কেন ভোট কোথায় ভোট
-----------
বিজেপি বলছে মোদীর কথা। তৃণমূল বলছে মমতা ব্যানার্জির কথা। মানুষের কথা কী? তা বামফ্রন্ট, কংগ্রেস এবং তাদের সহযোগীদের গলায়। ‘আম আদমি’র সেই সব কথাই বলছে এই প্রতিবেদন।
--------------------------
সত্যব্রত ভট্টাচার্য: রানাঘাট
‘‘মুকুটমণি কাল ছিল বিজেপি’র এমএলএ। আজ তৃণমূলের প্রার্থী। কাল ছিল সিএএ-র পক্ষে। আজ তবে কী বলবে?’’
মুকুটমণি অধিকারী বিজেপি’র বিধায়ক ছিলেন। এবার তৃণমূলের প্রার্থী, রানাঘাটে। যোগেন বিশ্বাস তাঁকে নিয়েই বলছিলেন।
যোগেন বিশ্বাসের প্রশ্ন রানাঘাট লোকসভা আসনের সাতটি বিধানসভার বিপুল অংশের মানুষের প্রশ্ন। যোগেন বিশ্বাস মতুয়া সম্প্রদায়ভুক্ত। পায়রাডাঙা বাজারে তিনি সবজি বিক্রি করেন। সিপিআি(এম)’র প্রচার চলছে। সেই সময়েই যোগেন বিশ্বাসের সঙ্গে কথা। তাঁর পাশেই ছিলেন তপন দাস। তাঁরও একই পেশা। তিনি আলোচনায় ঢুকে পড়লেন টি টুয়েন্টির ব্যাটারদের মতো। বললেন,‘‘আজ যে বিজেপি- কাল সে তৃণমূল। আমরা তো তেমন নই। খেলার পুতুল নই। আমরা এ দেশের নাগরিক। বারবার নাগরিকত্বের নামে ভোটের আগে আমাদের পুতুলের মতো নাচাবে? ভোট নেবে বারবার একই কথা বলে?’’ তাঁর আর একটু সংযোজন ছিল। বললেন,‘‘এরা কী মনে করে? আমাদের আর কোনও চাওয়া পাওয়া নেই?’’
শনিবার বেলা প্রায় সাড়ে এগারোটা, রানাঘাট কেন্দ্রের পায়রাডাঙা বাজারে জোর কদমে প্রচার চলছে বামফ্রন্ট সমর্থিত সিপিআই(এম) প্রার্থী প্রাক্তন সাংসদ অলকেশ দাসের। সেই প্রচারের ফাঁকেই ছুটে এসে প্রার্থীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে গিয়েছিলেন প্রীতিনগর বাজারের মাছ ব্যবসায়ী ভগবতী।
কী মনে হচ্ছে এবার? প্রশ্ন শুনে দাঁড়িয়েছিলেন ভগবতী পাত্র। বললেন, ‘কী আবার মনে হবে, এরপর ওই তৃণমূল দলটার অস্তিত্বই থাকবে না’। আর বিজেপি? প্রৌঢ়ার বক্তব্য, ‘ওদের ভাঁওতা ধরে ফেলেছি, এখানে আর বেশিদিন টিকতে পারবে না।’
তৃণমূল প্রার্থী মুকুটমণি অধিকারীকে নিয়ে যেমন প্রশ্ন আছে, বিজেপি’র প্রার্থী জগন্নাথ সরকার সম্পর্কে হতাশা মানুষ। সেই হতাশা গোপন করতে পারছেন না এলাকার বিজেপি কর্মীরা। পাঁচ বছরে রানাঘাটের জন্য বিজেপি কী কী করেছে, স্পষ্ট কথা নেই তাদের।
শনিবার প্রচারের ফাঁকে সে কথাই বিভিন্ন তথ্য দিয়ে তুলে ধরলেন বাম প্রার্থী অলকেশ দাস। এদিন সকাল থেকে বিভিন্ন এলাকায় ভোট প্রচার সেরে তিনি পৌঁছান পায়রাডাঙা স্টেশন সংলগ্ন এলাকায়। সেখানে অপেক্ষা করছিলেন সিপিআই(এম) ও কংগ্রেস কর্মীরা। এরপর বাজার এলাকা পরিক্রমা করেন তাঁরা। অসংখ্য লাল ঝান্ডা, লাল বেলুনে ঢেকে যায় গোটা বাজার এলাকা, রাস্তাঘাট। ক্রেতা বিক্রেতা, পথচলতি মানুষের সঙ্গে কথা বলেন প্রার্থী। প্রার্থীর সঙ্গে এগিয়ে এসে হাত মেলান তাঁরা। অলকেশ দাস বলেন, বাম- কংগ্রেসের মিলিত লড়াইয়ের প্রতি আস্থা রাখছেন বহু মানুষ। এই দৃশ্য তার প্রমাণ।
এরই মাঝে উলটো সুরও আছে। শোনা গেল এদিন। বাজারের মধ্যেই এক তৃণমূল সমর্থক, এক বিক্রেতা লাল ঝান্ডার মিছিলের দিকে তাকিয়ে বলে উঠেছিলেন, ‘কী হবে বামেদের ভোট দিয়ে, কোনও আশা আছে কি?’ সঙ্গে সঙ্গেই তাঁকে থামিয়ে দিয়েছিলেন সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা তাঁরই কয়েকজন ক্রেতা। তাঁরা বলেছিলেন, ‘‘তাহলে চোরেদের ভোট দিও। সিপিআই(এম)’র কোনও নেতাকে চুরি করে জেলে যেতে দেখেছো কী?’’
শুক্রবার ঠাকুরনগর স্টেশনে সামাজিক ন্যায় মঞ্চ ও মতুয়া সংহতি’র উদ্যোগে ঠাকুরনগর স্টেশন চত্বরে একটি জলসত্র ও বুকস্টলের উদ্বোধন হয়েছে। এই উদ্যোগে উপস্থিত ছিলেন সিপিআই(এম) প্রার্থী অলকেশ দাস। ২০১৯ সালে বিজেপি’র উত্থান হয় মূলত নাগরিকত্বের কথা এনে। ২০২১ সালের পর ২০২৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনে একটা ধাক্কা খায় বিজেপি। রানাঘাট কেন্দ্র এবং বনগাঁ কেন্দ্রে মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ রয়েছেন, আছেন পূর্ববঙ্গের থেকে আসা বহু মানুষ, নমশূদ্র, তফসিলি মানুষ। বিজেপি তাঁদের ভোট পাওয়ার জন্য এখন নাগরিকত্বের কথা বলছে।
অলকেশ দাস বলেন, নদীয়া জেলা আরএসএস-এর এক বড় ক্ষেত্র। হিন্দুত্ব নিয়ে তাই কায়েম হওয়ার চেষ্টা করছে তারা। তবে ধর্ম সেভাবে এখানে মাথা তুলতে পারছে না কারণ নানা সমস্যা মানুষকে ঘিরে ধরেছে এখন। শান্তনু ঠাকুর বললেই তা শুনতে হবে কেন, এই প্রশ্ন উঠছে। হরিচাঁদ গুরুচাঁদ ঠাকুরের আদর্শ বিজেপি’র সঙ্গে মেলে না। কিন্তু তাঁদের নাম করে বিজেপি রাজনীতি করছে। এতে মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষ বিভ্রান্ত। বামেরা এই দিকটি তুলে ধরছেন বেশি করে। বিজেপি’র সঙ্গে তৃণমূলের নানা ঘনিষ্ঠ বোঝাপড়াও সামনে এসে গেছে সবার। ফলে ভোট টানতে চাপে পড়েছে তৃণমূলও। বস্তুত তৃণমূল এখনও নানাভাবে সুবিধা করে দিতে চাইছে দিয়েছে বিজেপিকে। এর প্রমাণ, রাজ্য সরকারের উদ্বাস্তু দপ্তরটিকে অবহেলিত রাখা হয়েছে। সরকারি জমি নয়, এমন জমি দেওয়া হচ্ছে উদ্বাস্তুদের। এভাবে চলছে প্রতারণা। বাম সরকারের সময়ে যে সব উন্নয়নের কাজের শুরু হয়েছিল, গত ১২ বছরেও তা এই সরকার সম্পূর্ণ করতে পারেনি অনেক ক্ষেত্রেই।
-
Comments :0