ।
অন্যদিকে দাম পড়েছে আনাজের। শীতের সবজি ফলিয়েছেন বেলডাঙ্গার শুকচাঁদ মণ্ডল। ট্রেনে বহরমপুর এসেছিলেন আত্মীয়ের বাড়ি, সাথে ছিল ফুলকপি, বাঁধাকপি। গ্রামের কপি দু’তিন টাকা দামে বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। যদিও শহরের বাজারে সেই দাম বেশ কয়েক গুণই বেড়ে যাচ্ছে। বাড়ছে সারের দোকানে বাকি, ঋণের বোঝা।

৪।
ট্রেনে চাপার পরেও তিনটে ফোন এসেছে বিট্টুর ফোনে। বয়স তিরিশের বিট্টুদের মুদিখানার দোকান আছে। স্বামী, স্ত্রী দু’জনে মিলে দোকান চালান। ট্রেনে ওঠার পর ফোন আসছে, কারণ এই সপ্তাহেও ‘কিস্তি কামাই’। 
সেরকম কেনাবেচা হয়নি দোকানে। গ্রামের মুদিখানা। অনেকেরই ধার জমা হয়েছে। কিস্তির টাকা দেওয়া কী মুখের কথা ? বলছেন বিট্টু প্রামাণিক ।
বন্ধনের লোন নিয়ে সমস্যায় আছেন রানাঘাট ফেরত বেলি বিবিও। নিজে থেকেই জানাচ্ছেন, প্রতি সপ্তাহে টাকা শোধ করার চিন্তা থাকে। ঘুম হয় না। কিন্তু লোন কী কেউ সাধে নেয় ? জুড়ছেন বিট্টু। দোকান তৈরির সময় ব্যাঙ্কে ব্যাঙ্কে ঘুরেও লোন পাননি। কাজেই বন্ধনই সম্বল। দুয়ারে এসে লোন দিয়ে গিয়েছে। এখন বুকের উপর উঠে বসেছে। গ্রামজুড়ে থাবা বসাচ্ছে ঋণ। ঘরে ঘরে দেনা বাড়ে। মুক্তির খোঁজে তাই নতুন কাজ খুঁজছে বিট্টুরা।
ছুটছে ট্রেন। ছুটছে জীবন । গ্রামের সুখ দুঃখ পৌঁছে দিচ্ছে শহরে। কার আশা শুশ্রুষার। কারো রুজির।

 

Comments :0

Login to leave a comment