শিলদা।
২০১০ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী শিলদার ইএফআর জওয়ানদের ক্যাম্পে হামলা চালায় মাওবাদীরা। ক্যাম্পে থাকা ২৪ জওয়ানকে খুন করে মাওবাদীদের সশস্ত্র বাহিনী। মাওবাদী সন্ত্রাসে খুন হয়েছেন সিপিআই(এম)’র শিলদা এরিয়া কমিটি এলাকার অন্তর্গত ২৫ জন সিপিআই(এম) কর্মী সমর্থক।
শিলদা থেকে ১০ কিলোমিটার গেলেই বেলপাহাড়ি। তার উত্তরে বাঁকুড়ার জঙ্গলমহল। পশ্চিমে ১০ কিলোমিটার গেলেই ঝাড়খণ্ড। এক সময়ের মাওবাদী সন্ত্রাসের অন্যতম মুক্তাঞ্চল।
এই গোটা এলাকা বিনপুর-২ নম্বর ব্লকের আওতায় পড়ে।
২০২৩ পঞ্চায়েত নির্বাচনের ঠিক কোন দিকে বইছে এক সময়ের উপদ্রুত এই অঞ্চলে?
শিলদা ইএফআর ক্যাম্পের কোনও চিহ্নই এখন নেই। ক্যাম্পের জায়গায় রয়েছে ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ঢোকার মুখেই সরকারি জমি দখল করে তৈরি হয়েছে তৃণমূলের অফিস।
স্থানীয়রাই বলছেন, দেড় ঘন্টা ধরে প্রস্তুতি নিয়ে আক্রমণ হয়েছিল ওই ক্যাম্পে। তখন যারা মাওবাদী ছিল পরে তারা তৃণমূলে। তৃণমূল নেতাদে বাড়ি ছিল নিরাপদ আশ্রয়। এক এবং একমাত্র লক্ষ্য সিপিআই(এম)’কে নিকেশ করা।
ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ৫০ মিটার দূরেই সিপিআই(এম)’র শিলদা এরিয়া কমিটির অফিস। নির্মীয়মাণ ভবন। জোরকদমে কাজ চলছে।
এই অফিসে বসেই কথা হচ্ছিল গুরুপদ নন্দীর সঙ্গে। এরিয়া কমিটির সম্পাদক।
গুরুপদ নন্দীর কথায়, ২০১৮’র গোটা বিজেপিটাই তো এখন তৃণমূল করছে। তৃণমূল ২০১৩ সাল থেকেই গ্রামে চুরি করছে। তৃণমূলের একটা অংশ ২০১৮ সালে বিজেপি হলো। তারা প্রচার করল, পুরনো তৃণমূল চোর। আমরা ভালো। ভোট পেল। ভোটে জিতে এরাও চুরি করতে শুরু করল। একটা বড় অংশ তৃণমূলে ফিরে গেল। এখন আবার নবজোয়ারের নামে একইভাবে মানুষকে বোকা বানানোর চেষ্টা শুরু হয়েছে। যদিও এবার সে গুড়ে বালি।
পরিচয় করা যাক চিন্ময় মন্ডলের সঙ্গে। ২০১৮ সালে বিনপুর-২ ব্লক থেকে বিজেপির টিকিটে জেলা পরিষদ নির্বাচনে লড়েছিলেন তিনি। বর্তমানে সেই তিনিই তৃণমূলের টিকিটে শিলদা গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে প্রার্থী হয়েছেন।
এমনই আরেক চরিত্র হলেন শম্ভু দুলে। ২০১৮ সালে বিনপুর-২ পঞ্চায়েত সমিতির নির্বাচনে বিজেপির টিকিটে জয়ী হন তিনি। বর্তমানে তিনি সক্রিয় ভাবে তৃণমূলটাই ‘করেন’। ২০২৩’র পঞ্চায়েত নির্বাচনে শিলদা গ্রাম পঞ্চায়েতের রাধাচরণ বুথ থেকে তাঁর স্ত্রী তৃণমূলের প্রার্থী।
২০১৮ সালে বিনপুর-২ ব্লকে বিজেপি ভালো ফল করে। শিলদা পঞ্চায়েতে তৃণমূল ৯টি এবং বিজেপি ৭টি আসনে জয়ী হয়। একাংশের মিডিয়া এই জয়ের নেপথ্যে তৎকালীন বিজেপির মন্ডল সভাপতি শ্যামাপ্রসাদ গাঁতাইতের ‘ক্যারিশমা’ দেখতে পেয়েছিল। বর্তমানে তিনিও তৃণমূল করেন।
স্বাভাবিক ভাবেই এই দলবদলকে ভালো চোখে নেননি এলাকার সাধারণ মানুষ।
শিলদা বাজার থেকে ২ কিলোমিটার গেলেই দর্পশীলা গ্রাম। শিলদা কলেজের পাঁচিলের পাশের কাঁচা রাস্তা এবং মাঠ পেরিয়ে গ্রামে ঢুকতে হয়। শিলদা কলেজের বুথে রয়েছে মোট ২টি পঞ্চায়েত আসন। দর্পশীলা গ্রাম সেই একটি আসনের অন্তর্গত।
দর্পশীলায় ঢুকলে মনে হতেই পারে দৃষ্টিভ্রম হয়েছে। সারিবদ্ধ মাটির বাড়িগুলির দেওয়ালে সিপিআই(এম) ছাড়া অন্য কোনও দলের দেওয়াল লিখন নেই।
স্থানীয় সিপিআই(এম) নেতৃত্ব আশাবাদী, শিলদা কলেজ বুথের ২টি আসনেই লালঝাণ্ডার প্রার্থীরা জিতবেন।
ঠিক কি ভাবে সম্ভব হল এই ‘অসাধ্য সাধন’?
গুরুপদ নন্দীর কথায়, ২০১৮’র পঞ্চায়েতে আমরা কিচ্ছু জিতিনি। কিন্তু তারপরেও আমরা ময়দান ছাড়িনি। যখন যেভাবে পেরেছি, আমরা মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। আর বিজেপি আপোষের রাস্তা বেছে নিল। এবং জায়গায় জায়গায় তৃণমূলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রকল্পের টাকা চুরি করতে শুরু করল। বিনপুরের মাটির অনেক গভীর অবধি আমাদের ভিত্তি রয়েছে। বিজেপির আপোষ আর দুর্নীতি দেখে মানুষ ফের আমাদের দিকে ফিরতে শুরু করলেন।
বিজেপির চুরির সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ হল হাড়দা পঞ্চায়েত। ২০১৮ সালে এই পঞ্চায়েতে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় বিজেপি। ১৪-০ ফলাফল। কিন্তু সেই পঞ্চায়েতে দুর্নীতি এমন পর্যায় পৌঁছয়, যে প্রধানের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনেন বিজেপিরই একটা অংশ।
বর্তমানে এই পঞ্চায়েতে বিজেপির অবস্থা ভাঙা গোয়ালের মতো। একটা অংশ তৃণমূলে গিয়েছে। একটা অংশ বিক্ষুব্ধ বিজেপি। একটা অংশ সরকারি বিজেপি, এবং বিজেপির নীচুতলার কর্মীদের একটা বড় অংশ ফেরত এসেছেন সিপিআই(এম)-এ।
এই অবস্থায় হাড়দার ১৭টি আসনের ১০টিতে রয়েছে সিপিআই(এম)’র প্রতীক। সিপিআই লড়ছে ১টি আসনে। সিপিআই(এম) সমর্থিত নির্দলরা লড়ছেন ৪টি আসনে। সবমিলিয়ে অনুকূল পরিবেশ।
একইভাবে শিলদা পঞ্চায়েতের ১৯টি আসনের মধ্যে সিপিআই(এম)’র প্রার্থী রয়েছে ১৭টি আসনে। বাঁশপাহাড়ি পঞ্চায়েতের ১২টি আসনের মধ্যে ১১টি আসনে রয়েছে সিপিআই(এম)’র প্রতীক।
সিপিআই(এম)’র সাংগঠনিক রিপোর্টও বলছে বিনপুর-২’র বাঁশপাহাড়ি, শিলদা, হাড়দা, সান্দাপাড়া, ভুলাভেদা, ভেলাইদিহা পঞ্চায়েতে জেতার অবস্থায় রয়েছে দল।
কেবল তথ্য এবং পরিসংখ্যানের কচকচানি নয়। শিলদা, হাড়দা, বাঁশপাহাড়ি সহ একের পর এক মাওবাদী অধ্যুষিত এলাকায় দৃশ্যত স্পষ্ট ভাবে চোখে পড়ছে সিপিআই(এম)’কে। লালঝাণ্ডাকে। পতাকা থেকে শুরু করে মাটির দেওয়ালে লিখন।
শিলদা থেকে ঝাড়গ্রাম শহরের দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার। বাসে সময় লাগে ১ ঘন্টা। দিনের আলো কমার সঙ্গে বাসের সংখ্যাও সমানতালে হ্রাস পায়। সেই শিলদা বাসস্ট্যান্ডের একটি ভাতের হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে কানে এলো, দুই স্থানীয় বৃদ্ধের কথোপকথনের ছেঁড়া টুকরো।
তার নির্যাস, এবার তৃণমূল আর বিজেপির পক্ষে ভোট পাওয়া কঠিন।
Comments :0