PALAN

‘খারিজ’ থেকে অনেক দূরে

রাজ্য ফিচার পাতা

ছবি: পালান
অভিনয়ে: অঞ্জন দত্ত, মমতাশঙ্কর, যীশু সেনগুপ্ত, পাওলি দাম, দেবপ্রতিম দাশগুপ্ত।
পরিচালনা: কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায়
 

মৃণাল সেনের জন্মশতবর্ষেই একটি দুই-তৃতীয়াংশ আত্মপ্রচারমূলক ও এক-তৃতীয়াংশ ‘পালান’ ছবিটির প্রোমোশন-প্রবণ তথাকথিত ‘শ্রদ্ধার্ঘ্য’-য় কৌশিক গঙ্গোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন, মৃণালবাবু নিয়মিত তাঁর ছবি দেখতেন। দেখতে পছন্দ করতেন। দেখার পরে যথাবিহিত প্রশংসা ও সমালোচনা (অবশ্যই ‘গঠনমূলক’) অনুজ পরিচালককে জানিয়েও দিতেন। ‘একজন গুণীই, শুধু গুণীর কদর করতে পারেন’ গোছের কোনও অনুচ্চারিত শ্লাঘা যদি ওই সংক্ষিপ্ত শ্রদ্ধাচারণে একটু-একটু ফুটেও ওঠে, সেটা নিশ্চয়ই এই প্রতিবেদকের মত নির্বোধ পাঠকের বোঝার ভুল। যাই হোক, সে সব এখানে আমাদের আলোচনার বিষয় নয়। আমাদের যেটা কৌতূহল, সেটা হলো মৃণালবাবু যদি কোনওরকম ‘পালান’ নামের সাম্প্রতিক পালাটি থুড়ি ছবিটি দেখে ফেলতেন, তাহলে তাঁর প্রতিক্রিয়াটা ঠিক কী হতো! এমনিতে ছবির পোস্টার থেকে টাইটেল কার্ড অবধি শ্রদ্ধা-নিবেদন, মৃণাল প্রণামের অনেক ঘটা! মৃণাল সেনের সাক্ষাৎকারের ভিডিও, ক্লিপিং আসে ছবি শুরুর আগে। এমনকি মালিক-বিহীন যে পুরনো ‘বিপজ্জনক’ বাড়িটি ছবির অকুস্থল পৌরসভার গাড়িকে তার ঠিকানা সমকালের জন্য, ‘মৃণাল সেনের বাড়ির ঠিক পেছনে’ এই সংলাপটাও বার দুয়েক শোনা যায়। সব মিলিয়ে ভক্তি প্লাবনের কোথাও খামতি নেই।


এখন বাংলা প্রবচনে ‘অতিভক্তি’ নিয়ে যাই বলা থাকুক, আমাদের এই বিস্মরণের যুগে স্মরণের আতিশয্যেও দোষ নেই। কিন্তু ব্যাপারটা যদি ‘তোমার পূজার ছলে তোমায় ভুলেই থাকি’ গোছের হয়ে যায়, তখনই গোল বাধে। পরিচালক বহু কথাই বলেছেন, ‘পালান’, মৃণালের ১৯৮২ সালের ছবি ‘খারিজ’-এর কোনও সিকুয়েল নয়— কিন্তু ‘খারিজ’ অনুপ্রাণিত একটি নতুন ছবি, যেখানে ‘খারিজ’-এর বয়স বেড়ে যাওয়া পুরনো চরিত্ররা, এই নতুন সময়ে কেমন আছেন, কিভাবে বাঁচবেন, কিভাবে পালটে যাওয়া সময়টার মোকাবিলা করছেন, সেটাই ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। তবে সেটা নাকি করা হয়েছে মৃণালের ছবির মর্জি-মেজাজ-স্পিরিটের সঙ্গে একটুও আপস ছাড়াই! খারিজ-এর অঞ্জন আর মমতাশঙ্কর এখনও সেই বাড়িতেই ভাড়া থাকেন, যে বাড়ির সিঁড়ির নিচে পালানের ঘুমানোর জায়গা ছিল— একটু উষ্ণতার জন্য যে বাড়ির ঘুলঘুলিবিহীন রান্নাঘরে, নিভে যাওয়া উনুনের পাশে শুয়ে, বিষাক্ত গ্যাসে দম আটকে শিশু শ্রমিক পালান মরে গিয়েছিল! ছোট্ট পুপাইর দেখাশোনার জন্য মমতা-অঞ্জনের সংসারে পালানের আমদানি হয়েছিল, সেই পুপাই এ ছবিতে বউ-মেয়ে কসবার বহুতলে ছোট্ট সাজানো ফ্ল্যাট— চকচকে গাড়ি— মোটা মাইনের কর্পোরেট চাকরি শুদ্ধ সফল সংসারী খারিজ-এ পালানের বন্ধু, প্রতিবেশী বাড়ির কাজের ছেলে হরিও এখন বড় হয়ে ট্যাক্সি চালায়। এই শহর, ওই বেলতলা রোডের পুরনো পাড়াতেই থাকে। আর শ্রীলাও পুরনো পাড়াতেই রয়ে গেছে। বিয়ের পরেও। তার বর সমীক ওই অঞ্চলেই প্রোমোটিং করে। আদ্যি কালের পুরনো বাড়ি ভেঙে নতুন ফ্ল্যাট বানায়।
‘খারিজ’-এর সঙ্গে ‘পালান’-এর চিত্রনাট্যীয় যোগসূত্র এইটুকুতেই ফুরিয়ে যাচ্ছে না। ‘পালান’ শুরু হচ্ছে এক সকালে মানুষের অবহেলাজনিত একটি মৃত্যু দিয়ে। ‘পালান’-এর শুরুতেই জীর্ণ বাড়ির একাংশ ভেঙে পড়ে। আর ভাঙা চাঙড় মাথায় পড়ে, নিচের তলায় ভাড়াটে ভদ্রমহিলার মৃত্যু হয়। এ-ও এক ‘ম্যানমেড’ দুর্ঘটনা — কর্তব্যে গাফিলতি, বিপজ্জনক বাড়ির ভাড়াটেদের প্রতি সংবেদনশীলতার অভাব, দায়িত্বজ্ঞানহীতা সব্বার। শ্রীলার প্রোমোটার বর সমীর থেকে শুরু করে পুলিশ-প্রশাসন-পৌরসভা, কেউই তো দায় এড়াতে পারে না। এখানেই মৃণাল সেন ও তাঁর ছবির অন্তর্লীন রাজনীতিকে পুরোদস্তুর শ্রদ্ধা জানানোর সুযোগ এসেছিল ‘পালান’-এর হাতে। কিন্তু আমরা অবাক হয়ে দেখলাম পরিচালক সেই সুযোগটা এড়িয়ে গিয়ে, ন্যারেটিভ-টাকে অধুনা টলিউডের ট্র্যাকে গড়িয়ে দিলেন! বোঝাই গেল পরিচালক মুখে বা লিখে যা-ই বলুন, ‘খারিজ’-এর স্পিরিট থেকে তিনি আসলে কোনও প্রেরণা পাননি, নেননি, বা নিতে চাননি। হয়তো সেটা তাঁর পক্ষে সম্ভবই ছিল না। কেন না দুতরফেই চলচ্চিত্র ভাবনা বা দর্পণেই তো আসমান-জমিন ফারাক। মৃণাল তাঁর ছবিতে বাঙালি মধ্যবিত্তকে বারবার টেনে-হিঁচড়ে আয়নার সামনে এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছেন। তার সূক্ষ্ম ধান্দাবাজি, গোপন স্বার্থপরতা, লুকনো ভণ্ডামিগুলোকে হাটের সামনে বেআব্রু করে দিয়েছেন। মধ্যবিত্তের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলেছেন, বিদ্ধ করেছেন। মধ্যবিত্ত দর্শককে ক্ষেপিয়ে চটিয়ে, অস্থির করেছেন।


সেখানে কৌশিকদের মধ্যবিত্ত দর্শকের মন রেখে চলতে হয়। তাদের সেন্টিমেন্ট, আবেগ, চোখের জলকেই পুঁজি করে বাণিজ্য বাড়াতে হয়। বাস্তবে কোনও সম্ভাবনা না থাকলেও পর্দায় মধ্যবিত্তকে জিতিয়ে দিতে হয়। তাই ‘খারিজ’ যখন সমীর ও পালানের অন্যান্য শিশু শ্রমিক বন্ধুদের বাস্তব অস্তিত্ব, পালানের বাবার তীব্র মৌনতার সামনে, পালানকে নিয়োগকারী হিসেবে মমতা ও অঞ্জন নিজেদের এক লজ্জায়-ঘেন্নায়-ধিক্কারে গুটিয়ে এইটুকু হয়ে যায়। সেখানে ‘পালান’-এ কৌশিককে ‘‘মধ্যবিত্তের বুক চিতিয়ে বাঁচার গল্প’’, ‘‘মর্যাদার লড়াইয়ের গল্প’’ বানাতে হয়! ‘খারিজ’-এ একটা প্রতিবাদ, একটাও স্লোগান ছাড়াই পালানের দল শ্রেণির লড়াইয়ে অঞ্জনদের হারিয়ে ভূত করে দিয়েছিল। ‘পালান’-এ সেই অঞ্জনকে দিয়েই নীতি, ন্যায়, অধিকারের লড়াই-টড়াই, এসব ব্যাপারে বেশ জ্বালাময়ী বক্তৃতাও করানো হয়েছে। ছবিতে অঞ্জন যদিও পায়ের ব্যথায় ভীষণ কাবু, প্রায় অথর্ব, ওয়াকার নিয়ে ঘরের মধ্যে কোনওরকমে চলাফেরা করে। কিন্তু তার যে একটা প্রগতিশীল অতীত ও বেশ দাপুটে কর্তৃত্ববান বর্তমান আছে। মাঝে মাঝে প্রায় ভস্ম করে দেওয়ার ভঙ্গিতে চোখ পাকিয়ে তাকালে, স্ত্রী মমতা থেকে শুরু করে প্রোমোটার সমীর সবাই বেশ ঘাবড়ে যায়। জানি না অঞ্জনের ভূমিকাভিনেতা অঞ্জন দত্তের জন্য পরিচালকের এরকমই ‘ব্রিফিং’ ছিল কি না! তাছাড়া একটি দৃশ্যে, বারবার বেজে থেমে যাওয়া মোবাইল ধরবার জন্য অঞ্জন ওয়াকার সুদ্ধ হাঁচোড়-পাঁচোড় করে বেড়ালেও, কার ফোন ছিল, সেটা একবারও ফোন তুলে দেখে না। এটা কমিক-রিলিফ কিনা কে জানে, তবে আমার সামনের আর পেছনের সারির দর্শকেরা বেশ হাসছিলেন কিন্তু। অন্তত অঞ্জনের শারীরিক প্রতিবন্ধকতার প্রতি একটুও সহানুভূতিশীল বলে মনে হয়নি!


আসলে ছবি ভর্তি করে এমনই মধ্যবিত্ত হাসি-মজা-খাওয়া-নেওয়া-সঙ্গম ও প্রচুর কান্নার মুহূর্ত তৈরি করা হয়েছে। তার বেশ কয়েকটিই বেশ চেনা, মোটা, উচ্চকিত। ফলে ‍গোটা ‘খারিজ’ ছবি জুড়ে যে দমবন্ধ করা গুমোট, ঘুলঘুলিহীন রান্না ঘরের মতই আমাদের অস্তিত্বের ওপর চেপে বসে, তেমন কোনও মুহূর্ত ‘পালান’-এ তৈরি হওয়ারই ছিল না। আবহসঙ্গীত মাঝে মাঝেই ভারী হয়ে ভয় দেখাতে চাইলে, সেটা উপদ্রবের মতই লেগেছে। আর ছবির শেষ দিকে অঞ্জন হোয়াটসঅ্যাপ-এ প্রোমোটার রাজের বিরুদ্ধে যে ‘বিদ্রোহের ডাক’ দেয় সেটা তো আছেই হাস্যকর, অবাস্তব ও অবিশ্বাস্যযোগ্য। চিত্রনাট্য এমনভাবে এগোয় যাতে মনে হবে যেন ঘটনার সমস্ত দায় একা প্রোমোটার সমীরেরই। কিন্তু পরিচালক একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই জানতে পারতেন, আজকের বাংলায় তথা কলকাতা শহরে শাসকের রাজনৈতিক মদত ছাড়া উল্টো-সিধে কোনও কাজই সম্ভব নয়। ওয়ার্ডে-ওয়ার্ডে অনেক-অনেক সমীরদের মাথার ওপরে কোনও না কোনও ‘স্কোয়ার ফুট সেন’-ঘোষ-মিত্র-ব্যানার্জিদের রাজ‍‌নৈতিক ছত্রচ্ছায়া আছে। আর এ ছবিতে দুর্ঘটনার পরে যে কাউন্সিলর ভদ্রলোকটিকে ঘটনাস্থলে দেখা যায়, তাঁর মতো অমন শান্ত সুবোধ নির্বাক নেতা ভূ-ভারতে বিরল। গোটা ছবিতে আর একটিবারও তাঁকে দেখা যায় না। দেখা গেলে, ফাউলার বেড সুদ্ধ, হাসপাতাল খোদ সোজা ‘বিপজ্জনক’ বাড়ি অবধি অঞ্জন ব্রিগেডের বিপ্লবী অভিযান অত মসৃণ নির্ঝঞ্ঝাট হতো না। আমরা যদি ধরেও নেই যে ছবির শেষ দৃশ্যটা অঞ্জনের মতো বিবেকবান মধ্যবিত্তের বিপ্লবী ইচ্ছেপূরণ— তবু সেটা আজকের বাংলার রাজনৈতিক বাস্তবতায় মিথ্যে এবং অসম্ভব। আসলে রাজনীতিকে এড়িয়ে বা ভুল রাজনীতি প্রচার করে দর্শককে বিভ্রান্ত করাটাও এক ধরনের রাজনীতি, যেটা শেষ অবধি শাসক ও প্রতিষ্ঠানের পক্ষেই যায়। মৃণাল বরাবর এই না-রাজনীতির রাজনীতিকে ঘেন্না করেছেন ও তার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছেন।
মৃণাল সেনের মতো সাহসী সবাই হবেন এটা আশা করা যায় না। কিন্তু তাঁকে স্মরণ করে ছবি বানানো গেলে তাঁর রাজনৈতিক মতবাদ জায়গাটাকে সম্মান করতে হবে। দর্শক হিসেবে এটুকু প্রত্যাশা কী খুব বেশি চাওয়া?
 

Comments :0

Login to leave a comment