অর্ণব ভট্টাচার্য
কে দেখেছে জীবনের অপচয় বেশি তার চেয়ে?
কে সয়েছে এত গ্লানি রানাঘাটে, ক্যাম্পে ক্যাম্পে, পথে,
ওডিশার তেপান্তরে, জনহীন দ্বীপান্তরে আর
হাওড়ার স্টেশনে?
অচল পয়সার মতো পরিত্যক্ত...
তবু বার বার
কে এমন ফিরে আসে, ঘর বাঁধে, কার এত আশা?
দারিদ্রের কাঁটাগাছে দুরন্ত স্বপ্নের রাঙাফুল ফোটাতে কে জানে?
('নকশি কাঁথার কাহিনী', মণীন্দ্র রায়)
দেশভাগের দায় বহন করে রক্তাক্ত, ক্লান্ত, সর্বস্বান্ত হয়েও যারা ঘুরে দাঁড়িয়ে জীবনের জয়গান গেয়েছেন তারা বাংলার ছিন্নমূল মানুষ। তবে এটাই যন্ত্রণার ও দুঃখের বিষয় যে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবের জন্য দেশভাগের ৭৭ বছর কেটে যাওয়ার পরও উদ্বাস্তু সমস্যা অমীমাংসিত। আমাদের রাজ্যে এখনও প্রায় দু'হাজার কলোনি সরকারি স্বীকৃতি পায়নি। আবার উচ্ছেদের মুখোমুখি বেশ কিছু কলোনি । এখন সারা বিশ্বজুড়েই ক্রমবর্ধমান জাতিগত ও সাম্প্রয়িক হিংসা, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক বিপর্যয় কিংবা তথাকথিত উন্নয়নপ্রকল্পের ফলে ভিটেমাটি ছাড়া হচ্ছে মানুষ। আমাদের দেশে দেশভাগের উদ্বাস্তু ছাড়াও অভ্যন্তরীণ বাস্তুহারা মানুষের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। Internal Displacement Monitoring Centre -এর পক্ষ থেকে প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী ভারতে ২০২৪ সালে ৬৭ হাজার মানুষ হিংসাত্মক সংঘাতের জন্য এবং ৫ লক্ষ ২৮ হাজার মানুষ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের জন্য বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। সারা পৃথিবীতে এখন ১২ কোটির বেশি মানুষ উদ্বাস্তু। এই জ্বলন্ত সমস্যার প্রেক্ষাপটে এদেশের বৃহত্তম উদ্বাস্তু সংগঠন সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদ(UCRC)-এর পঁচাত্তর বর্ষপূর্তি বিশেষ তাৎপর্য বহন করছে।
আমাদের রাজ্যে বাস্তুহারা মানুষের জীবন যন্ত্রণার মূলে রয়েছে সাম্প্রয়িক রাজনীতি এবং জাতিরাষ্ট্র নির্মাণের রাজনৈতিক প্রকল্প। দ্বিজাতি তত্ত্বের ভ্রান্ত দর্শনকে মান্যতা দিয়ে দেশভাগ হওয়ার পর সীমান্তের দু’পারেই ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ বিপন্ন বোধ করেন । দাঙ্গা, যুদ্ধ, মানসিক উদ্বেগ, অর্থনৈতিক সঙ্কট— এই সব কিছু মিলেমিশে যে অসহনীয় পরিবেশ সৃষ্টি হয় তা লক্ষ লক্ষ মানুষকে নিরাপত্তা এবং স্বস্তির সন্ধানে সীমান্ত পেরোতে বাধ্য করে। সরকারি হিসাব মতোই ১৯৮০ সালের গোড়ায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিমবাংলায় চলে আসা মানুষের সংখ্যা ছিল অন্তত ৮০ লক্ষ। বেসরকারি মতে ১ কোটিরও বেশি। নানা রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার ফলে আশি ও নব্বইয়ের দশকেও পূর্ব থেকে পশ্চিমে উদ্বাস্তু প্রবাহ কমবেশি চলমান থেকেছে ।
উদ্বাস্তু জনগণ সাম্প্রয়িক রাজনীতি, দেশি-বিদেশি শাসক শ্রেণির ষড়যন্ত্র এবং ক্ষমতার লালসার শিকার। অথচ রাষ্ট্রীয় দায়বদ্ধতার প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করে দীর্ঘকাল বাঙালি উদ্বাস্তুদের বঞ্চনা ও নিপীড়ন করা হয়েছে । বর্তমানে যে হিন্দুত্ববাদী শক্তি হিন্দু উদ্বাস্তুদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু বিসর্জন করেন তাদের রাজনৈতিক পূর্বসূরিরা এই ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসনের জন্য কোনও ভূমিকাই পালন করেননি। এখনও সরকারিভাবে অস্বীকৃত উদ্বাস্তু কলোনিগুলিকে স্বীকৃতি দান কিংবা উদ্বাস্তু উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনও আগ্রহ নেই।
ইতিহাসের দিকে ফেরা
দেশভাগের একবছরের মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে লক্ষ লক্ষ বাস্তুহারা মানুষের ঢল নামলেও সরকার যথাযথ পুনর্বাসনের দায়িত্ব নিতে রাজি ছিল না। বাধ্য হয়ে কাঁচড়াপাড়া থেকে যাদবপুর পর্যন্ত বিস্তীর্ণ এলাকায় বাস্তুহারা মানুষ পতিত, পরিত্যক্ত ও জলা জমি দখল করে জবরদখল কলোনি গড়ে তোলেন। ১৯৫০ সালের মধ্যেই প্রায় ৬ লক্ষ বাস্তুহারা এভাবে নিজেদের মাথা গোঁজার ঠাঁই তৈরি করে নেন। তবে উদ্বাস্তুরা উপলব্ধি করেছিলেন যে ছিন্নমূল মানুষের অধিকার অর্জন এবং রক্ষা করতে হলে শক্তিশালী ঐক্যবদ্ধ সংগঠন গড়ে তোলা ছাড়া কোনও বিকল্প নেই। তাই ১৯৫০ সালের ১১ থেকে ১২ আগস্ট বিভিন্ন বাস্তুহারা সংগঠন, ক্যাম্প ও কলোনির প্রতিনিধিবৃন্দ, বিভিন্ন দল ও গণসংগঠনের প্রতিনিধিবৃন্দ ও প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদ(United Central Refugee Council-UCRC) গঠিত হয়। সভাপতি হিসাবে নির্বাচিত হন সত্যপ্রিয় বন্দ্যোপাধ্যায় এবং সম্পাদক হিসাবে নির্বাচিত হন বিপ্লবী অম্বিকা চক্রবর্তী। এরপর
বাংলার মাঠে ময়দানে নিরন্ন উদ্বাস্তু মানুষ প্রবল রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। রাষ্ট্রীয় নিপীড়নকে প্রতিহত করে "আমরা কারা বাস্তুহারা, আমাদের দাবি মানতে হবে"- এই স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে ছিন্নমূল মানুষের রক্ত-ঘামে ভেজা বাংলার রাজপথ। উদ্বাস্তুদের সার্বিক পুনর্বাসন, কুপার্স-ভদ্রকালী-পাল্লা মহেশডাঙার মতো বিভিন্ন সরকারি ক্যাম্পের দৈন্যদশা দূর করা, উদ্বাস্তুদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার মতো নানা দাবিতে ব্যাপক আন্দোলন ড়ে তোলে ইউসিআরসি। এই লড়াইয়ে শুরু থেকেই পাশে ছিল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কমিটি। ১৯৫২ সালের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির যে নির্বাচনী ইশ্তেহার প্রকাশিত হয় সেখানে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন, নাগরিক অধিকার এবং জীবিকার ব্যবস্থা করার দাবি উত্থাপন করা হয়।
এদিকে বাস্তুহারাদের অবর্ণনীয় দুর্দশা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত সম্পত্তির পবিত্রতা রক্ষায় উদগ্রীব হয়ে ওঠে রাজ্য সরকার। জবরদখল কলোনি উচ্ছেদ করার জন্য জমির মালিকরা পুলিশ এবং ভাড়া করা গুন্ডাদের সাহায্যে বারে বারে আক্রমণ চালায়। কিন্তু বারে বারেই প্রতিরোধ গড়ে তোলে ছিন্নমূল মানুষ । কলোনি উচ্ছেদের জন্য মরিয়া হয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকার বিধান সভায় এভিকশন বিল (বা Act XVI of 1951) পেশ করে । ইউসিআরসি’র পক্ষ থেকে রিফিউজি এভিকশন রেজিস্ট্যান্স কমিটি তৈরি করা হয় এবং এই উচ্ছেদ বিলের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জায়গায় তীব্র বিক্ষোভ সংগঠিত হয়। বিধানসভার অভ্যন্তরে বঙ্কিম মুখার্জি, জ্যোতি বসু সহ অন্যান্য বামপন্থী বিধায়করা এই এভিকশন বিলের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ করেন। এই কালা আইন বলবৎ করার চেষ্টা ব্যর্থ করে উদ্বাস্তুদের সংগ্রামী ঐক্য, আত্মমর্যাদা ও প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে টিকে থাকে প্রতিটি জবরদখল কলোনি। পরবর্তীকালে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে এগুলি সরকারি স্বীকৃতি পেয়েছে।
পঞ্চাশের দশকের শেষ থেকে দণ্ডকারণ্যের জঙ্গলাকীর্ণ রুক্ষ মাটিতে বাঙালি উদ্বাস্তুদের জোর করে পাঠানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। রাজ্যে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের জন্য উদ্বৃত্ত জমি থাকা সত্ত্বেও গরিব উদ্বাস্তুদের নির্মমভাবে দণ্ডকারণ্যে পাঠানোর তীব্র বিরোধিতা করে ইউসিআরসি। উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের দায় অস্বীকার করে কেন্দ্রীয় সরকার ষাটের দশকের শুরুতেই ঘোষণা করে যে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের কাজ যা বাকি আছে তা এখন 'অবশিষ্ট সমস্যা' (Residual problem)। খুব দ্রুত কেন্দ্রীয় সরকারের পুনর্বাসন দপ্তর গুটিয়ে আনা হয় এবং সমগ্র সমস্যাটি মেটানোর জন্য মাত্র ২১ কোটি ৮৮ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়। নিরুত্তাপ ছিল তৎকালীন রাজ্য সরকার।
১৯৬৭ সালে পশ্চিমবঙ্গের প্রথম যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠন ছিল উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে প্রথম রূপালি আলোর রেখা। উদ্বাস্তু পুনর্বাসন মন্ত্রী হন ইউসিআরসি’র অন্যতম নেতা, বিপ্লবী নিরঞ্জন সেনগুপ্ত। সদ্য গড়ে ওঠা কলোনিগুলিতে রাস্তাঘাট, পানীয় জল ও বিদ্যুতের মতো জরুরি পরিষেবাগুলি পৌঁছে দেওয়া শুরু হয়। সর্বোপরি তিনি কলোনির উন্নয়নের স্বার্থে নির্বাচিত কলোনি কমিটিগুলিকে স্বীকৃতি প্রদান করেন। উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের জন্য রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে আড়াইশো কোটি টাকা মঞ্জুরির দাবি করে । ভ্রুক্ষেপ করেনি কেন্দ্রীয় সরকার ।
১৯৭৭ সালে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হওয়ার পর উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের ধারাবাহিক উদ্যোগ শুরু হয়। ইউসিআরসি’র সাধারণ সম্পাদক সমর মুখার্জিকে চেয়ারম্যান করে উদ্বাস্তু পুনর্বাসন কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৮১ সালে রাজ্য সরকারের কাছে প্রদত্ত এই কমিটির রিপোর্ট উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ দলিল। ১৯৮৬ সালের ৭ নভেম্বর বরানগরের নেতাজী কলোনিতে ৪০৪ জনকে নিঃশর্ত দলিল প্রদান করে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের এক নতুন ইতিহাস রচনা করেন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু। বামফ্রন্ট সরকারের দৃঢ় মনোভাবের ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছ থেকে জবরদখল কলোনিগুলির স্বীকৃতি আদায়ের প্রশ্নে লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়। কলোনির জমি অধিগ্রহণ বাবদ ৮৪ কোটি টাকা মঞ্জুর করে কেন্দ্রীয় সরকার, কলোনিগুলির উন্নয়ন খাতে ও ৭৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করতে তারা বাধ্য হয়। বামফ্রন্ট সরকার এবং ইউসিআরসি’র নিরবচ্ছিন্ন প্রয়াস না থাকলে এই সাফল্য অর্জন করা যেত না। ২০১১ সাল পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তুদের আড়াই লক্ষেরও বেশি নিঃশর্ত দলিল দিয়েছিল বামফ্রন্ট সরকার।
উদ্বাস্তুদের বর্তমান সঙ্কট
গত প্রায় দেড় দশক ধরে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের কাজ এরাজ্যে চরম অবহেলিত। নিঃশর্ত দলিল দেওয়া বন্ধ করে এমন এক দখলিস্বত্বের দলিল দিচ্ছে তৃণমূল সরকার যার কোনও আইনি বৈধতা নেই। রাজ্যের নানা জায়গায় কলোনি উচ্ছেদে মদত দিচ্ছে শাসক দল। কলোনি উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রের কাছে কোনও দাবিও করেনা বর্তমান রাজ্য সরকার। লক্ষাধিক উদ্বাস্ত পরিবারের কাছে দলিল, পরচা কিছুই নেই অথচ উদ্বাস্তু কলোনিগুলিকে "স্থায়ী ঠিকানা" আখ্যা দিয়ে একাধারে উদ্বাস্তু কলোনি গড়ে তোলার ইতিহাস ভুলিয়ে দিতে চাইছে বর্তমান সরকার, অন্যদিকে নিজেদের সাংবিধানিক দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে চাইছে। এই প্রেক্ষাপটে উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের আন্দোলন বাড়তি উদ্যম নিয়ে সংগঠিত করছে ইউসিআরসি।
উদ্বাস্তুদের জমির মালিকানা সংক্রান্ত এই সমস্যার সাথে গত কয়েক বছর ধরে যুক্ত হয়েছে সিএএ ও এনআরসি’র ভ্রুকুটি। উদ্বাস্তদের নাগরিকত্ব নিয়ে কখনও কোনও প্রশ্ন ছিল না। ২০০৩ সালে মমতা ব্যানার্জির সক্রিয় সহযোগিতায় বিতর্কিত নাগরিকত্ব আইন প্রণয়ন করে উদ্বাস্তুদের সঙ্কটে ফেলে দেয় বাজপেয়ী সরকার। এখন সিএএ বলবৎ করে আরও জটিলতা তৈরি করা হয়েছে। আসামে এনআরসি’র অভিজ্ঞতা ভয়াবহ । অন্যদিকে সিএএ’র নামে উদ্বাস্তুদের যে ফাঁদে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে তা সিএএ’র বিধি প্রকাশিত হওয়ার পরে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। কতজন সিএএ’র মাধ্যমে নাগরিক হলেন তা নিয়ে কুলুপ এঁটেছে কেন্দ্রীয় সরকার। ইউসিআরসি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলেছে যে দেশভাগের দায় উদ্বাস্তুদের ঘাড়ে চাপিয়ে তাদের বেনাগরিক করার কোনোরকম চক্রান্ত বরদাস্ত করা হবে না। উদ্বাস্তুরা এদেশের নাগরিক, নতুনভাবে কোনও কাগজ জমা দিয়ে নিজের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে যাবেন না। দাবি উঠেছে যে ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব আইনের বদল ও সিএএ বাতিল করতে হবে।
উদ্বাস্তু মহল্লায় অপপ্রচারের জাল
২০১১ সালের পর উদ্বাস্তু অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে বামফ্রন্ট বিরোধী অপপ্রচার তীব্র হয়েছে। একে ভীষণভাবে উৎসাহিত করেছে আরএসএস। বিশেষত মরিচঝাঁপির বিকৃত ইতিহাস পরিবেশন করে বামপন্থীদের উদ্বাস্তু বিরোধী এবং বিশেষত দলিত উদ্বাস্তুদের শত্রু হিসাবে তুলে ধরা হচ্ছে। অথচ একথা তথ্য দ্বারা প্রমাণিত যে ১৯৭৮ সালে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সাথে কোনও আলোচনা ছাড়াই আকস্মিকভাবে দণ্ডকারণ্য প্রকল্প এলাকা থেকে লক্ষাধিক উদ্বাস্তু সুন্দরবনে চলে আসেন "উদ্বাস্তু উন্নয়নশীল সমিতি " নামক একটি য়িত্বজ্ঞানহীন সংগঠনের নেতৃত্বে। রাজ্য সরকার তাদের সাময়িক বসবাসের জন্য ক্যাম্প তৈরি করে। কিন্তু সুন্দরবন এলাকায় পুনর্বাসনের বাস্তব সমস্যা সম্পর্কে তাদের অবহিত করার পর অধিকাংশ উদ্বাস্তু পুনরায় দণ্ডকারণ্যে ফিরে যান। তবে বেশ কয়েক হাজার মানুষ উন্নয়নশীল সমিতির নেতৃত্বের প্ররোচনায় পা দিয়ে সুন্দরবনের মরিচঝাঁপি দ্বীপে জোর করে বসবাস করতে শুরু করেন। সংরক্ষিত বনাঞ্চলের কাঠ কেটে , দ্বীপের জমি বেআইনিভাবে বিক্রি করে ব্যবসা ফেঁদে বসে একশ্রেণির অসাধু রাজনীতিবিদ। বসবাসের অনুপযুক্ত এই দ্বীপকেই পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে একটি মডেল হিসাবে প্রচার করতে শুরু করে দক্ষিণপন্থী রাজনীতিবিদ ও সাংবাদিকদের একাংশ। রাজ্য সরকার এবং ইউসিআরসি’র পক্ষ থেকে ছিন্নমূল মানুষের প্রতি আবেদন করা হয় যাতে তারা দায়িত্বজ্ঞানহীন নেতৃত্বের ভ্রান্ত রাজনীতির শিকার না হন । মানুষের বসবাসের অনুপযুক্ত এই দ্বীপে রোগব্যাধি, অকাল মৃত্যু ছিল নিত্যসঙ্গী। তা সত্ত্বেও দক্ষিণপন্থীদের উসকানিতে উদ্বাস্তুদের একাংশ থানা অবরোধ করে হামলা চালানোয় গুলি চালায় পুলিশ এবং দু’জন মারা যান যাদের মধ্যে একজন স্থানীয় আদিবাসী রমণী। নিহতদের পরিবারের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে ১৯৭৯ সালের মে মাসের মধ্যে মরিচঝাঁপির সমস্ত অধিবাসীকে দ্বীপের বাইরে নিয়ে গিয়ে দণ্ডকারণ্যের জন্য রওনা করিয়ে দেয় তৎকালীন সরকার। বামফ্রন্ট সরকারের হস্তক্ষেপে দণ্ডকারণ্য ত্যাগকারী উদ্বাস্তুদের আবার পুনর্বাসন দেওয়া হয়। মরিচঝাঁপিতে এই দুঃখজনক ঘটনার জন্য দায়ী সুবিধাবাদী দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক নেতৃত্ব। তারা উদ্বাস্তুদের জীবন নিয়ে যেভাবে ছিনিমিনি খেলেছিলেন তাকেই ধামাচাপা দিয়ে তথ্যবিকৃতি ঘটিয়ে "মরিচঝাঁপি গণহত্যা"-র মিথ্যে কাহিনি তৈরি করা হয়েছে।
পশ্চিম বাংলার প্রগতিশীল রাজনৈতিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে উদ্বাস্তু আন্দোলন ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল। পূর্ববঙ্গের ছিন্নমূল উদ্বাস্তুরা কেবল নিজেদের পুনর্বাসন চেয়েছিলেন তা নয়, মুসলিম বাস্তুহারাদের জন্যও তারা পুনর্বাসনের দাবি করেছিলেন। এই ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ঐতিহ্যকে ভুলিয়ে দিয়ে সাম্প্রয়িকতার চোরাবালিতে উদ্বাস্তু মহল্লাকে, বিশেষত বর্তমান প্রজন্ম যারা কিনা সেই মরণপণ সংগ্রামের দিনগুলি দেখেনি, তাদের বিভ্রান্ত করবার চেষ্টা চলছে। যে সাম্প্রয়িক শক্তির বিভাজনের রাজনীতির জন্য দেশভাগ ও উদ্বাস্তু সমস্যা সৃষ্টি হয়েছিল তারা আজ নতুন ভাবে মানুষের ঐক্যকে ধ্বংস করতে উদ্যত। অথচ দেশভাগের এটাই শিক্ষা যে রাজনীতি আর ধর্মের মিশেল যে অবিশ্বাস ও হিংসার পরিবেশ সৃষ্টি করে তার মাশুল দিতে হয় সাধারণ জনতাকে, লাভবান হয় ক্ষমতার কারবারীরা। পশ্চিমবাংলার ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে যে ছিন্নমূল মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে বিশ্বস্ত সাথি ছিল বামপন্থীরা। আজও সেই দায়বদ্ধতা অটুট।
উদ্বাস্তু আত্মপরিচয় নিয়ে অনেকে আজকাল গ্লানি বোধ করেন । অথচ উদ্বাস্তুরা বোঝা নন, তারা সম্পদ। তাদের অবদান বাংলার অর্থনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতিতে চিরস্মরণীয়। তাদের সংগ্রাম এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায় যেখানে রাষ্ট্রশক্তির ঔদাসীন্য ও বৈরিতার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে অধিকার অর্জন করেছিলেন বঞ্চিত জনগণ। আজও নতুন পরিস্থিতিতে পুনর্বাসনের সংগ্রাম চলছে। নতুন ঘর বাঁধার লড়াইয়ের স্মৃতিকে ধূসর করে দেওয়ার চক্রান্ত যারা করছে তারা ইতিহাসের বিকৃত সাম্প্রয়িক ব্যাখ্যা হাজির করে বর্তমান সংগ্রামকে দুর্বল করতে চায়, রাষ্ট্রের শ্রেণি চরিত্র ভুলিয়ে দিতে চায়, ধর্মীয় মৌলবাদের ধ্বংসাত্মক চেহারাকে আড়াল করতে চায়। ইউসিআরসি’র ৭৫ বছর উদ্যাপন সেই ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করে, সংগ্রামী মানুষের ঐক্য জোরদার করে লড়াইয়ের পথ প্রশস্ত করুক।
Comments :0