ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকালকেও হার মানিয়েছে নরেন্দ্র মোদীর রাজত্বকালে ভারতের আয় ও সম্পদের বৈষম্য। একারণেই এখনকার সময়কে ‘কোটিপতি-রাজ’ চলছে বলে চিহ্নিত করা হয়েছে নানা অর্থনৈতিক সমীক্ষার মতো এক গবেষণাপত্রেও। নজর করার মতো বিষয় হলো, ২০১৪-১৫ সালের পর থেকে ভারতে সবচেয়ে বেশি সম্পদ কেন্দ্রীভূত হয়েছে কতিপয়ের হাতে। স্পষ্টতই, মোদীর আমলেই সম্পদের কেন্দ্রীভবন চরম আকার নিয়েছে। সম্প্রতি প্যারিসভিত্তিক ‘ওয়ার্ল্ড ইনইক্যুইলিটি ল্যাব’ প্রকাশিত গবেষণাপত্রে তথ্য-পরিসংখ্যান দিয়ে ভারতের এই বৈষম্যের ছবি বেআব্রু করে দিয়েছে আরও। বলা হয়েছে, এই সময়কালেই এদেশের ওপর সারির ১ শতাংশের কবজায় রয়েছে আয়ের ২২.৬ শতাংশ এবং সম্পদের ৪০.১% অংশ। এমনকি ভারতীয় ধনীদের শীর্ষ ১ শতাংশের আয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রাজিলের ধনীদের থেকেও বেশি, বলা হয়েছে গবেষণাপত্রেই। একারণে ভারতের এই বৈষম্যকে ‘ঐতিহাসিকভাবে সর্বোচ্চ সীমা ছুঁয়েছে’ বলে মন্তব্য করা হয়েছে। বস্তুত, একারণেই ‘এদেশে কর্পোরেট-সাম্প্রদায়িক আঁতাত লুট করে চলেছে জাতীয় সম্পদ। যার জেরে ধনী আরও ধনী হচ্ছে এবং গরিবকে আরও গরিব করে দেওয়া হচ্ছে’ বলে অভিযোগ করেছেন সিপিআই(এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। আবার এই চরম অর্থনৈতিক বৈষম্যের মধ্যেই বুধবার প্রধানমন্ত্রী মোদী ভারতকে ‘তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতিতে’ পরিণত করার ‘খোয়াব’ শুনিয়েছেন।
‘ইনকাম অ্যান্ড ওয়েলথ ইনইক্যুইলিটি ইন ইন্ডিয়া, ১৯২২-২০২৩: দ্য রাইস অব দ্য বিলিওনিয়ার রাজ’ শীর্ষক এই গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে প্যারিসভিত্তিক ওই সংস্থাটি। গবেষণাপত্রের তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ‘ভারতের আয় এবং সম্পদের বৈষম্য, ১৯২২-২০২৩: কোটিপতি-রাজ’। এই গবেষণায় যুক্ত ছিলেন টমাস পিকেটি, লুকাস চ্যান্সেল এবং নীতিন কুমার ভারতী। লক্ষণীয় বিষয় হলো, গবেষণার সময়কাল ধরা হয়েছে একশো বছর। ফলে ব্রিটিশ শাসনকালের সঙ্গে স্বাধীনোত্তর ভারতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতির তুল্যমূল্য পর্যালোচনা করেই বৈষম্যের এমন ভয়ঙ্কর ছবি উঠে এসেছে গবেষণায়। সেই মূল্যায়ন করতে গিয়েই মোদী আমলে অসাম্য আরও তীব্র আকার নিয়েছে বলেই স্পষ্ট জানিয়েছেন তিন গবেষক। গবেষণায় বলা হয়েছে, ‘১৯৮০ সাল থেকে ঊর্ধ্বগতি হলেও ২০১৪-১৫ থেকে ২০২২-২৩ সালের মধ্যে বৈষম্য বিপুল মাত্রায় বেড়েছে এবং সম্পদের কেন্দ্রীভবনও প্রকট হয়েছে।’
তবে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর ধনী-দরিদ্রের মধ্যে আয় বা সম্পদ বণ্টনের ক্ষেত্রে বৈষম্য বেশ কমে গিয়েছিল বলে জানানো হয়েছে ওই গবেষণাপত্রে। ১৯৮০ সাল থেকে ছবি বদলে যেতে থাকে। ১৯৯১ সালে উদার অর্থনীতি ঘোষিতভাবে বিস্তার লাভ করায় বৈষম্যের রেখচিত্র বদলাতে শুরু করে। ২০০০ সাল থেকে গতি বাড়লেও চরম আকার নিয়েছে মোদীর আমলেই। পিকেটি-চ্যান্সেল অতীতেও ভারতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কিত গবেষণায় একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। গতবারের মতো এবারও তাঁরা ‘সম্পদের নিরিখে ভারতের আয়কর ব্যবস্থা অত্যন্ত পশ্চাদমুখী’ বলে মন্তব্য করেছেন গবেষণাপত্রে। উলটে তাঁরা আয় এবং সম্পদের মূল্যায়নে কর কাঠামো পরিবর্তনের সুপারিশ করেছেন। এরই সঙ্গে গবেষণাপত্রে স্বাস্থ্য, শিক্ষা, এবং পুষ্টি ক্ষেত্রে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। গড় ভারতীয়ের দিকে তাকিয়েই এই বিনিয়োগ প্রয়োজন, মোটেই ধনীদের স্বার্থে নয়। বিশ্বায়নের আবহে এর ফলে অর্থবহ সুফল ভোগ করতে পারবেন গড় ভারতীয়রা বলে মনে করা হয়েছে। এরই সঙ্গে বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে হাতিয়ার হিসাবে দেশের ১৬৭ ধনী পরিবারগুলির মোট সম্পদের ওপর ২ শতাংশ ‘সুপার ট্যাক্স’ চাপানোর কথা বলেছেন তিন গবেষক। এই কর চাপালে জাতীয় আয়ের ০.৫ শতাংশ রাজস্ব আসতো, যার ফলে যে আর্থিক পরিসর তৈরি হতো তা দিয়ে ওই ধরনের সামাজিক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ বাড়ানো যেত।
প্রকৃত ছবি আড়াল করতেই অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান চেপে রাখা হয় নরেন্দ্র মোদীদের আমলে— এমন অভিযোগ বহুদিনের। এই গবেষণাপত্রেও অভিযোগ করা হয়েছে যে, ভারতে অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানের মান অত্যন্ত খারাপ। আর সাম্প্রতিক সময়ে এর আরও অবনতি ঘটেছে। এমন ধরনের তথ্যের ভিত্তিতে প্রকৃত বৈষম্যের ছবি কখনোই সঠিক ধরা পড়া সম্ভব নয়।
তবে মোদী সরকার গত কয়েক বছর যাবৎ ভারতের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সংক্রান্ত যাবতীয় আন্তর্জাতিক মূল্যায়নকে ধর্তব্যের মধ্যেও আনতে চায় না। অতীতে ক্ষুধা কিংবা অপুষ্টি সংক্রান্ত সমীক্ষার ফলাফলও ‘বিদেশিদের চক্রান্ত’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে। সময় অন্তর বিভিন্ন তথ্য দিতেও অনীহা দেখায় সরকার। এমনকি কোভিডের সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভারতে মৃত্যু সংক্রান্ত তথ্যও মানতে চায়নি মোদী সরকার।
এদিকে, গবেষণাপত্রের তথ্য উল্লেখ করে ইয়েচুরি বলেছেন, ধনীদের হাতে আয় এবং সম্পদ কুক্ষিগত হয়ে আছে আর নিচের সারির ৫০ শতাংশ আয়ের মাত্র ১৫ শতাংশ অংশীদার। এই কর্পোরেট-সাম্প্রদায়িক আঁতাত লুট করছে জাতীয় সম্পদ বলেই পরিস্থিতির বদল ঘটাতে প্রয়োজন মোদী সরকারকে পরাস্ত করা।
Comments :0