সুদীপ্ত বসু
যোগসূত্র খুবই তাৎপর্যপূর্ণ।
কয়লা পাচার বা নিয়োগ দুর্নীতির তদন্ত, বারেবারে সামনে আসছে সেই যোগসূত্র।
স্বাধীনতার পরবর্তীতে পশ্চিমবঙ্গের বুকে সর্ববৃহৎ নিয়োগ দুর্নীতি। আপাদমস্তক জড়িত শাসক তৃণমূল। আদালতের প্রায় প্রতিদিনের পর্যবেক্ষণ, নিয়োগ দুর্নীতির মাথা কোথায়? খুঁজে বের করতে এত সময় লাগছে কেন তদন্তকারী সংস্থার। শুধুমাত্র নিয়োগ দুর্নীতিতেই এখনও পর্যন্ত ২১জন গ্রেপ্তার। তালিকায় প্রাক্তন মন্ত্রী থেকে বিধায়ক, যুব তৃণমূলের নেতা থেকে জেলার তৃণমূল নেতা। যদিও সমুদ্রের মতো বিস্তৃতি এই ভয়াবহ দুর্নীতির চিত্রকেই সরকারি বৈধতা দিতে মুখ্যমন্ত্রী সুভাষচন্দ্র বসুকেও টেনে আনতে কসুর করেননি, তাঁর কথায় নেতাজী বলতেন রাইট টু মেক ব্লান্ডারস,ভুল করারও অধিকার আছে!
ব্যস মিটে গেলে সব সমস্যা। বাংলার সিংহভাগ মিডিয়াও শাসক তৃণমূল, সরকারকে আড়াল করে এটা কেবল কয়েকজন ব্যক্তির নিছক ব্যক্তিগত দুর্নীতি হিসাবে খাঁড়া করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে।
সেই সময়তেই সামনে আনা প্রয়োজন সেই যোগসূত্র।
যুব তৃণমূল কংগ্রেস। মূলত অভিষেক ব্যানার্জি দেখেন দলের এই যুব সংগঠন। নিজেও এই যুব সংগঠনের শীর্ষ পদাধিকারি ছিলেন।
সেই যুব সংগঠনের অন্যতম রাজ্য সম্পাদক বিনয় মিশ্র। ২০১৯ সালের ২৩ জুলাই অভিষেক ব্যানার্জি যুব তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম রাজ্য সম্পাদক পদে এই বিনয় মিশ্রকে বসান। এখনও পর্যন্ত আন্তর্জাতিক স্তরে পাচারকাণ্ডে যুক্ত এই ব্যক্তির বিরুদ্ধেও অন্তত খাতায় কলমেও কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি তৃণমূলের তরফে।
২০২০ সালে সেপ্টেম্বর মাসে ফেরার হয় এই বিনয় মিশ্র। সিবিআই, ভারত সরকারের চোখে ধুলো দিয়েই দেশ থাকায় পালায় বিনয় মিশ্র। প্রশান্ত মহাসাগরীয় একটি দ্বীপ রাষ্ট্র ভানুয়াতুর নাগরিকত্ব নিয়ে ফেলেছেন এই কয়লা পাচার চক্রের অন্যতম পান্ডা, যুব তৃণমূলের নেতা বিনয় মিশ্র। ২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর দক্ষিণ কলকাতায় তাঁর ফ্ল্যাটে তল্লাশি চালিয়েছিল সিবিআই। অথচ তার আগে ২২ ডিসেম্বরই তিনি ভারতীয় নাগরিকত্ব ছাড়ার জন্য পাসপোর্টও জমা দিয়ে দিয়েছিল! গোরু ও কয়লা পাচারকাণ্ডে অভিযুক্ত এই ব্যক্তি গত বছর এই শহরে থাকাকালীন কলকাতা পুলিশের নিরাপত্তা পর্যন্ত পেতেন। কলকাতা পুলিশের দুই সশস্ত্র নিরাপত্তারক্ষী এই কয়লা পাচারকারীর জন্য মোতায়েন করেছিল মমতা ব্যানার্জির সরকার।
বিনয় মিশ্রের মাধ্যমে গোরু পাচারের কিংপিন এনামুল ও কয়লা মাফিয়া লালা দু’জনের টাকাই বিভিন্ন ভুয়ো সংস্থায় খাটতো। তারপর সেই টাকা একাধিক অ্যাকাউন্ট ঘুরে অন্যত্র পাচার হতো। কোভিডের বছরে ২০২১’র মে থেকে সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ১০৯দিনে কয়লা পাচারের লালার ১৬৮কোটি টাকা দফায় দফায় পাচার হয়। অর্থাৎ প্রায় দৈনিক ১কোটি ৫৪ লক্ষ টাকা!বিনয় মিশ্রের তত্ত্ববধানেই টাকা পাচার হয়েছে অভিষেক জায়া রুজিরা ব্যানার্জির বিদেশের অ্যাকাউন্টে।বিনয় মিশ্রের তত্ত্ববধানেই টাকা পাচার হয়েছে রুজিরা ব্যানার্জির বিদেশের অ্যাকাউন্টে, দাবি গোয়েন্দা সংস্থার। বিনয় মিশ্রের একাধিক ভুয়ো সংস্থার খোঁজ মিলেছে। যেখানে কয়লা ও গোরী পাচারের টাকা খেটেছে। খোদ কালীঘাট চত্বরেই বিনয় মিশ্রের পাঁচটি শিখণ্ডী সংস্থার হদিশ মিলেছে।
এহেন ব্যক্তিকেই ভাইপো সাংসদ যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদক বানিয়েছিল গত লোকসভা ভোটের পরেই। জিরো টলারেন্সের বানী দেওয়া ভাইপো সাংসদ আজ পর্যন্ত মুখ ফুটে বলতে পারলেন না বিনয় মিশ্র কে? কী তাঁর যোগ?
এবার আসা যাক ২০২২’র যুব তৃণমূলের রাজ্য সম্পাদকের প্রসঙ্গ।
হুগলীর বলাগড়ের শ্রীপুর গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকার বাসিন্দা।গত বছর ৩০ নভেম্বর তৃণমূল যুব কংগ্রেসের নতুন কমিটি ঘোষণা হয়। মমতা ব্যানার্জির অনুপ্রেরণায় এবং অভিভাবকত্বে এই নতুন কমিটি, বলেও ঘোষণা করা হয়। সেই নতুন কমিটিতেই রাজ্য যুব তৃণমূল কংগ্রেসের অন্যতম সাধারণ সম্পাদক হিসাবে কুন্তল ঘোষের নাম ঘোষণা করা হয়।
কুন্তল কীর্তি এতদিনে জেনে গেছে রাজ্যবাসী। ২০১৪’র টেট থেকে হাত পাকিয়েছে। উচ্চ প্রাথমিকে নবম ও দশম শ্রেণিতে শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগে মাথা পিছু গড়ে ৮ লক্ষ টাকা করে নিয়েছিল ধৃত যুব তৃণমূলের অন্যতম রাজ্য সম্পাদক কুন্তল ঘোষ। ২০১৪’র টেটে ১৩০জনের কাছ থেকে গড়ে ৮ লক্ষ অর্থাৎ ১০ কোটি ৪০ লক্ষ টাকা। ১৪’র টেট, ১৬ সালের টেট সব মিলিয়ে প্রাথমিক ভাবেই দেখা গেছে মোট ৩০ কোটি টাকা তুলেছিল কুন্তল ঘোষ। ইডি’র দাবি চাকরিপ্রার্থীদের কাছ থেকে যে বিপুল পরিমাণ টাকা তোলা হয়েছিল তা পৌঁছে দেওয়া হত নির্দিষ্ট একটা প্রভাবশালী মহলে,নিয়ম করেই।
১৪’ থেকে চাকরি চুরিতে বিপুল সাফল্যের পরেই ২২’ সালে মেলে পদ, অভিষেক ব্যানার্জি তাঁকে বসায় যুব তৃণমূলের অন্যতম রাজ্য সম্পাদকের পদে বসায়।
নিয়োগকাণ্ডে ধৃত আরেক তৃণমূল ঘনিষ্ঠ শিক্ষা ব্যবাসয়ী তাপস মণ্ডল সাংবাদিকদের কাছে জানিয়েছেন, তাঁর প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীদের চাকরি দেবার নামে টাকা নিয়েছিল কুন্তল, চাকরি না পাওয়ার পরে কয়েকজনের টাকা ফেরত চাইতে গেলে বলা হত কালীঘাটের কাকুকে টাকা দিতে হয় আমাকে।
সুজয় ভদ্র হলো কালীঘাটের কাকু’। ‘কালীঘাটের কাকু’ এখন নিয়োগ দুর্নীতির তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে চলেছে।সাংসদ ও তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক ব্যানার্জির ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি বলেই সুজয় ভদ্রকে চেনেন শাসক তৃণমূলের লোকজনও। সেই সুজয় কৃষ্ণ ভদ্রকে কেন নিয়োগ দুর্নীতির কোটি কোটি টাকা দিতে হত, তাই জানতে চাইছে কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই।
নিজেকে ‘সামান্য’ ব্যক্তি বলে দাবি করা সুজয় ভদ্র অভিষেক ব্যানার্জির পারিবারিক সংস্থা ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস’র ডিরেক্টর বনে গিয়েছিলেন। দু’বছরের বেশি সময় ধরে ডিরেক্টর ছিলেন।২০১২ সালের ১৯ এপ্রিল ভাইপো সাংসদ অভিষেকের সঙ্গেই এই সংস্থার অন্যতম ডিরেক্টর ছিলেন তিনি। এখন ‘লিপস অ্যান্ড বাউন্ডস প্রাইভেট লিমিটেড’র বোর্ড অফ ডিরেক্টরে রয়েছেন দু’জন— অমিত ব্যানার্জি ও লতা ব্যানার্জি। সেই ব্যক্তি এখন অভিষেক ব্যানার্জির সংস্থার কর্মী বলে দাবি করছেন।
ডিরেক্টর থেকে কর্মী হয়ে যাওয়া এই ব্যক্তি আবার ১১’র বিধানসভা ভোটে ভবানীপুর থেকেই প্রার্থী হয়েছিলেন নির্দল হিসাবে। আসলে তৃণমূলের ডামি ক্যান্ডিডটে। আবার নারদ নিউজের স্টিং অপারেশনে সময় ম্যাথু স্যামুয়েলকে ক্যামাকস্ট্রিটের অফিসে এই সুজয় ভদ্রের সঙ্গেই দেখা করতে হয়েছিলেন অভিষেক ব্যানার্জির অ্যাপয়নমেন্ট পেতে! সুজয় ভদ্র এখনও সলিটয়ার প্লেসমেন্ট সার্ভিসেস প্রাইভেট লিমিটেড নামক এক সংস্থার ডিরেক্টর।
হাজার হাজার নিয়োগ প্রার্থীদের প্রতারিত করে তোলা কোটি কোটি টাকা যদি কুন্তল ঘোষকে পাঠাতে হতো সুজয় কৃষ্ণ ভদ্রকে তাহলে সেই টাকার আসল গন্তব্য কী? এবার সেটাই স্পষ্ট করে জানতে চাইছে তদন্তকারী সংস্থা।
কাকুর মালিক কে? তাও আবার বলে দিয়েছেন সুজয় ভদ্র নিজেই।‘আমার সাহেব হলো অভিষেক ব্যানার্জি। আমার সাহেবকে পৃথিবীর কারো ক্ষমতা নেই যে ছোঁবে। কারন তাঁর সঙ্গে কেউ দেখা করতে পারবে না, কারন তাঁর সঙ্গে কেউ ফোনে কথা বলতে পারবে না। তাই সেই অব্ধি পৌঁছানো যাবে না। তাই চেষ্টা করে যাচ্ছে, আর সেটা করতে গিয়ে আমি অব্ধি এসে থেমে যেতে হচ্ছে’।
তদন্তের গতিপথেই স্পষ্ট হবে তাঁর সাহেবকে ছোঁয়া যায় কীনা, তাঁর সাহেব আদৌ অধরা থাকেন কিনা!
ঠিক এই সময়তেই আবার কয়লা পাচারকাণ্ডে ইডি’র তদন্ত রীতিমত চাঞ্চল্যকর মোড় নিয়েছে একটি তল্লাশি ঘটনায়। খুলে গেছে কেউটের ঝাপি!
যার বিরুদ্ধে কয়লা পাচারকাণ্ডে ‘প্রভাবশালী’ নেতার টাকা লন্ডারিংয়ের অভিযোগ সেই ব্যবসায়ীর সঙ্গে যৌথ সম্পত্তি খোদ মুখ্যমন্ত্রীর ভাতৃবধূর! মুখ্যমন্ত্রীর ভাইয়ের স্ত্রীর ঠিকানাও সেই নথিতে দেখানো হয়েছে ৩০,বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট! মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনেরই ঠিকানা! তদন্তকারী আধিকারিকদের দাবি, মূলত ২০১৭ সাল থেকে কয়লার টাকা খেটেছে কলকাতা শহরের একাধিক ব্যবসায়। টলিউডেও সেই টাকা ঢুকেছে। কালো টাকা করার চক্র হিসাবেই জমি,বাড়ি, সম্পত্তিতে বিনিয়োগ হয়েছে। প্রভাবশালীর টাকাই সাদা করার চক্রে যুক্ত এই জিট্টি ভাই। সেই জিট্টি ভাইও তাঁর সঙ্গেই মুখ্যমন্ত্রীর ভাইয়ের ভবানীপুর কেন্দ্রে তিনটি সম্পত্তির হদিশ মিলেছে।
মুখ্যমন্ত্রীর বিধানসভা কেন্দ্রে ওই কয়লা পাচারকাণ্ডে মানি লন্ডারিংয়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির সঙ্গেই একের পর এক যৌথ সম্পত্তি মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যদের। কী আশ্চর্য মানি লন্ডারিংয়ে যুক্ত এই ব্যবসায়ীকেই আবার মুখ্যমন্ত্রী তৃণমূলের হিন্দি সেলের সভাপতি বানিয়েছিলেন।
তাহলে যোগসূত্র কী দাঁড়ালো? তবে কয়লা থেকে নিয়োগ দুর্নীতি, ঘুরেফিরে সেই কালীঘাট, সেই হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট সেই হরিশ মুখার্জি স্ট্রিট- বারেবারে আসছে অনুপ্রেরণার সব ঠিকানা।
তাহলে যোগসূত্র কী দাঁড়ালো? দুর্নীতিগ্রস্থদেরই দলের পদাধিকার বানিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্সের’ ডাক দেওয়া একটি পরিবারই কী তবে দুর্নীতির গঙ্গোত্রী?
Comments :0