বিশ্বজিৎ মুখার্জি
প্রাকৃতিক নিয়ম অনুযায়ী প্রত্যেকটি ঋতু পরিবর্তনের সময় প্রকৃতিতে প্রতিভাত হয় কয়েকটি বৈশিষ্ট্য । গ্রীষ্মের দাবদাহের আগে চৈত্র মাসের উষ্ণতা আমাদের জানান দেয় যে গ্রীষ্মকাল আগত । বর্ষার আগে কালো মেঘের ঘনঘটা বা নীল আকাশে সাদা মেঘের ভেলা আমাদের মনে করিয়ে দেয় বর্ষা অথবা শরৎ আগত। পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক জীবনে বিভিন্ন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবার আগে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত হয় এবং রাজ্যের রাজনীতিমনস্ক মানুষরা ক্রমান্বয়ে বুঝতে আরম্ভ করেন নির্বাচন আগত ।
এখন প্রশ্ন হলো, এমন কি বৈশিষ্ট্য পশ্চিমবঙ্গের মাটিতে জন্ম নিয়েছে যা আমাদের আসন্ন নির্বাচনী লড়াই সম্পর্কে আগাম জানান দিতে পারে? বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অন্যতম পূর্বাভাস রাজ্যের সর্বত্র বোমা এবং অস্ত্র উদ্ধার। আর দুর্বৃত্তদের যত্রতত্র ফেলে রাখা বোমা থেকে শিশু মৃত্যুর মিছিল। পশ্চিমবঙ্গে এই মুহূর্তে প্রবল আলোচিত বিষয়ের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয় আসন্ন ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচন। বিগত একমাসের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ব্যাপক বোমা ও অস্ত্র উদ্ধার হয়েছে এবং এই বোমা তৈরির আঁতুড়ঘর হলো বেআইনি বাজি তৈরির কারখানাগুলি। ন্যাশনাল গ্রিন ট্রাইব্যুনাল একটি মামলার পরিপ্রেক্ষিতে রাজ্যের বিভিন্ন সংস্থাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বেআইনি বাজি কারখানাগুলি বন্ধ করার জন্য । তারপরে প্রায় আট বছর অতিক্রান্ত কিন্তু সেই আদেশ যে কতোখানি কার্যকর হয়েছে তার জ্বলন্ত উদাহরণ হল প্রতিনিয়ত বেআইনি বাজি কারখানার বিস্ফোরণ বা ফেলে যাওয়া মারণ বোমার আঘাতে শিশু মৃত্যুর খতিয়ান। এই সমস্ত ঘটনা সুনির্দিষ্টভাবে ইঙ্গিত করে যে আসন্ন পঞ্চায়েত নির্বাচনের পটভূমি তৈরি হচ্ছে পরিবেশ আইন ভঙ্গ করে এবং যাঁরা এই পঞ্চায়েত— এ নির্বাচিত হবেন তাঁদের কাছে পরিবেশ সংরক্ষণের ব্যাপারটি কতোটা কার্যকরী হবে তা নিয়ে যথেষ্ট আশঙ্কার কারণ রয়েছে ।
গ্রাম বাংলায় শিল্প দূষণ
১৯৯৮ সালে কেন্দ্রীয় দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের পরামর্শ মতো পশ্চিমবঙ্গের বুকেও বিভিন্ন ধরনের শিল্পের অবস্থান গত নীতি চালু করা হয় এবং সেই নীতি অনুযায়ী সমস্ত দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্পের ক্রমবিকাশ ঘটতে থাকে গ্রাম বাংলায়। অবশ্য কয়েক ধরনের শিল্প প্রাকৃতিক সম্পদ ও বিভিন্ন কারণে দীর্ঘকাল ধরে গ্রাম বাংলায় গড়ে উঠেছে। যেমন ইটখোলা, পাথর ভাঙার কল, বিস্তৃত কয়লাখনি, চালকল সহ বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল ও লৌহ ইস্পাত শিল্প বিকশিত হয়েছে পঞ্চায়েত নিয়ন্ত্রিত গ্রাম বাংলার বুকে। এই সমস্ত শিল্পের মধ্যে অন্যতম দূষণ সৃষ্টিকারী শিল্প স্পঞ্জ আয়রন কারখানা, পাথরকল ও বিভিন্ন কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি । অতীতে আমাদের ধারণা ছিল গ্রাম বাংলায় শিল্প দূষণ নেই, কিন্তু বাস্তবে আজ গ্রাম বাংলা শিল্প দূষণের অন্যতম পরিমণ্ডলে আবর্তিত। গ্রামের মানুষ মারাত্মকভাবে দূষণে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাঁদের কৃষিজমি, বিভিন্ন ফলমূলের বাগান, সবজি চাষ, ফুল চাষ সহ গ্রামীণ উৎপাদন দূষণে আক্রান্ত। প্রত্যেকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে পঞ্চায়েতের অনুমতি নিতে হয় কিন্তু শিল্পগুলি দূষণ জনিত সমস্যা নিয়ে পঞ্চায়েতের কর্মকর্তাদের বিশেষ কোনও উদ্যোগ নেই এবং দূষণ পর্ষদ বা জেলা প্রশাসনও এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ উদাসীন ।
প্রাকৃতিক সম্পদের লুণ্ঠন
সমস্ত গ্রাম বাংলাজুড়ে দুটি প্রাকৃতিক সম্পদ যথেচ্ছভাবে লুণ্ঠিত হচ্ছে সেগুলি যথাক্রমে মাটি ও বালি । এমনকি সুন্দরবনের মাটির বাঁধ কেটেও মাটি লুট করা হচ্ছে কিন্তু প্রশাসন প্রায় নির্বিকার। মাফিয়ারা মাটি এবং বালি লুণ্ঠন করে লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করছে এবং সবকিছু দেখেশুনেও স্থানীয় পঞ্চায়েত, ভূমি রাজস্ব দপ্তর, সেচ দপ্তর প্রায় কিছুই করতে পারছে না। যদিও বা কয়েকজন উদ্যোগী সরকারি আধিকারিক কিছু করার চেষ্টা করছেন তাঁরা দ্রুত আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে উঠছেন ।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা
পশ্চিমবঙ্গের বুকে মূলত চারটি বর্জ্য ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত নিয়ম চালু আছে । যথাক্রমে— কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ম ২০১৬, চিকিৎসাজনিত বর্জ্য ব্যবস্থা ১৯৯৮, প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ন্ত্রক আইন ২০১৬ ও ক্ষতিকর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ম ১৯৮৯। এই আইনগুলি সম্পর্কে পঞ্চায়েতের প্রতিনিধিদের বা পঞ্চায়েতের প্রশাসকদের ধারণা সম্ভবত অত্যন্ত ক্ষীণ। ফলে শিল্প বর্জ্য, চিকিৎসা বর্জ্য, প্লাস্টিক বর্জ্য ও কঠিন বর্জ্য কোন আইন-ই পঞ্চায়েত এলাকাতে কার্যকর হয় না। শহর এলাকাতে বিভিন্ন বর্জ্য সংক্রান্ত আইনের কার্যকারীতা কমবেশি থাকলেও গ্রাম বাংলায় এই বিষয়গুলি কোনোরকম আলোচনাতেও স্থান পায় না । তার ফলে সমগ্র গ্রাম বাংলাই ক্রমান্বয়ে নানাধরনের দূষিত বর্জ্যের দ্বারা আক্রান্ত। পশ্চিমবঙ্গ পঞ্চায়েত আইন ১৯৭৩-এর মধ্যে পরিবেশ বিষয়ক বেশ কয়েকটি আইনি ধারা বর্তমান কিন্তু পঞ্চায়েতের কর্মকর্তাদের অজ্ঞানতা, দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদ ও পরিবেশ দপ্তরের গ্রাম বাংলার দূষণ পরিস্থিতি সম্পর্কে উদাসীনতা যথেষ্ট উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ।
বনাঞ্চল ধ্বংস
পশ্চিমবঙ্গের বুকে এখনও যেটুকু সংরক্ষিত বনাঞ্চল বা সামাজিক বনাঞ্চল বর্তমান তার সম্পূর্ণটাই গ্রাম বাংলাজুড়ে। কিন্তু চোখ ফেরালেই দেখা যায় উন্নয়ন যজ্ঞের নাম করে কাঠ চুরি বা রাস্তা সম্প্রসারণের নামে অসংখ্য পুরানো গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে এবং রাজ্যের বৃক্ষ সংক্রান্ত আইন অনুযায়ী গাছ কাটার পরে পুনরায় গাছ লাগানোর যে নিয়মনীতি রয়েছে তা সম্পূর্ণ অবহেলিত। একটা সময় সামাজিক বনসৃজনে পশ্চিমবঙ্গ অগ্রণী ভূমিকা নিলেও আজ সর্বত্রই চোখে পড়বে অরণ্য ধ্বংসের এক নির্মম চিত্র। পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চল, দক্ষিণের লালমাটির এলাকা ও দক্ষিণের সুন্দরবনে যেটুকু বনসম্পদ এখনও বেঁচেবর্তে আছে আজ তাও চূড়ান্তভাবে আক্রান্ত। অরণ্য সম্পদকে রক্ষার জন্য পঞ্চায়েত বা বনদপ্তরের ভূমিকা প্রয়োজনের তুলনায় অকিঞ্চিৎকর।
জীববৈচিত্রের সর্বনাশ
পশ্চিমবঙ্গের জীববৈচিত্র পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে । বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ ও সুন্দরবনের জীববৈচিত্র এ রাজ্যের সম্পদ। জীববৈচিত্র রক্ষার্থে পশ্চিমবঙ্গে জীববৈচিত্র পর্ষদ গঠন করা হয়েছে। কিন্তু পঞ্চায়েত এলাকাতে জীববৈচিত্র ব্যবস্থাপনা সমিতি বেশিরভাগ জায়গাতে গড়েই ওঠেনি! যদিও বা কাগজে কলমে গড়ে উঠে থাকলেও তার কার্যকারিতা প্রায় শূন্যমার্গে। উত্তরবঙ্গে হাতির মৃত্যু, বাইসনের মৃত্যু বা হাওড়াতে "মেছো বেড়াল"-এর মৃত্যু আজ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। কেবলমাত্র জীবজন্তু নয় বিভিন্ন ধরনের বনজ সম্পদও আজ জীববৈচিত্রের অঙ্গ। বহু আলোচনা সত্ত্বেও সুন্দরবনে ম্যানগ্রোভ অরণ্য ধ্বংস হচ্ছে । এই ম্যানগ্রোভ অরণ্যের উপর নির্ভরশীল জীববৈচিত্র আজ সঙ্কটের মুখে ।
নদী বা জলাভূমি ধ্বংস
সমস্ত পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে অসংখ্য নদী এবং পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত এলাকাতে ব্যাপক জলাভূমি অবস্থিত । পশ্চিমবঙ্গে এমন কোনও জেলা নেই যেখানে জলাভূমির অস্তিত্ব নেই। কলকাতার আশপাশে যে বিস্তৃত জলাভূমি ছিল যথাক্রমে- পূর্ব কলকাতার জলাভূমি, ডানকুনির জলাভূমি, জয়পুর বিল, সাঁতরাগাছি বিল সহ নদীয়া, বর্ধমান, বাঁকুড়া, মুর্শিদাবাদ, মালদা সর্বত্র যে বিস্তৃত জলাভূমি বিরাজ করতো বা আজও কিছুটা অস্তিত্ব আছে তাকে রক্ষা করার ব্যাপারে পঞ্চায়েতের সামান্যতম উদ্যোগও আছে বলে মনে হয় না। সমস্ত নদীগুলি দূষণে ভারাক্রান্ত, যদিও পঞ্চায়েত আইনে জলাভূমি সংরক্ষণের আইনে পঞ্চায়েতের সুনির্দিষ্ট ভূমিকা বর্ণিত আছে। কিন্তু মাটি চুরি, বালি চুরি, গাছ চুরি, প্রাকৃতিক.সম্পদ ধ্বংসের এক নির্মম সাক্ষী গ্রাম বাংলার ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা ।
পশ্চিমবঙ্গে পরিবেশ অপরাধের যদি সমীক্ষা করা যায় তাহলে দেখা যাবে গ্রাম বাংলাতেই সব থেকে বেশি পরিবেশ অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে এবং এই পরিবেশ অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য যে সমস্ত সরকারি দপ্তর দায়িত্বশীল তাদের ভূমিকা আজ বড়ই হতাশাজনক। পশ্চিমবঙ্গের বুকে পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে বোমা আর অস্ত্রের মারণ উল্লাসে। আমরা পঞ্চায়েতে বসবাস করি বা না করি, পঞ্চায়েত এলাকাতে যদি পরিবেশ অপরাধ নিয়ন্ত্রণ করা না যায়, তবে আগামী দিনে শহরের মানুষজনও আক্রান্ত হবে। তাই শহর থেকে গ্রাম সর্বত্রই প্রয়োজন পরিবেশ আইনের সঠিক কার্যকারিতা তৎসহ পরিবেশ বান্ধব অগ্রগতির বহমানতা, যা আগামী প্রজন্মকে দেবে স্বস্তির নিঃশ্বাস ।
Comments :0