Library condition

কর্মী নিয়োগ নেই, গ্রন্থাগার শুকিয়ে যাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গে

বিশেষ বিভাগ

দীপাঞ্জনা দাশগুপ্ত

ভারতের উত্তর পুর্বাঞ্চলের ছোট্টো রাজ্য মণিপুর। সেখানকার চুরাচন্দ্রপুর জেলার অন্তর্গত একটি প্রত্যন্ত গ্রাম মলনমে গান্ধী মেমোরিয়াল গভর্নমেন্ট হাই স্কুল। মণিপুর শিক্ষা দপ্তরকে অনেক চিঠি লিখেও লাইব্রেরি খোলার ব্যবস্থা করতে পারেনি স্কুল পরিচালনা কমিটি। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে সরকার ঘর দিলেও বই কেনার টাকা দেয়নি। কিন্তু লাইব্রেরি তো বাঁচাতে হবে! সেই কারণে বই চেয়ে ভিডিও করলেন প্রধান শিক্ষক হাউজেল কৈথানলিয়ান। এবং সেই ভিডিও মেসেজ সোশাল মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে দিলেন নিজের পরিচিত মহলে। পরে সেই ভিডিও টুইটারে শেয়ার করেন আরেক ব্যক্তি। তারপরে অবশ্য, বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বই দান করেছে স্কুলের লাইব্রেরিতে। ব্যক্তিগতভাবেও বেশ কয়েকজন বই দান করেছেন ওই স্কুলে। প্রথম থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ওই স্কুলের লাইব্রেরিতে এখন নিয়মিত যাচ্ছেন ছাত্র-ছাত্রীরা। প্রধান শিক্ষক জানিয়েছেন, ৯০০টির মতো বই পাওয়া গেছে, তবে প্রয়োজন আরও বইয়ের। 


মণিপুরের এই ছোট্ট একটি উদাহরণের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান চিত্রটি তুলনা করলে ভয়ঙ্কর ছবি সামনে আসছে। প্রথমত শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মী নিয়োগ দুর্নীতিতে জেরবার পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা দপ্তর বন্ধ করে দিতে চলেছে প্রায় ৮ হাজারটি সরকারি স্কুল। অজুহাত স্কুলে ছাত্র-ছাত্রী নেই। তেমনি বন্ধ হয়ে গেছে রাজ্য সরকারের অধীনস্ত গ্রন্থাগারগুলিও। পশ্চিমবঙ্গে সরকারি গ্রন্থাগার রয়েছে ১৩টি, ২৪৬৭টি সরকার পোষিত ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত সাধারণ গ্রন্থাগার রয়েছে। ১৩টি সরকারি গ্রন্থাগারের অনুমোদিত ১৬৪টি পদের মধ্যে ৮০টি শূন্যপদ। ২৪৬৭টি সরকার পোষিত ও সরকারি সাহায্যপ্রাপ্ত সাধারণ গ্রন্থাগারের অনুমোদিত ৫৫২০টি পদের মধ্যে ৪২০০টি শূন্যপদ। সরকারি সূত্রে বিভিন্ন জেলাগুলিতে কর্মীর অভাবে ৩৯২টি বন্ধ গ্রন্থাগারের কথা বলা হলেও যেভাবে প্রতিদিন কর্মীদের অবসরের সঙ্গে সঙ্গে শূন্যপদ তৈরি হচ্ছে তাতে প্রায় ৮৫ শতাংশ শূন্যপদ। বাস্তবে ১৩০০ গ্রন্থাগার বন্ধ। এই নিয়ে বঙ্গীয় গ্রন্থাগার পরিষদের কর্মসচিব ডক্টর জয়দীপ চন্দ জানান ‘একসময় পশ্চিমবঙ্গের গ্রন্থাগার ব্যবস্থা ছিল ভারতের মধ্যে সেরা। গ্রন্থাগার নির্ভর লেখাপড়ায় যথেষ্ট জোর দেওয়া হতো। কিন্তু ২০১০ সালের পর থেকে ক্রমেই নিম্নমুখী হয়েছে সাধারণের গ্রন্থাগার ব্যবস্থা। নতুন করে নিয়োগ হয়নি। সাড়ে পাঁচ হাজার পদের মধ্যে খালি ৪,২০০ পদ।’ তিনি আরও বলেন ২০২১ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে ভোটকে সামনে রেখে ৭৩৮টি পদে নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়। কিন্তু বাস্তবে কোনও নিয়োগই হয়নি। সরকারের কর্তাব্যক্তিদের মুখে প্রায়শই অজুহাত শোনা যায়, লাইব্রেরিতে পাঠকরা আসে না তাই লাইব্রেরিতে নিয়োগ করা হচ্ছে না। জয়দীপ চন্দ বলছেন, কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে লাইব্রেরি খুললে পাঠকরা আসেন। লাইব্রেরি দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলে পাঠকরা আসবেন না এটাই স্বাভাবিক।


ডক্টর জয়দীপ চন্দ আরও জানান, সরকারি স্কুল, কলেজগুলোর লাইব্রেরিতেও নিয়োগ করছে না সরকার। ফলে কর্মীর অভাবে লাইব্রেরি থেকে বই নিয়ে পড়তে পারেন না বহু পড়ুয়া। কর্মী না থাকা এবং লাইব্রেরি বন্ধ রাখার অজুহাতে স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে বই কেনার টাকাও অনেকক্ষেত্রেই দিচ্ছে না সরকার। স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের নিয়মিত দরকার হয় লাইব্রেরি। সুতরাং লাইব্রেরিতে পাঠক আসে না সরকারের এই যুক্তি খাটে না বলেই দাবি ড. চন্দর।
প্রসঙ্গত করোনা অতিমারীর সময় বন্ধ থাকা লাইব্রেরিগুলিতে নাকি নষ্ট হয়েছে লক্ষ লক্ষ টাকার বই, একথা বলেছিলেন রাজ্যের গ্রন্থাগার মন্ত্রী সিদ্দিকুল্লা চৌধুরি। সেসময় নষ্ট হয়ে যাওয়া বই বাদ দিয়ে নতুন বই কেনা, ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য বই কেনা ও দৃষ্টিহীন পড়ুয়াদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করা হবে লাইব্রেরিগুলোতে ইত্যাদি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি কিছুই।
মণিপুরের পূর্বোক্ত প্রধান শিক্ষক হাউজেল কৈথানলিয়ান জানান ‘বিদ্যালয়ের পঠন পাঠনের সঙ্গে লাইব্রেরি ভিত্তিক পড়াশুনো অত্যন্ত প্রয়োজন। এই ডিজিটাল যুগে মোবাইলে অনেক কিছু পাওয়া যায় ঠিকই কিন্তু তা লাইব্রেরির থেকে বেশি নয়। বই ঘাঁটলে, ছবি দেখলে বাচ্চাদের মধ্যে বই পড়ার আগ্রহ বাড়ে, সমাজ চেতনা বাড়ে, এমনকি জানার আগ্রহ থেকে ছেলে মেয়েদের মধ্যে ভবিষ্যতে নতুন কিছু করারও আগ্রহ জাগে। সেই কারণে আমরা বিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষিকারা সিদ্ধান্ত নিয়েছি শুধু পড়ার বই নয়, লাইব্রেরিতে গল্পের বই, ছবির বই এমনকি কমিকস স্ট্রিপও রাখবো যাতে বাচ্চারা বই পড়ার স্বাদটা খুঁজে পায় লাইব্রেরিতে।’

লাইব্রেরির নিয়ে মণিপুরের শিক্ষক হাউজেল কৈথানলিয়ানের উদ্যোগ সমর্থন করে এসএফআই’র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ময়ুখ বিশ্বাস বলেন ‘পশ্চিমবঙ্গে তো স্কুলই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তাই খুব স্বাভাবিক মুখ্যমন্ত্রী লাইব্রেরি নিয়ে মোটেই চিন্তিত হবেন না। বই পড়া কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা একজন প্রকৃত মানের শিক্ষক বুঝবেন সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে কি হচ্ছে তা তো সবারই জানা। সেখানে লাইব্রেরির শূন্যপদে নিয়োগ করছে না রাজ্য সরকার। বই পড়লে তো ছেলে মেয়েরা শিক্ষিত হবে, যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরি চাইবেন, সেটাই তো চাননা মুখ্যমন্ত্রী।’ তিনি আরও বলেন ‘রাজ্যে ৮ হাজার সরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার যে ন্যাশনাল এডুকেশন পলিসি এনেছে তা রাজ্যে গোপনে চালু করতে চাইছেন মমতা ব্যনার্জি। ছাত্র নেই এই অজুহাতে স্কুলগুলো বেসরকারি হাতে তুলে দেবে। খুব স্বাভাবিক এই ভাবে স্কুল কলেজের লাইব্রেরিগুলোও নষ্ট হয়ে যাবে।’ ময়ুখ বিশ্বাসের আরও আশঙ্কা ছাত্র-ছাত্রীদের এভাবেই বই বিমুখ করে তুলতে চাইছে তৃণমূল।’
যেখানে মণিপুরের একটি ছোট স্কুলের শিক্ষক লাইব্রেরি নিয়ে নতুনভাবে ভাবছেন সেখানে পশ্চিমবঙ্গে লাইব্রেরিগুলোতে শুধুই হতাশার ছাপ। তা নিয়ে ডক্টর জয়দীপ চন্দর আক্ষেপের সুরে বলেন ‘লাইব্রেরি রক্ষণাবেক্ষণের কাজ আর পাঁচটা কাজের থেকে আলাদা। এখানে পেশাদার কাজের মতো লাইব্রেরি রক্ষণাবেক্ষণেও বিশেষ যোগ্যতা লাগে। কারণ এর একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে। অপেশাদার লোকের পক্ষে লাইব্রেরিয়ানের কাজ করা সম্ভব নয়। আমরা একদিকে লাইব্রেরি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বিশেষ কোর্স করাচ্ছি কিন্তু অন্যদিকে লাইব্রেরিগুলিই বন্ধ করে দিচ্ছি। তাহলে ছেলেমেয়েরা এই সংক্রান্ত পড়াশুনা করেই বা কী করবে ভবিষ্যতে?’
পশ্চিমবঙ্গে বর্তমানে একেকজন গ্রন্থাগার কর্মীর ওপর তিন/চারটি গ্রন্থাগারের দায়িত্ব চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর ফলে চালু গ্রন্থাগারগুলিকেও বাস্তবে অচল করে দেওয়া হচ্ছে। ফলে সপ্তাহে একদিন বা দু’দিন করে খোলে সেই সব গ্রন্থাগার। পাঠকরা চাইলেও লাইব্রেরিতে যাওয়ার সুযোগ নেই। কিছু জেলাতে আবার তৃণমূল কর্মী সংগঠনের আশ্রয়ে থাকা কর্মীদের জেলা গ্রন্থাগারগুলি পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের কারোরই প্রায় লাইব্রেররি পরিচালনা করার মতো শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। 
গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান উত্তীর্ণদের অভিযোগ, গত এগারো বছর ধরে সাধারণ গ্রন্থাগার, স্কুল গ্রন্থাগারগুলিতে গ্রন্থাগারিক বা লাইব্রেরিয়ান নিয়োগ হয়নি। অনেকেই এই বিষয়ের ওপরে পড়াশুনো করে আজও বেকার। ইতিমধ্যে অনেকেরই বয়স চল্লিশের দোরগোড়ায় পৌঁছেও গেছে। কিন্তু গত ১১ বছরে আজও লাইব্রেরিয়ান নিযুক্ত করেনি সরকার। চাকরির দাবিতে লড়াই করতে হচ্ছে গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান উত্তীর্ণদের। সম্প্রতি ধর্মতলাতেও এই চাকরি প্রার্থীরা নিয়োগের দাবিতে অবস্থান করেছেন।


গ্রন্থাগার পরিচালনা নিয়ে পড়াশুনো শেষ করে চাকরি আশায় বসে আছেন এমনই একজন চাকরিপ্রার্থী বর্ণালী রায়। ২০১৫ সালে গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান নিয়ে স্নাতকোত্তর পরীক্ষায় পাশ করেছেন বর্ণালী। ২০২৪ সালের পর আর চাকরির পরীক্ষায় বসতে পারবেন না তিনি, কারণ চাকরির পরীক্ষায় বসার সর্বোচ্চ বয়সের উর্ধ্বসীমা পার করে যাবেন তিনি। চাকরি না পাওয়ার হতাশায় দিন কাটছে তার। তিনি বলেন 'জেলা ভিত্তিক গ্রন্থাগার গুলিতে নিয়োগের জন্য ২০২২ সালের মে মাসে বিজ্ঞপ্তি বেরিয়েছিল, কিন্তু নিয়োগ হয়নি। তারপর অনশনে বসে প্রতিবাদ করেন পশ্চিমবঙ্গ লাইব্রেরি আন্দোলনের চাকরিপ্রার্থীরা। এরপর পুনরায় বিজ্ঞপ্তি জারি হওয়ার কথা। কিন্তু আদপেও নিয়োগ হবে কি না জানা নেই।' বর্ণালী রায় আক্ষেপের সুরে বলেন ‘শুধু যে সাধারণ গ্রন্থাগারগুলোতে নিয়োগ বন্ধ তা নয়, বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারগুলোতেও ২০১২ সালের পর বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কোনও নিয়োগ হয়নি। ফলে কর্মীশূন্য বিদ্যালয় গ্রন্থাগারগুলো কিভাবে চলছে তা বোঝাই যাচ্ছে। সেখানেও মারাত্মক অচলাবস্থা। শিক্ষক শিক্ষিকা দিয়ে সপ্তাহে একদিন-দু’দিন করে লাইব্রেরি খোলা হয়। ভবিষ্যৎ নষ্ট করা হচ্ছে পড়ুয়াদের। বই চাইলেও বই পড়তে পারে না তারা।’ 


পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই চাকরিতে নিয়োগের সম্ভাবনা শেষ হয়ে গেছে। যেমন সরকারি ক্ষেত্রে নিয়োগ নেই, তেমনি বেসরকারি সংস্থাগুলিতেও চাকরি নেই। সরকারি স্কুলে পঠনপাঠনের সঙ্গে চক্রান্ত করে বন্ধ করা হচ্ছে গ্রন্থাগারগুলোও। যাতে নতুন প্রজন্মকে শিক্ষার মান ও যোগ্যতা থেকে শত যোজন দূরে রাখা যায়। শিক্ষাবিদদের একাংশের অভিযোগ, শিক্ষাকে যদি কেবল ব্যবসায়িক দৃষ্টিতে দেখা হয়, শিক্ষা ব্যবস্থা যদি ব্যবসায়ীদের হাতে চলে যায় তাহলে গ্রন্থাগারের ভবিষ্যৎ বলেও কিছু থাকবে না। শিক্ষা ও চেতনার মান বাড়ানোর জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই গ্রন্থাগার পরিষেবা দেওয়া প্রয়োজন, মিশনারি লক্ষ্য নিয়ে অবাণিজ্যিক ও সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলিও একাজে সম্পূরক ভূমিকা নিতে পারে। কিন্তু লাভ ক্ষতির হিসাব কষলে গ্রন্থাগার বন্ধই হয়ে যাবে। এই জন্যই গ্রন্থাগার চালু রাখতে সরকারের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
তৃণমূলের বর্তমান সরকার শিক্ষা প্রসারে গ্রন্থাগারে কর্মী নিয়োগে অনীহা দেখালেও, বই কেনার টাকা দেওয়ায় ক্ষেত্রে টাকা নেই বলে হাত গোটালেও, সঙ্কীর্ণ রাজনীতির বেলায় কিন্তু গ্রন্থাগারগুলিকে ব্যবহারেও দ্বিধা করেনি। যেভাবে তৃণমূলের নৈরাজ্যবাদী ধ্বংসাত্মক দৃষ্টিতে সিঙ্গুর নন্দীগ্রামের কথা পাঠ্যবইতে ঢোকানো হয়েছে, সেভাবেই মমতা ব্যানার্জির লেখা কবিতার বইকে সরকারি অর্থে গ্রন্থাগারে কিনে সাজানো হয়েছে। এই রাজনীতিতে গ্রন্থাগারের উন্নয়ন কে আশা করতে পারে!
 

Comments :0

Login to leave a comment