গৌতম রায়
কাকাবাবু মুজফ্ফর আহ্মদের প্রতি বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলামের শ্রদ্ধা এবং আকর্ষণের জায়গাটি সদ্য প্রয়াত সনজিদা খাতুনকে বিশেষভাবে আকর্ষণ করত। রবীন্দ্রগতপ্রাণ সনজিদা খাতুন কোনও কোনও ক্ষেত্রে নজরুলের মূল্যায়ন সম্পর্কে কিছু কঠিন অবস্থান নিলেও, নজরুলের চোখ দিয়ে এবং তাঁর পিতা কাজী মোতাহার হোসেনের চোখ দিয়ে যেভাবে কাকাবাবুকে দেখেছিলেন, তার ভিতর দিয়েই কাকাবাবুর মানবতার আদর্শকে চিরকাল প্রগাঢ় শ্রদ্ধা, আর ভালোবাসায় বুক ভরে লালন করেছিলেন।
নজরুলের শ্রেনিহীন সমাজের প্রতি পক্ষপাতিত্ব এবং ন্যায়সঙ্গত মানবাধিকারের লঙ্ঘন ঘিরে দুশ্চিন্তা— এই বোধগুলি নির্মাণের ক্ষেত্রে কাকাবাবুর প্রত্যক্ষ প্রভাব এবং নজরুলের মানবতার আদর্শে গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করেছিল বলে সনজিতা খাতুন মনে করতেন। নজরুল নিজে যেভাবে, 'গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষক- শ্রমিক তরুণদের সঙ্ঘবদ্ধ করবার চেষ্টা' ( নজরুল রচনাবলী, ঢাকা, নবম খণ্ড, পৃ-১৮৩) করেছেন তার কথা সনজিদা খাতুন নিজেও অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে উল্লেখ করে গেছেন (শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ- সনজিদা খাতুন, কথাপ্রকাশ, পৃ- ১৭৮)।
নজরুল যে নিশ্চিত জীবনযাত্রার পূর্ণ শান্তি কোনোদিন পাননি (নজরুল, ঐ পৃ- ১৮৯) সেই বেদনা নজরুল প্রেমিকদের আজও অন্তরে রক্তক্ষরণ ঘটায়। আর সেই রক্তক্ষরণের মধ্যে দিয়েই নিজের জীবনের সমস্ত অনিশ্চয়তার মধ্যেও নজরুল কীভাবে সব সময় তাঁর বন্ধু কমরেড কাকাবাবুর পাশে দাঁড়িয়েছেন তার সপ্রশংস উল্লেখ করতে সনজিদা খাতুন কখনো কার্পণ্য করেননি।
কাকাবাবু যখন 'গণবাণী' পত্রিকা প্রকাশ করছেন, তখন বিভিন্ন পত্রিকা থেকে তাঁর নানা ধরনের বিকৃত সমালোচনা হতে শুরু করে। এই ধরনের সমালোচনা নজরুলকে খুব ব্যথিত করে। তাই তিনি গণবাণীর সমালোচক 'আত্মশক্তি' পত্রিকার সম্পাদককে এ সম্পর্কে একটি দীর্ঘ চিঠি লেখেন (ঢাকা থেকে প্রকাশিত নজরুলের পত্রাবলী ২২ নম্বর চিঠি দ্রষ্টব্য)। এই পর্বেই নজরুলের 'লাঙল' পত্রিকার সঙ্গে যখন কাকাবাবু সম্পাদিত 'গণবাণী' পত্রিকাটি মিশে যায়, তখন তারানাথ রায় নামক এক ব্যক্তি, 'বঙ্গীয় কৃষক শ্রমিক দলে'র এই মুখপত্রটি সম্বন্ধে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের অবতারণা করেছিলেন।
রবীন্দ্র সঙ্গীত সাধিকা সনজিদা খাতুন তাঁর গবেষণায় এই পর্ব ঘিরে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। এই আলোচনার মধ্যে দিয়ে দেখতে পাওয়া যায়, নজরুল এবং কাকাবাবুর প্রতি কি অনিঃশেষ শ্রদ্ধা সনজিদা খাতুন বহন করতেন।
তারানাথ রায় যেভাবে গণবাণী পত্রিকার, লাঙ্গল পত্রিকার সঙ্গে মিশে যাওয়া ঘিরে প্রশ্ন তুলেছিলেন, সেই প্রশ্নগুলি সনজিদা খাতুনকে দীর্ঘকাল পরেও গভীরভাবে ব্যথিত করেছিল। তারানাথ রায়ের জিজ্ঞাসার মধ্যে নজরুল এবং কাকাবাবু উভয়ের প্রতি বেশ কিছুটা অবজ্ঞা অশ্রদ্ধাজনিত দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। তারানাথ সরাসরি প্রশ্ন তুলেছিলেন, ওই দল কবে হলো। তার পাশাপাশি, 'কোন ভাত-কাপড়ের সংস্থানহীন অনশন অর্ধাশন - ক্লিষ্ট শ্রমিকেরা এবং কর্ণধার' এই ধরনের প্রশ্ন সংশ্লিষ্ট তারানাথ রায় তুলেছিলেন।
সেই প্রশ্নগুলি নজরুলকে কিভাবে ক্ষুব্ধ করেছিল এবং মুজফ্ফর আহ্মদের প্রতি এই জায়গা থেকে কিভাবে আরও দরাজ ভঙ্গিমায় বন্ধুত্বের হাত নজরুল বাড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই জায়গাগুলি সনজিদা খাতুন অসামান্য দক্ষতায় তুলে এনেছিলেন। নজরুল তারানাথ রায়কে তার ওই অনৈতিক আক্রমণের জবাবে গণবাণী দপ্তরে গিয়ে অনশন ক্লিষ্ট, 'মাথা - ন্যাড়াট তালগাছে' র মতন ঋজু ক্ষয় রোগী মুজফ্ফর আহ্মদের মতো মানুষকে দেখে আসবার যে গর্জন করেছিলেন, সে বিষয়টির কথা সনজিতা খাতুনের মতো এত দৃঢ়তার সঙ্গে, সদম্ভ উচ্চারণের ভঙ্গিমায় বলা- এটা খুব কমই দেখা গেছে।
সনজিদা নিজে লিখছেন, "এ কথা লিখতে গিয়ে তাঁর ক্রোধ তুঙ্গে উঠে অসুস্থ মুজফ্ফর সাহেবের নিঃস্বার্থ জনসেবার কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েছে যেন"( ঐ) ।
তারানাথ রায়কে সরাসরি দক্ষিণপন্থী বলতে দ্বিধা করেননি সনজিদা খাতুন। একইসঙ্গে তিনি সজনীকান্ত দাস সম্পাদিত 'শনিবারের চিঠি' পত্রিকাটিকেও এই প্রসঙ্গে দক্ষিণপন্থী বলে অভিহিত করেছিলেন। তারানাথ রায় বা সজনীকান্তের শনিবারের চিঠি এই ধরনের ব্যক্তি এবং পত্রিকা— এরা যে ধনীদের পক্ষ নিয়ে সাধারণ দুঃস্থ মানুষদের বিরোধিতারত রয়েছে, একথা নজরুল স্পষ্টভাবে লিখেছিলেন— তা জানাতেও দ্বিধা করেননি সনজিদা খাতুন। মুজফ্ফর আহ্মদের বিরুদ্ধে যে কোনও ধরনের অনৈতিক সমালোচনা হলে, তার প্রতিবাদে কীভাবে নজরুলের কলম ঝলসে উঠতো, অত্যন্ত শ্রদ্ধাপূর্ণ চিত্তে সে কথা সনজিদা খাতুন বারবার উল্লেখ করেছেন।
নজরুলের পত্রাবলীর যে ২২ নম্বর চিঠিটি ঘিরে এই আলোচনা, সেই চিঠিতে মুজফ্ফর আহ্মদ কর্তৃক মুসলিম সাহিত্য সমিতির প্রাণ প্রতিষ্ঠা ঘিরেও সনজিদা খাতুন বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
এই মুসলিম সাহিত্য সমিতিকে কেন্দ্র করে ব্রিটিশ সরকার নানাভাবে হেনস্তা করে কাকাবাবুকে। কাকাবাবুর এই 'রাজ লাঞ্ছনা' নজরুলকে কতটা পীড়িত করেছিল সে সম্পর্কেও সনজিদা খাতুন বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। বাঙালির সাংস্কৃতিক চেতনার উন্মেষে কাকাবাবুর যে ভূমিকা, তাঁর পিতা কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে এবং নজরুলের সঙ্গে কাকাবাবুর যে সংযোগ, এগুলি অত্যন্ত প্রশংসাচিত্তে, বারবার সনজিদা খাতুনের বিভিন্ন মূল্যায়নে উঠে এসেছে।
এই মুসলমান সাহিত্য সমিতিকে কেন্দ্র করে কাকাবাবুর ওপরে ব্রিটিশ সরকারের নানা ধরনের অত্যাচারকে কেন্দ্র করে সেই সময়ের মুসলমান সমাজের একটা অংশের, কাকাবাবুকে এড়িয়ে যাওয়ার প্রসঙ্গটিও গভীর দুঃখের সঙ্গে সনজিদা খাতুন তাঁর বিভিন্ন প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন। নজরুল যে তার বিভিন্ন লেখায়, বিভিন্ন সময়ে কাকাবাবুর ধৈর্যশীল কর্ম নিষ্ঠার কথা বারবার বলতেন, সে কথাও সনজিদা খাতুন উল্লেখ করতে ভোলেননি।
নজরুলের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে সনজিদা খাতুন বিশেষভাবে গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন আনোয়ার হোসেন নামক এক ব্যক্তির কাছে লেখা নজরুলের একটি চিঠি। সে চিঠিতে নজরুল লিখছেন; "আমি মুসলমান কিন্তু আমার কবিতা দেশের সকল কালের এবং সকল জাতির। কবিকে হিন্দু কবি, মুসলমান কবি ইত্যাদি বিচার করতে গিয়েই এই ভুলের সৃষ্টি (নজরুল রচনাবলী। নবম খণ্ড, পৃ- ১৭৯)।
নজরুল - কাকাবাবুর সম্পর্কের এই মূল্যায়ন করা ব্যক্তিত্বই কিন্তু স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টির পর, রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়াকে ঘিরে যে পরিবেশ পরিস্থিতির কথা উল্লেখ করেছেন, তা যেন আজ আমাদের এপার বাংলা সম্বন্ধেও সমানভাবে প্রযোজ্য।
সনজিদা লিখছেন; "বাংলাদেশের স্বাধীনতা যেন যথেচ্ছভাবে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইবার স্বাধীনতা এনে দিয়েছিল। যেন কেবল রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইলেই বাঙালিত্বের পরিচয় প্রতিষ্ঠা হয়! পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়াকে হিন্দুয়ানি বা ভারতের দালালি বলেছেন যাঁরা তাঁরাও মঞ্চে বসে ঢুলু ঢুলু নয়নে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে শুরু করলেন। ভোল পালটানোর এই ব্যাপারটি সংস্কৃতি ক্ষেত্রে এবং রাজনীতি ক্ষেত্রে সমভাবেই দেখা দিয়েছিল। কনভেনশন মুসলিম লিগের কট্টর সমর্থক আমার এক ছাত্রকে স্বাধীনতার পরে মুজিববাদী পরিচয় দেখে আমার চক্ষু ছানাবড়া হয়েছিল। ভারত থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসবার প্রাক্কালে ১৪৪ লেনিন সরণিতে 'মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থা'র শেষ বৈঠকে স্বাধীন বাংলাদেশ ঘুরে যাওয়া হাসান ইমাম তাঁর বক্তৃতায় কিছু কথা বলেছিলেন। তিনি খবর দিয়েছিলেন, ঢাকার রাজাকার আর আল-বদররা স্বাধীনতার পরে তাদের অর্থশাস্ত্র নিয়ে যে যার গ্রামে ফিরে গিয়ে পরিচয় দিচ্ছে তারা নাকি মুক্তিযুদ্ধ করে ফিরেছে! এদিকে ঢাকার দেওয়াল -লিখনে লিখে রেখে গেছে, উপযুক্ত সময় তারা আবার ফিরে আসবে। স্বাধীনতার পর থেকে এ - পর্যন্ত হাসান ইমামের বিবরণের বাস্তব পরিচয় পেয়ে আসছি। সংস্কৃতি ক্ষেত্রে পর্যন্ত রাজাকার, আল-বদরদের সঙ্গে আঁতাত করা ছদ্মবেশধারী তথাকথিত সংস্কৃতিপ্রেমীদের বিচরণ অবাধ হয়েছে। (শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ- সনজিদা খাতুন, কথাপ্রকাশ, পৃ- ২৭৮)
সনজিদা খাতুনের বয়ান পাঠের অব্যহিত পরেই মনে হয়, কি কঠিন- কঠোর- বাস্তব কথাই না তিনি লিখে গিয়েছিলেন! সনজিদা খাতুনের জীবনের শেষ কয়েকটা মাসে যেন তাঁর এই মূল্যায়ন একেবারে জীবন্ত হয়ে উঠেছিল।
প্রকৃতির নিয়মে সনজিদা খাতুন চলে গিয়েছেন। কিন্তু মুক্তবুদ্ধির উপাসনা এবং সঠিক বীক্ষণের দ্বারা রবীন্দ্র মন্ত্রের উচ্চারণের যে ধারাকে কলিম শরাফিদের মতো, বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত করবার সাধনা চিরকাল তিনি করে গেলেন, সেই সাধনার দীপশিখা থেকে উৎসারিত আলো, আরও কয়েক সন্ধ্যা, বাঙালি দহলিজকে আলোকিত করবে— সে বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই।
Comments :0