সন্দেশখালি, জেলিয়াখালি, ঝুপখালির পর তৃণমূলের অত্যাচারের বিরুদ্ধে ক্ষোভে উত্তাল হলো তেভাগার আন্দোলনের মাটি কাছারিবাড়ি। পুলিশ বিক্ষোভ ঠেকাতে এক উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সহ ৫ ছাত্রকে গ্রেপ্তার করে। এতে বিক্ষোভ আরও প্রবল হয়ে ওঠে। এদিনই সন্দেশখালি-২নং ব্লকের তুষখালিতে ৭ বছর পর লালঝান্ডা ওড়িয়ে দেন গ্রামবাসীরা। হয় মিছিলও।
এদিন ভোরের আলো তখন সবে ফুটেছে। গ্রামবাসীদের রোষে জ্বলতে দেখা গেল তৃণমূলের অঞ্চল সম্পাদক অজিত মাইতির মেছোঘেরি। যার আঁচ একসময় গিয়ে পড়ে তার বাড়িতে। সেখানে উত্তেজিত গ্রামবাসীরা ধরে ফেলে অজিত মাইতিকে। চলে উত্তম মধ্যম। কোনক্রমে পালিয়ে যায় এই তৃণমূল নেতা। এরপর উত্তেজিত গ্রামবাসীরা চড়াও হয় তার বাড়িতে। হয় ভাঙচুর। পুলিশের উচ্চ পদস্থ আধিকারিকরা ঘটনাস্থলে আসেন। আসেন ডিজি, এডিজি। সেখ শাহজাহান, সেখ সিরাজউদ্দিন, অজিত মাইতির সহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ করতে থাকেন গ্রামবাসীরা। পুলিশ আধিকারিকরা আশ্বস্ত করার চেষ্টা করতে থাকেন। পুলিশ আসায় সাহস পেয়ে অজিত মাইতি এলে ফের তাকে ঘিরে বিক্ষোভ শুরু হয়। এবার পুলিশ অজিত মাইতিকে বাঁচায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে এডিজি সুপ্রতীম সরকার, ডিআইজি(বারাসত রেঞ্জ) ভাস্কর মুখার্জি ঘটনাস্থলে যান। পুলিশের সামনেই নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, জমি লুট সহ একাধিক অভিযোগে সেখ শাহজাহান, সেখ সিরাজউদ্দিন, অজিত মাইতি সহ তৃণমূলের আরও নেতাদের গ্রেপ্তারের দাবিতে চিৎকার করেন গ্রামভাসীরা। এদের সবাইকে গ্রেপ্তার করতে হবে। যতক্ষন না আমাদের ঘরের পুরুষদের না ছাড়বে ততক্ষণ আন্দোলন চলবে।
শুক্রবার সন্দেশখালিতে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে রাজ্য পুলিশের ডিজি রাজীব কুমার দাবি করেন,‘‘সন্দেশখালিতে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠাই আমাদের এক একমাত্র লক্ষ্য।’’ এদিন বেড়মজুর ১ও ২নং গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় জারি হয়েছে ১৪৪ধারা। শুক্রবার দুপুর ১২টা থেকে ২৬ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টা পর্যন্ত এই ধারা বলবৎ থাকবে বলে পুলিশের পক্ষ থেকে মাইক ফুঁকে এলাকায় জানিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু গ্রামবাসীদের বক্তব্য, শাহজাহান, সেখ সিরাজউদ্দিন, সেখ আলমগীর, সিদ্দিক মোল্লা, অজিত মাইতি, শঙ্কর সর্দার, স্বপন বাড়াই, রঞ্জিত বাড়াই সহ বাকিদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলেই গ্রামে গ্রামে শান্তি ফিরবে।
বৃহস্পতিবার সন্দেশখালি-২নং ব্লকের বেড়মজুর -২পঞ্চায়েতের ঝুপখালিতে জমি উদ্ধারে নামেন গ্রামের মানুষ। ঝুপখালিতে সেখ শাহজাহানের মেজো ভাই সেখ সিরাজউদ্দিন ওরফে সিরিজ ডাক্তারের দখল করা মেছোঘেরির আলাঘরে আগুন লাগিয়ে দেয় গ্রামবাসীদের একাংশ। সিরাজউদ্দিন তাড়া খেয়ে বাইকে চেপে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। শুক্রবার সেই ক্ষোভের আঁচ এসে পড়ে তেভাগা আন্দোলনের পীঠস্থান বেড়মজুর -১ পঞ্চায়েতের কাছারিপাড়ায়। সেখানেও আয়লা পরবর্তী নদীর কংক্রিটের বাঁধ বরাবর ৪০-৪২বিঘা মেছোঘেরি দখল করে মাছ চাষ করছিল এই সেখ সিরাজউদ্দিন। সেই মেছোঘেরির আলাঘরে ফের আগুন লাগিয়ে দেয় গ্রামবাসীদের একাংশ। এরপর উত্তপ্ত হয়ে ওঠে গোটা এলাকা। রাজ্য পুলিশের ডিজি এডিজি, পুলিশ সুপার বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে ঘটনাস্থলে এলেও মানুষ চুপ করেননি। পুলিশ শুরু করে ধরপাকড়। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সৌমেন দাস সহ ৫জনকে পুলিশ আটক করলে গ্রামবাসীদের ক্ষোভ আছড়ে পড়ে। সৌমেন দাসের মা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলতে থাকেন কাল ছেলের শেষ পরীক্ষা। মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে হাত জোড় করে মিনতি করতে থাকেন আর বলতে থাকেন আমার ছেলের ভবিষ্যত নষ্ট করে দেবেন না। এরপর শুরু হয় দফায় দফায় বিক্ষোভ। মহিলারা লাঠি ঝাটা হাতে নিয়ে ফের রাস্তায় নেমে আসে। তাঁরা বলতে থাকে আমাদের ঘরের পুরুষদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের খাওয়ার রাস্তা বন্ধ করে দিচ্ছে। আমরা কার কাছে যাবো? পুলিশের বিরুদ্ধে ক্ষোভের আগুন চড়তে থাকে। ঝুপখালি,কাছারি পাড়া সর্বত্র বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় ধামাখালি সরবেড়িয়া যাওয়ার রাস্তা সহ গ্রামের বিভিন্ন রাস্তায় গাছের গুঁড়ি ফেলে আগুন জ্বালিয়ে, বিদ্যুতের পোষ্ট দিয়ে রাস্তা অবরোধ। পুলিশ আটক ৫জনকে নিয়ে কোনমতে এলাকা ছাড়ার সময় বিক্ষোভকারী এক মহিলা, ফুলমনি ভুঁইঞাকে ধাক্কা দিয়ে চলে যায় বলে অভিযোগ। মহিলা সংজ্ঞা হারান। যদিও পুলিশ ঘটনা অস্বীকার করে।
সন্দেশখালি, জেলিয়াখালির পর বেড়মজুর-২পঞ্চায়েতের ঝুপখালি বৃহস্পতিবার উত্তপ্ত হয়েছিল। শুক্রবার সেখানে যান সন্দেশখালি -২ব্লকের বিডিও। তিনি মানুষের অভাব অভিযোগ শুনতে গেলে বিক্ষোভের মুখে পড়েন। ক্ষোভে প্রলেপ দিতে বিডিও গ্রামে পৌঁছাতে কাঠের সেতু পেরুতে গিয়ে ভেঙে পড়তেই তাঁকে ধরে ফেলেন স্থানীয় যুবক। বিডিও প্রত্যক্ষ করলেন কংক্রিটের সেতুর টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে এ কথা সত্য যা গ্রামবাসীদের দীর্ঘদিনের অভিযোগ ছিল। তা তিনি এদিন মেনেও নেন এবং বলেন, বেড়মজুর এলাকায় হাটখোলা ও নতুন পাড়ায় ক্যাম্প খোলা হয়েছে। যার যা অভিযোগ আছে তা ক্যাম্পে এসে জানান। আমরা সমস্যার সমাধান করবো। ক্যাম্পে কর্মরত এক কর্মীকে জিজ্ঞাসা করা হয় ক্যাম্প কতদিন ধরে চলছে।কর্মরত কর্মী বলেন একমাস ধরে চলছে।যা শুনে গ্রামের অধিকাংশ যুবক জানান আমরা কোনদিন এই ধরনের ক্যাম্প দেখিনি।আজ দেখছি।
এদিন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের কয়েকজন সদস্য ও কামদুনির প্রতিবাদী মহিলা মৌসুমী কয়াল, টুম্পা কয়াল সহ অন্যান্যরা সন্দেশখালি যায় সেখানে পাত্র পাড়া কলোনি পাড়া সহ বিভিন্ন গ্রামে যান। কথা বলেন নির্যাতিতাদের সঙ্গে। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সদস্যরা বৈঠক করেন পুলিশ আধিকারীকদের সঙ্গে।
Comments :0