শিল্পী চক্রবর্তী
১৯১৮-১৯ সালে 'বেঙ্গল আয়রন কোম্পানি' হিরাপুরে গড়ে তোলে একটি লৌহ ইস্পাত কারখানা। ১৯৩৭ সালে এর পাশেই গড়ে ওঠে আরেকটি কারখানা 'স্টিল কর্পোরেশন অব বেঙ্গল'। ১৯৫৩ সালে এই দুটি কারখানার সংযুক্তি ঘটিয়ে একটি সংস্থায় পরিণত হয়, যার নাম দেওয়া হয় 'ইন্ডিয়ান আয়রন অ্যা ন্ড স্টিল কোম্পানি' ( IISCO)। পূর্বতন বিলেতি কোম্পানি মার্টিন আর বার্ন মিলিত হওয়া ‘মার্টিন বার্ন কোম্পানির’ অধীনেই গড়ে ওঠে ইসকো যা ক্রমশ একটি সুসংহত ইস্পাত নির্মাণ সংস্থার পরিণত হয়, এর মালিক ছিলেন রাজেন মুখার্জি এবং পরে তাঁর পুত্র স্যার বীরেন মুখার্জি। এই 'ইসকো' কারখানার শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ আন্দোলন ক্রমশ সংগ্রামের প্রতীক হয়ে উঠেছে আসানসোল শিল্পাঞ্চলে।
কমরেড বামাপদ মুখার্জি ও কমরেড চন্দ্রশেখর মুখার্জির আমন্ত্রণে ১৯৫২ সালে এই শিল্পাঞ্চলে এসে অরুণা আসাফ আলি বার্নপুরে একটি জনসভায় বলেন "আপনাদের জন্য দক্ষিণপন্থী ট্রেড ইউনিয়ন কিছু করবে না। আপনারা অ্যাকশন কমিটি গঠন করুন"। তারপরেই শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ততায় চন্দ্রশেখর মুখার্জি ও কমরেড তাহের হুসেনের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে 'অ্যাকশন কমিটি'। ১৯৫৩ সাল পিডি অ্যাক্টে নেতৃত্বকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার হন ভাতখণ্ডে, দিলীপ গুপ্ত, তাহের হোসেন, হিমাংশু চট্টরাজ। প্রতিবাদে ১৪৪ ধারা আইন অমান্য করে বিশাল মিছিল সংঘটিত হয় যা ১৯৫৩ সালের '৫ই জুলাই' আন্দোলন নামে খ্যাত, এই মিছিল মহকুমা শাসকের দপ্তরের সামনে এগিয়ে গেলে পুলিশ নির্বিচারে ও বিনা প্ররোচনায় নিরস্ত্র শ্রমিকদের ওপরে লাঠি ও গুলি চালায়। গুলিতে নিহত হয় রোল মিলের শ্রমিক ভোলাপান্ডে, বার্ন স্ট্যান্ডার্ডের শ্রমিক জগন্নাথ সোনার, পবন ধীবর, কানাই সাউ, শিউ বরন, রামদেও ও আরও একজন শ্রমিক সহ ৭ জন। পিডি অ্যাক্টে গ্রেপ্তার হন বামাপদ মুখার্জি, চন্দ্রশেখর মুখার্জির মতো নেতৃবৃন্দ। আন্দোলন শুরু হয়েছিল শিট মিলে, যা ছড়িয়ে পড়েছিল কারখানা জুড়ে। ‘অ্যাকশন কমিটি’ পরবর্তীকালে AITUC অনুমোদিত শ্রমিক সংগঠন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে যার সভাপতি হয়েছিলেন কমরেড ডাঙ্গে এবং সহ সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন কমরেড চন্দ্রশেখর মুখোপাধ্যায়। ১৯৫৩ সালের এই ঐতিহাসিক আন্দোলন গড়ে তুলতে শহীদরা নিজেদের রক্ত দিয়েছিলেন, সেই ঐতিহ্য বার্নপুর আজও বহন করে চলেছে।
ইস্পাত কারখানায় ষাটের দশকে শুরু হয় পুনরুত্থানের আন্দোলন। ইসকো পুনরুজ্জীবনে আধুনিকীকরণ ও সম্প্রসারণের জন্য বার্নপুরকে কেন্দ্র করে আয়রন স্টিল ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন ও ইউনাইটেড কন্ট্রাকটরস ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের (সিআইটিইউ) নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল ‘ইসকো বাঁচাও’ কমিটি। কেন্দ্রীয় সরকার চেয়েছিল কারখানাটিকে রুগ্ন বলে 'মুকুন্দ আয়রন অ্যান্ড স্টিল' কোম্পানিকে বেচে দিতে। বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল কারখানার অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা পাঁচটি শ্রমিক ইউনিয়ন। সে সময় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বলেছিলেন ‘যদি কারখানার গেটে তালা পড়ে যায় তাহলে এই পাঁচটা ঝান্ডাধারী ইউনিয়নের নেতৃত্বে যে শ্রমিকরা আছে তাদের প্রত্যেকেরই চোখের জল এক হবে, প্রত্যেকের পেটের খিদে এক হবে। তাই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে পাঁচটা ঝান্ডার শ্রমিক ইউনিয়নকে, গড়ে তুলতে হবে প্রতিরোধ, গড়ে তুলতে হবে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন।’ তাই সেদিন ‘Save IISCO’ কমিটি গড়ে উঠেছিল ।
প্রথম পর্যায়ে ইসকো আধুনিকীকরণের ধরনটা ছিল এক রকমের, সেখানে দক্ষ এবং অদক্ষ শ্রমিকের কাজের সুযোগ ছিল। আর এই শ্রমিকরা আসতেন মূলত ইসকো কারখানাকে ঘিরে যে শহর গড়ে উঠেছিল সেই শহর ও শহরতলি থেকে এবং এই কারখানার পাশ দিয়ে বয়ে চলা দামোদর নদের ওপার থেকে। কিন্তু প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কারখানার ভেতরে সংগঠিত শ্রমিকের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছিল, আর বেড়ে চলেছিল অসংগঠিত শ্রমিকের সংখ্যা। এই পর্যায়ে শ্রমিকের স্বার্থবাহী সংগঠনগুলির কারখানার অভ্যন্তরে কাজ করার ক্ষমতা নানা কারণে বিঘ্নিত হচ্ছে, তার অন্যতম ছিল কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী নীতি, মাফিয়ারাজ ও শ্রমিক সংগঠনগুলির আদর্শহীনতা। এর মধ্যেও বিগত দু’-তিনটে শিল্প ধর্মঘটে এখানকার শ্রমিক সংগঠনগুলি নজির স্থাপন করেছিল। আজকের দিনে এই শ্রমিক সংগঠনগুলিকে বহু প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। সেদিনের ‘ইস্কো বাঁচাও’ আন্দোলন বাঁচিয়ে দিয়েছিল ইসকো কারখানা ও শিল্পাঞ্চলকে।
আজকের দিনে SAIL ISP কারখানা যখন দাঁড়িয়ে রয়েছে নতুন আধুনিকীকরণের পর্যায়ে, তখনও আমরা ভুলতে পারিনা সেই ১৯৫৩ সালের ৫ জুলাই দিনটিকে। পশ্চিমবাংলায় ২০১১ সালে যখন তৃণমূলের সরকার প্রতিষ্ঠিত হয় ঠিক সেই বছর থেকেই শুরু হয়ে যায় হিংস্র সন্ত্রাসের রাজনীতি বার্নপুরের সাত বছরের পুষ্পা ঠাকুরকে নৃশংস খুনের মধ্য দিয়ে। ওরা চেয়েছিল দুর্বার শ্রমিক আন্দোলন ও গণআন্দোলনের বার্নপুরের বুকে ভয় ধরাতে। ওরা খুন করেছিল কমরেড নির্গুণ দুবেকে এই ৫ জুলাই। পরপর খুন করেছিল বামাপদ মুখার্জির পুত্র অর্পণ মুখার্জি, দিলীপ সরকারকে। রহস্যজনকভাবে মৃত্যু হয়েছিল বার্নপুরের গণআন্দোলনের আরেক নেতা কমরেড দিলীপ ঘোষের। ২০১১ সালের পর থেকে ৫ জুলাই তাই স্মরণ করা হয় একই সাথে ১৯৫৩ সালের শহীদদের ও শহীদ কমরেড নির্গুণ দুবেকে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে আগামী ৯জুলাই আমাদের সামনে চ্যালেঞ্জ। ধর্মঘট আমাদের সব থেকে শক্তিশালী হাতিয়ার, বার্নপুর শিল্পাঞ্চলেও তার ব্যতিক্রম ঘটবে না। ২০২১ সালের ৩০ জুন শ্রমিকদের যৌথ মঞ্চ কারখানার ম্যানেজমেন্টের বুকে ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল, এরপর ২০২৪ সালের ২৮ অক্টোবর কারখানায় ৯৮ শতাংশ ধর্মঘট সফল হয়। তারপরেই শ্রমিকদের এই ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে ম্যানেজমেন্ট ঝাঁপিয়ে পড়ে, ৪৫ জন অসংগঠিত ও সংগঠিত শ্রমিক কর্মচারীকে সাসপেন্ড ও বদলি করে। সাসপেন্ডেড কয়েকজনের জন্য আজও শ্রমিক সংগঠনগুলি আইনি লড়াই করছে। শ্রমিকদের এই মরিয়া প্রতিরোধে ম্যানেজমেন্ট কয়েকজন আধিকারিককে শাস্তিমূলক বদলি করে দেয়। তাই এবারের ধর্মঘটে আক্রমণ আরও তীব্রতর হবে। মাফিয়ারাজ ও ম্যানেজমেন্টের যৌথ আক্রমণে শ্রমিকেরা ক্ষতবিক্ষত হলেও গত মে দিবসের দিনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছেন ৯ জুলাই ধর্মঘটকে সর্বাত্মক করার জন্য। শহীদদের মৃত্যুতেও লড়াইয়ের শেষ হয়নি, নতুন সংগ্রামের শুরু করতে প্রস্তুত হচ্ছেন শ্রমিকরা।
IISCO STRIKE
শহীদরা প্রেরণা জোগাচ্ছেন ধর্মঘটের লড়াইতে

×
Comments :0