বিশ্বের বৃহত্তম রেল নেটওয়ার্ক রয়েছে যে ভারতে সেখানে যাত্রীদের কাছে রেল হয়ে উঠেছে আতঙ্কের সফর। বিশেষ করে মোদী জমানায় প্রচার সর্বস্ব উন্নয়নের জোয়ারে রেলের চলন্ত যাত্রীবাহী বগিগুলি এখন মৃত্যুকূপের শামিল। রেলে টিকিট জাগিয়ে তুলছে মৃত্যু পরোয়ানার ভীতিকে। যাত্রীবাহী ট্রেনের দুর্ঘটনা হয়ে উঠেছে নিত্যনৈমিত্তিক স্বাভাবিক ঘটনা। রেল স্টেশনে বা রেল কামরায় মোদীর প্রচারের উপকরণের অভাব নেই। নেই নয়নাভিরাম সাজসজ্জার। সর্বত্র সাজানো আছে মোদীর সঙ্গে ছবি তোলার সেলফি জোন। বন্দে ভারত সহ মোদী জমানায় চালু সব ট্রেনের কামরা পুরোপুরি মোদীময়। সারাক্ষণ অডিও-ভিডিও’র মাধ্যমে চলছে মোদীর মহিমা কীর্তন।
আত্মপ্রচারের কাজে সর্বাধিক তৎপরতা দেখা গেলেও যাত্রী পরিষেবার মানোন্নয়নে এবং সর্বোপরি যাত্রীদের নিরাপত্তা প্রশ্নে পুরোপুরি উদাসীন। বস্তুত বর্তমান রেল ব্যবস্থায় সবচেয়ে উপেক্ষিত ও অবহেলিত যাত্রী নিরাপত্তা। সময়ানুবর্তিতার কথা না বলাই ভালো। পরিষেবা নিয়ে তিরিবিরক্ত মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। ধরে নিয়েছেন এটাই ভবিতব্য।
লোকসভা নির্বাচনের পর প্রত্যাখ্যাত মোদীরা নীতীশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নাইডুর কাঁধে ভর দিয়ে কোনোরকমে সরকার গঠন করেছেন। পরজীবী সরকারের দু’মাস কাটতে না কাটতেই দেশবাসীকে তিন তিনটি ভয়াবহ রেল দুর্ঘটনা উপহার দিয়ে দিয়েছে। তাতে প্রাণ হারাতে হয়েছে ১৭জনকে। জীবনহানি হয়নি এমন অন্তত দশটি দুর্ঘটনা ঘটেছে এমাসেই। তারপরও কোনও তাপ-উত্তাপ নেই। দুর্ঘটনাহীন নিরাপদ রেলযাত্রা নয় মোদী সরকার দুর্ঘটনাকে রেলযাত্রার অনিবার্য অঙ্গ হিসাবে গ্রহণ করে নিরাপত্তার দায় থেকে হাত তুলে নিয়েছে। প্রচারের ফানুস ওড়ানোর জন্য প্রচারে খামতি নেই। দুর্ঘটনা এড়ানোর জন্য স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা অ্যান্টি কলিশন ডিভাইসের গল্প বহু বছর ধরে শুনতে শুনতে কান পচে গেছে। অজৈবিক প্রধানমন্ত্রী পরামাত্মার নির্দেশে সম্ভবত এই প্রযুক্তির নতুন নামকরণ করেছেন ‘কবচ’। প্রধানমন্ত্রী, রেলমন্ত্রীর মতো নিরাপত্তার প্রশ্নে এই ‘কবচ’ অকেজো। তাই দুর্ঘটনা কমার বদলে বেড়েই চলেছে।
প্রচারের চোখ ধাঁধানো আলোর পেছনে অন্ধকারে চাপা পড়ে আছে রেলের আসল সত্য, আসল বাস্তবতা। একদা যে রেল ছিল দেশের আর্থ-সামাজিক লাইফ লাইন। ছিল বৃহত্তম নিয়োগ কর্তা। রেলকে ঘিরে দেশের বৃহৎ জনসংখ্যার জীবন-জীবিকা আবর্তিত হয়। সেই রেলকেই রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব থেকে ছেঁটে ধাপে ধাপে কর্পোরেট পুঁজির মুনাফার লোভনীয় ক্ষেত্রে পরিণত করতে চায় মোদী সরকার। তাই রেলকে গুরুত্বহীন করতে, নজরদারির বাইরে ঠেলে দিতে পৃথক রেলবাজেট ব্যবস্থা তুলে দিয়ে মূল বাজেটের ভিড়ে ঢুকিয়ে অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া হয়। রেল নিয়ে আলোচনার সুযোগ ছেঁটে ফেলা হয়। তেমনি নিয়োগ কার্যত বন্ধ করে দিয়ে রেলের যাবতীয় কাজ তুলে দেওয়া হয় ঠিকাদারদের হাতে। রেল নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত পদগুলিই রেলে সর্বাধিক শূন্য। রেলের যাবতীয় যাত্রী পরিষেবা ও পণ্য বহন পরিষেবাও চলে গেছে বেসরকারি হাতে। এবার লক্ষ্য ট্রেন চালানোর দায়িত্বও বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া। অতঃপর বেসরকারি মালিকানায় চলে যেতে পারে গোটা রেল ব্যবস্থাটাই।
মোদী দাবি করেছেন তাঁর আমলে রেল বাজেট ৮গুণ বেড়েছে। বাজেটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যদি দুর্ঘটনা বাড়ে, জীবনহানি বাড়ে, নিরাপত্তা বিপন্ন হয়, পরিষেবার অবনতি হয় তাহলে তো বাজেট বরাদ্দ না বাড়াই ভালো। মোদী মোট বাজেট বাড়ার কথা বলেছেন। কিন্তু বর্ধিত বরাদ্দ কোথায় খরচ হচ্ছে সেটা বলেননি। বর্ধিত ব্যয়ের সবটাই প্রায় খরচ হচ্ছে বুলেট ট্রেন, বন্দে ভারতের পেছনে। আর বড় অঙ্কের খরচ হচ্ছে মোদীর ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সীমাহীন প্রচারে। তথাকথিত মডেল স্টেশনের নামে প্রসাধনী সাজের পেছনেও খরচ হচ্ছে বিপুল। পাশাপাশি স্টেশনগুলিকে বিপণন মল বানিয়ে বেসরকারি সংস্থার মুনাফার ব্যবস্থা হচ্ছে। সরকারের নজর এদিকেই বেশি। তাই যাত্রী নিরাপত্তা, যাত্রী স্বাচ্ছন্দ্য অবহেলিত ও উপেক্ষিত। এই অবস্থায় দুর্ঘটনা ঘটবেই। জীবনহানি হবেই। মোদী সরকার প্রচারে মগ্ন থাকবে। রেলমন্ত্রী বিল বানিয়ে সংবাদমাধ্যমে আত্মপ্রচার করে পরম তৃপ্তিবোধ করবেন।
Rail Passenger Safety
অভিশপ্ত রেলযাত্রা
×
Comments :0