Supreme court verdict

প্যান্ডোরার বাক্স খুলেছে এই রায়

জাতীয় বিশেষ বিভাগ ফিচার পাতা

শমীক লাহিড়ী

১১ ডিসেম্বর। সুপ্রিম কোর্টের ৫ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চের রায়ে কয়েকটি গুরুতর মৌলিক সংশয় দেশের সংবিধানের সামনে উপস্থিত করেছে।
কি আছে রায়ে?
এই রায়ের মূল বিষয় – ১) সংবিধানের ৩৭০ নং অনুচ্ছেদ বাতিল করা বৈধ এবং জম্মু-কাশ্মীরের আভ্যন্তরীণ সার্বভৌমত্ব নেই। ৩৭০ ধারা অস্থায়ী। ২) জম্মু-কাশ্মীর ভাগ করে লাদাখকে কেন্দ্র শাসিত অঞ্চল তৈরির সিদ্ধান্ত বৈধ, ৩) দ্রুত জম্মু-কাশ্মীরের রাজ্যের মর্যাদা ফিরিয়ে আনতে হবে এবং লাদাখ বাদে জম্মু-কাশ্মীরে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সালের মধ্যে বিধানসভার নির্বাচন করতে হবে, ৩) রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ বৈধ, ৩৫৬ নং অনুচ্ছেদের অধীনে নির্দেশ জারি হলে কেন্দ্রের নেওয়া সব সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে মামলা করা যায় না। ৪) জম্মু-কাশ্মীরে মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখার জন্য সত্য উদ্ঘাটনে বিবাদ মীমাংসার জন্য একটি কমিশন গঠন করা হোক।
সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ তো সবার জন্যই শিরোধার্য। কিন্তু যে সংশয়গুলো তৈরি হ’লো এই রায় নিয়ে, তা ব্যক্ত করা নিশ্চয়ই আদালত অবমাননার আওতায় পড়ে না। 
৩৭০ অনুচ্ছেদ কেন এবং কিভাবে এল
১৯৪৯ সালে ১৭ অক্টোবর ভারতবর্ষের সংবিধানে ৩৭০নং ধারা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য গণপরিষদে উত্থাপিত হয়। এই ধারাটিই জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের গণপরিষদে ৩০৬এ ধারা হিসাবে গৃহীত হয়েছিল আগেই। এই ধারা অনুযায়ী জম্মু-কাশ্মীরকে ভারতীয় সংবিধানের আওতার বাইরে রাখা হয় (১নং অনুচ্ছেদ ব্যতিরেকে) এবং ঐ রাজ্যকে নিজস্ব সংবিধান রচনার অধিকার দেওয়া হয়। ৩৭০নং ধারা অনুযায়ী (ক) কেন্দ্রীয় সরকার বা লোকসভাকে এককভাবে আইন প্রণয়ন বা সংশোধনের বা প্রত্যাহারের ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। সংবিধানের কেন্দ্রীয় তালিকা বা যুগ্ম তালিকার ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারের সম্মতি ছাড়া আইন বা অধ্যাদেশ জারি করা যায় না। (খ) সংযুক্তির সময় যে যে বিষয়গুলি কেন্দ্রীয় বা রাজ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়নি, সেগুলি সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে গেলে রাজ্য সরকারের সম্মতি লাগে। (গ) ভারতীয় সংবিধানের অন্য সব ধারা জম্মু-কাশ্মীরের জন্য প্রযোজ্য হয় কয়েকটি শর্তের ভিত্তিতে। যেমন- লোকসভার আইনগত অধিকারের মধ্যে যা কিছু আছে, রাজ্য সরকারের সাথে সেগুলি আলোচনা করেই প্রয়োগ করতে হবে, লোকসভার আইনগত অধিকারের বাইরে কোনও কাজ করতে হলে রাজ্য সরকারের সম্মতি প্রয়োজন।
অনেক আগেই পালটে গেছে 
যদিও পরবর্তীতে মূল ৩৭০নং ধারার বেশির ভাগই পালটে ফেলা হয়েছে। ১৯৫৪ সালে এই ধারা ব্যবহার করেই তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এক অধ্যাদেশে ঘোষণা করেছিলেন ভারতীয় সংবিধানের কোন কোন বিষয়গুলি সংশোধন বা সংযোজন ব্যতিরেকে জম্মু-কাশ্মীরে প্রয়োগ করা যাবে। ১৯৫৪ সালের আগে লোকসভা কেবলমাত্র ৩টি বিষয় হস্তক্ষেপ করতে পারত- প্রতিরক্ষা, যোগাযোগ এবং বৈদেশিক বিষয়। কিন্তু পরবর্তীতে কেন্দ্রীয় তালিকার সবকটি বিষয়ই জম্মু-কাশ্মীরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করা হলো। 
১৯৫৬ সালের ১৭ নভেম্বর জম্মু-কাশ্মীরে সংবিধান গৃহীত হলো এবং বলা হলো জম্মু-কাশ্মীর ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ আছে এবং থাকবে। ১৯৫৮ সালে আবার একটি সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে জম্মু-কাশ্মীরকে কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কাজের আওতাভুক্ত করা হলো। ১৯৬৪ সালে আবার আর একটি সংবিধান সংশোধনীর মাধ্যমে জম্মু-কাশ্মীরকে পুরোপুরি ভারতের একটি প্রদেশে পরিণত করা হলো এবং ৩৫৬ নং ধারা জম্মু-কাশ্মীরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করা হলো। এই সংশোধনী অনুযায়ী সংবিধানের এই ধারা প্রয়োগ করে রাজ্যের নির্বাচিত বিধানসভা ভেঙে দিতে পারে কেন্দ্রীয় সরকার। এই ধরনের বিভিন্ন সংশোধনীর মাধ্যমে মূল ৩৭০নং ধারাটির মূলগত বৈশিষ্ট্যগুলি বিলুপ্ত হলো। সবশেষে সংবিধানের ৩৯৫টি ধারার মধ্যে ২৬০টি ধারা জম্মু-কাশ্মীরের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ছিল ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত। বাকি ১৩৫টি ধারার ক্ষেত্রে রাজ্য এবং ভারতের সংবিধানের মধ্যে কোনও পার্থক্য ছিল না। ৪৭টি যুগ্ম তালিকার মধ্যে ২৬টি বিষয় ছিল রাজ্যের অধিকারের বাইরে। তাহলে সহজেই বোঝা যাচ্ছে কাশ্মীরের জন্য আলাদা বিশেষ কোনও সুবিধা শেষ পর্যন্ত আর ছিল না, কেবলমাত্র স্থানীয় অধিবাসীদের চিহ্নিতকরণ এবং জমির অধিকার ছাড়া।
তাহলে ৩৭০ ধারায় অবশিষ্ট যা ছিল তাতে মোদী-শাহ সরকারের কোন পাকা ধানে মই লেগেছিল? শুধুই জম্মু-কাশ্মীর মানে মুসলমানদের বিরুদ্ধে জিগির তোলা ছাড়া আর কোনও উদ্দেশ্য বিজেপি সরকারের নেই। দুঃখের কথা সে জিগির তোলায় এখন আদালতের সিলমোহর পড়ল।

সংশয় ১– ৩৭০ বাদ কিন্তু ৩৭১ থাকবে?
কাশ্মীরের জন্য আলাদা সার্বভৌমত্ব থাকতে পারে না, এই হ’লো বিজেপি’র বক্তব্য, যাতে সিলমোহর পড়ল আদালতের। সংশয় কিন্তু রয়েই গেল। 
প্রথমেই বলে রাখা ভালো ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশ স্বাধীন হওয়ার সময় জম্মু-কাশ্মীর সহ অনেকগুলি করদ রাজ্য ভারতবর্ষের অঙ্গ রাজ্য ছিল না। আগেই বলা হয়েছে ভারতবর্ষের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু এবং শেখ আবদুল্লার মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তিপত্রের অধিকাংশ অধিকারই ক্রমান্বয়ে বিলুপ্ত হয়েছে স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে। ভারতবর্ষের সংবিধানের ৩৭০নং এবং ৩৭১নং ধারায় ১১টি রাজ্যকে বিশেষ অধিকার দেওয়া হয়েছে ঐতিহাসিক অনেকগুলো কারণে। 
সংবিধানের এই ধারাগুলি অনুযায়ী মণিপুর-নাগাল্যান্ড-সিকিম-অরুণাচল-মিজোরাম-আসামের কিছু অঞ্চল-মহারাষ্ট্রের কিছু অঞ্চল, গুজরাটের বিদর্ভ ও কচ্ছ, গোয়া, কর্ণাটকের কিছু অঞ্চল, অন্ধ্রপ্রদেশের কিছু অঞ্চলের নাগরিকরা বিশেষ কিছু সুবিধা পেয়ে থাকেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি রাজ্যে ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্যের নাগরিকরা জমি কিনতে পারে না। বিজেপিওয়ালারা প্রশ্ন করে জম্মু-কাশ্মীরের বাইরের লোক কেন সেখানে জমি কিনতে পারবে না। উল্লেখ্য, কাশ্মীরী পণ্ডিতদের দাবিতে ১৯৩৫ সালে সেখানকার রাজা হরি সিং, যিনি পরবর্তীতে হিন্দু মহাসভার নেতা হয়েছিলেন, এই আইন তৈরি করেন এবং ৩৭০নং ধারা কেবলমাত্র এটিকে মান্যতা দেয়। দেশের আরও ১১টি অঞ্চলে সেখানকার স্থায়ী বাসিন্দা ছাড়া জমি কিনতে পারে না দেশের অন্যান্য রাজ্যের নাগরিকরা। অরুণাচল এবং নাগাল্যান্ডে প্রবেশ করতে গেলে ভারতীয় নাগরিকদের বিশেষ পারমিট নিতে হয়। 
ফলে কেবলমাত্র জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের এই অধিকার আছে, এটি চূড়ান্ত অসত্য। যদি জম্মু-কাশ্মীরের নাগরিকদের সংবিধানের বিশেষ অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়, তাহলে অন্যান্য ১০টি রাজ্যের নাগরিকদের জন্য বিশেষ অধিকার বলবৎ থাকছে কেন? তাহলে কি হিন্দু-মুসলমান জনসাধারণকে বিভাজনের জন্যই কাশ্মীরকে বেছে নেওয়া হল? অন্য ১০টি রাজ্য/অঞ্চলের মানুষের বিরুদ্ধে ধর্মীয় জিগির তুলে বিভাজনের কাজ করা যাবে না বলেই ৩৭১নং ধারা বাদ দিয়ে ৩৭০নং ধারাকে লক্ষ্য করা হল?
এই সংশয় কাটলো কি এই রায়ে?

রাজ্যের নিজস্ব পতাকা কেন
এক দেশ-এক পতাকা-এক আইন-এক রাষ্ট্রপতি সমগ্র দেশের জন্য কেন প্রযোজ্য হবে না- এই হচ্ছে আরএসএস-বিজেপি সহ হিন্দুত্ববাদীদের প্রশ্ন। 
আমাদের দেশটা এক। পতাকাও একটা। ভারতবর্ষের রাষ্ট্রপতি কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, কচ্ছ থেকে মণিপুর সমগ্র দেশেরই রাষ্ট্রপতি। যারা প্রচার করছে জম্মু-কাশ্মীরের জন্য আলাদা আইন-পতাকা-রাষ্ট্রপতি থাকবে কেন, তারা সর্বৈব অসত্য প্রচার করছেন। 
জম্মু-কাশ্মীর রাজ্যের নিজস্ব একটি পতাকা ছিল ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত। বিজেপি অসত্য প্রচার করে জম্মু-কাশ্মীরে জাতীয় পতাকা তোলা হয় না। জম্মু-কাশ্মীরের সর্বত্র সমস্ত সরকারি দপ্তরে রাজ্যের পতাকার সাথেই জাতীয় পতাকাও সমমর্যাদায় উত্তোলন করা হয় বরাবরই। এই পতাকার একটি ইতিহাস আছে। ১৯৩১সালে ১৩ জুলাই তৎকালীন ডোগরা রাজাদের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন গড়ে ওঠে। আন্দোলনরত কৃষকদের ওপর রাজার পুলিশ গুলি চালালে ২১ জন কৃষকের মৃত্যু হয়। আন্দোলনকারীরা শহীদ কৃষকদের রক্তে ভেজা জামা নিয়ে মিছিল করে এবং সেটাকেই তাদের পতাকা হিসাবে ঘোষণা করে। এই জন্যই ঐ রাজ্যের সর্বত্র ১৩ জুলাই ছূটি থাকে। অবশেষে ১৯৫২ সালের ৭ জুন জম্মু-কাশ্মীরের সংবিধান পরিষদ এই পতাকাকে রাজ্যের পতাকা হিসাবে ঘোষণা করে। 
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ১৯৭৪ সালে কর্ণাটক রাজ্য নিজেদের পতাকা তৈরি করে, যাকে ২০১৮ সালের ৮মার্চ কর্ণাটক সরকার সে রাজ্যের পতাকা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়। এর ৯ দিন পরেই বিধায়ক কেনাবেচা করে মাত্র কয়েকদিনের জন্য বিজেপি সরকার গঠন করেছিল। আবার একইভাবে পেছনের দরজা দিয়ে সরকারে এসে ক্ষমতায় ৪ বছর ছিল বিজেপি। সেই রাজ্যের পতাকা তো বাতিল করেনি তারা। কেন? একটাই কারণ, সেখানে এই পতাকা বাতিল করে মুসলমান বিরোধী জিগির তুলে হিন্দুদের খেপিয়ে বিদ্বেষ-বিভাজনের রাজনীতি করা যাবে না। 
২০১৫ সালের ৩ আগস্ট নাগাল্যান্ডের ন্যাশনাল সোসালিস্ট কাউন্সিল অফ নাগাল্যান্ড ইশক্ মুইভার সাথে একটা চুক্তি স্বাক্ষর করে মোদী সরকার। এই চুক্তির বহু বিষয় তো ৩৭১ নং অনুচ্ছেদেও নেই। এই চুক্তিতে তাদের রাজ্যের পৃথক পতাকা, বিশেষ মর্যাদা দান এই সব বিষয়েরই উল্লেখ ছিল। তাহলে সেটা অসাংবিধানিক নয় কেন?

সংশয় ২ – ৩৭০ ধারা কি ইতিহাস নিরপেক্ষ?  
সংবিধানে ৩৭০নং ধারা থাকতে পারে না, কারন তা অস্থায়ী এবং দেশের মধ্যে রাজ্যের সার্বভৌমত্ব দেয়, যা সংবিধানের পরিপন্থী। এই যুক্তিই দেওয়া হচ্ছে। 
আমাদের দেশের সংবিধানে ৩৭০নং ধারার একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট আছে। ভারতবর্ষে স্বাধীনতার পূর্বে ৫৮৫টি করদ রাজ্য ছিল। তার মধ্যে জম্মু-কাশ্মীর, বরদা, হায়দ্রাবাদ, মহীশূর, উদয়পুর সহ কয়েকটি রাজ্য ছিল খুবই বড়। ইংরেজদের সাথে এদের চুক্তি ছিল। সেই চুক্তিগুলি অনুযায়ী এরা রেল-যোগাযোগ, ডাক ব্যবস্থা সহ কিছু বিষয় ব্রিটিশ সরকারকে কাজ করতে দিত এবং ব্রিটিশ সরকারকে কর বাবদ অর্থ দিত। কিন্তু সাধারণভাবে রাজা বা নবাবদের নেতৃত্বে আইনগতভাবে এরা সার্বভৌম ছিল। স্বাধীনতার সময় এদের কাছে ৩টি ব্যবস্থা পছন্দ মত বেছে নেওয়ার সুযোগ ছিল। (ক) স্বাধীন রাষ্ট্র তৈরি করা, (খ) ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত হওয়া, (গ) পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়া। এর মধ্যে ক্রমান্বয়ে ৫৬৫টি করদ রাজ্য সিদ্ধান্ত নেয় ভারতবর্ষে অন্তর্ভুক্ত হবে। লিখিতভাবে না থাকলেও কি কি শর্তে রাজ্যগুলি কোনও একটি রাষ্ট্রে যোগ দেবে তা নির্ধারণ করবার অধিকার তাদের ছিল। কোনও পক্ষ শর্ত লঙ্ঘন করলে দুপক্ষই পূর্ববর্তী নিজেদের অবস্থানে ফিরে যেতে পারবে, এমন আলোচনাও হয়েছিল।
জম্মু-কাশ্মীরের তৎকালীন ডোগরা বংশের রাজা হরি সিং প্রাথমিকভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে থাকার সিদ্ধান্ত নেন এবং ভারত ও পাকিস্তানের সাথে স্থিতাবস্থার চুক্তি স্বাক্ষর করেন। কিন্তু চুক্তি ভেঙে পাক সেনা কিছু উপজাতিকে সামনে রেখে কাশ্মীর দখলের উদ্দেশ্যে শ্রীনগরের ২০কিলোমিটার আগে পর্যন্ত দখল করে। এই অবস্থায় ১৯৪৭সালে ২৬ অক্টোবর রাজা হরি সিং ভারত ভুক্তির চুক্তি স্বাক্ষর করে পাঠান এবং ২৭ অক্টোবর ১৯৪৭ তৎকালীন ভারতবর্ষের গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন সেই চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তবে একই সাথে ভারত সরকারের পক্ষে লর্ড মাউন্টব্যাটেন ঘোষণা করেন- ‘সরকার মনে করে কাশ্মীর আক্রমণকারীদের হাত থেকে মুক্ত হওয়ার পরেই সেই রাজ্যের ভারত ভুক্তির বিষয়টি রাজ্যের নাগরিকদের দ্বারা স্থিরীকৃত হওয়া উচিত’।

৩০৬ থেকে ৩৭০ 
কাশ্মীরের ভারত ভুক্তি যে সাময়িক সিদ্ধান্ত, তা ১৯৪৮সালে জম্মু-কাশ্মীর বিষয়ক শ্বেতপত্রে ঘোষণা করে জানায় ভারত সরকার। ১৯৪৯ সালের ১৭ মে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু জম্মু-কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী শেখ আবদুল্লাকে একটি চিঠি লেখেন, বল্লবভাই প্যাটেল এবং এন গোপালস্বামী আয়েঙ্গারের সম্মতিক্রমে। সেই চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেন- ‘ভারত সরকারের স্থির সিদ্ধান্ত, জম্মু-কাশ্মীরের সংবিধান সে রাজ্যের অধিবাসীদের নিয়ন্ত্রণের বিষয়। সেই মতামতের প্রতিনিধিত্ব করার জন্যেই গণপরিষদ গঠিত হয়েছে’। ভারত ভুক্তির শর্ত বর্ণিত খসড়াটি জম্মু-কাশ্মীরের সরকারকে দেওয়া হয়েছিল এবং কিছু পরিবর্তনের পর ২৭ মে, ১৯৪৯ সালে তৎকালীন জম্মু-কাশ্মীরের গণপরিষদে পাশ করা হয় ‘৩০৬এ’ ধারা। পরবর্তীতে ভারতীয় সংবিধানে ৩৭০ ধারা হিসাবে এটি সংযোজিত হয়। এই প্রস্তাব পেশ করার সময় এন গোপালস্বামী আয়েঙ্গার বলেন- ‘যদিও ভারত ভুক্তির কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে তা সত্ত্বেও ভারতবর্ষের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে যে পরিস্থিতি তৈরি হলে গণভোট নেওয়া হোক, এবং গণভোটে ভারত ভুক্তি যদি গৃহীত না হয় তাহলে আমরা কাশ্মীরকে ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথে বাধা সৃষ্টি করব না’।
এই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বাদ দিয়ে বিচ্ছিন্ন ভাবে এই অনুচ্ছেদকে বিচার করা যায়?

সংশয় ৩– আগের রায়গুলো কি অসাংবিধানিক?
ভারতবর্ষের সংবিধানে উল্লিখিত ৩৭০নং ধারা সাময়িক, এই হ’লো সর্বোচ্চ আদালতের মত। কিন্তু নিম্নলিখিত সংশয়গুলো তো থেকেই যাচ্ছে।
সংবিধানের একবিংশ অংশের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে ছিল ৩৭০নং ধারা। এটা ঠিক যে, এর শিরোনামে লেখা আছে এটা সাময়িক, পরিবর্তন সাপেক্ষ এবং বিশেষ বিধান। তাই অনেকেই ব্যাখ্যা করেন এই ধারাটি সাময়িক। 
সাময়িক সময়ের জন্য এটা রচিত হয়েছিল। জম্মু-কাশ্মীরের গণপরিষদ এবং পরবর্তীতে জম্মু-কাশ্মীর বিধানসভা এই ধারার পরিবর্তন, বিলোপসাধন অথবা একই রূপে রেখে দিতে পারে। জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা এই ধারাটিকে বজায় রাখার সিদ্ধান্ত নেয়, ফলে এটি সাময়িক নয়। এই নিয়ে স্বাধীনোত্তর ভারতবর্ষে অনেক বিতর্ক দেখা যায়। ১৯৬৯ সালে সম্পৎ প্রকাশ মামলায় সুপ্রিম কোর্ট এই ধারাকে সাময়িক আখ্যা দেওয়ার আবেদনকে সরাসরি নাকচ করে। দিল্লি হাইকোর্টে কুমারী বিজয়লক্ষ্মী একটি মামলায় দাবি করেন ৩৭০নং ধারা সাময়িক এবং এই ধারাটিকে বহাল রাখা আসলে সংবিধানের প্রতি জালিয়াতি। দিল্লি হাইকোর্ট এই মামলাও খারিজ করে দেয়। ২০১৮ সালের ৩ এপ্রিল সুপ্রিম কোর্ট আর একটি মামলায় সরাসরি জানিয়ে দেয়, শিরোনামে সাময়িক শব্দটি লেখা থাকলেও এই ধারাটি সাময়িক নয়। বিভিন্ন সময় এই রায়গুলিতে আদালত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় এই ধারাটির শিরোনামে ‘সাময়িক’শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছিল তৎকালীন গণপরিষদকে প্রস্তাবিত ধারাটি সংশোধনী-সংযোজনী অথবা বিলোপ সাধনের অধিকার দেওয়ার জন্য। কিন্তু তৎকালীন গণপরিষদ এবং পরবর্তীতে বিধানসভা এই ধারাটি বজায় রাখার পক্ষে মত দেয়, ফলে এটি ‘সাময়িক’নয়।
তাহলে আগে কি সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা সবাই অসাংবিধানিক রায় দিয়েছিলেন?

সংশয় ৪- ৩৭০ কি বিলোপযোগ্য? 
এটা ঠিক উপধারা ৩৭০(৩) অনুযায়ী ৩৭০নং ধারা বিলোপ করা যেতেই পারে রাষ্ট্রপতির আদেশের ভিত্তিতে। তবে এই আদেশের জন্য জম্মু-কাশ্মীরের গণপরিষদের সম্মতি প্রয়োজন। কিন্তু ১৯৫৭ সালের ২৬ জানুয়ারি সেই গণপরিষদ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। তাই সংবিধান বিশেষজ্ঞদের অনেকের মত, এই ধারা বিলোপ করা যায় না। আবার একাংশের ব্যাখ্যা এটি বিলোপ করতে হলে রাজ্য বিধানসভার সম্মতি প্রয়োজন। বর্তমান বিজেপি সরকার সংবিধান বিশেষজ্ঞদের এই সব মতামতের তোয়াক্কা না করে, জম্মু-কাশ্মীরের জনসাধারণকে অন্ধকারে রেখে, সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বকে কারাগারে নিক্ষেপ করে, ৭লক্ষ ৪০ হাজার সৈনিকের বন্দুকের ডগায় সেখানকার মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে রেখে জবরদস্তি এই আইন পাশ করানোর চেষ্টা করেছে। এটা গণতন্ত্র?

বিচ্ছিন্নতা বাড়বে ভারতের
আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, কাশ্মীর প্রশ্নে পাকিস্তান বরাবর আন্তর্জাতিক মহল থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল প্রধানত ২টি কারণে- (ক) ভারতবর্ষ জম্মু-কাশ্মীরের মানুষকে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার দিয়েছিল (খ) পাকিস্তান সন্ত্রাসবাদীদের জম্মু-কাশ্মীরে ব্যবহার করলেও, ভারতবর্ষ কখনও পাক অধিকৃত কাশ্মীরে কোনও জঙ্গি-সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে সাধারণভাবে মদত দেয়নি। ভারতবর্ষ বরাবরই শান্তিপূর্ণ-দ্বিপাক্ষিক আলোচনার ভিত্তিতে সমস্যা সমাধানের পক্ষপাতী। এখন বিজেপির পদক্ষেপে আদালতের সিলমোহর লাগার পরে জম্মু-কাশ্মীরের মানুষের প্রতি বিশ্বাসঘাতক হিসাবে ভারতবর্ষকে চিহ্নিত করার সুযোগ তৈরি হবে। 
৩৭০নং ধারা বিলোপ করায় ভারতবর্ষের বাকি অংশের কোন মানুষের লাভ হবে? ভারতবর্ষের বেকার যুবক কাজ পাবে? শ্রমিকের মজুরি বাড়বে? জিনিসপত্রের দাম কমবে? দেশে গরিবি কমবে? আসলে সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ মোদী সরকার ধর্মের নামে মানুষকে বিভক্ত করে রাখতে চাইছে, আর এই প্রশ্নে জম্মু-কাশ্মীর, তাঁর হাতের তুরুপের তাস। তাই ভারতবর্ষ বা পাকিস্থানের শাসক শ্রেণি আভ্যন্তরীণ বিপদে পড়লেই, দৃষ্টি ঘোরানোর জন্য জম্মু-কাশ্মীর সমস্যা পরিকল্পিতভাবে সামনে আনে।

সংশয় ৫– যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো কী থাকবে?
আর সবচাইতে বড় যে সংশয়টি তৈরি হয়েছে এই রায়কে ঘিরে, তা হলো, দেশের সংবিধানে লেখা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর আর কিছু কি অবশিষ্ট রইল?  
প্রথমে ৩৫৬ ধারা জারি করে জম্মু-কাশ্মীরের বিধানসভা ভাঙা হলো। তারপর রাজ্যটাকেই ভেঙে ২ টুকরো করে দেওয়া হলো। আর এই কাজটাকেই বৈধতা দিল সর্বোচ্চ আদালত। তাহলে আগামীকাল কেন্দ্রীয় সরকার চাইলে যে কোনও রাজ্যই ভেঙে টুকরো টুকরো করে দিতে পারে নিজেদের ইচ্ছা অনু্যায়ী, সেই রাজ্যের মানুষের মতামতকে তোয়াক্কা না করেই। পশ্চিমবঙ্গকেও যে কোনও সময়ে ভেঙে কয়েক টুকরো করে দিতে পারে।

কয়েকটা খুচরো সংশয় 
১) ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ সালের মধ্যে সেখানে নির্বাচন করার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। কেন ১০ মাস সময় দেওয়া হলো? আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ? তাহলে ২০২৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে কি সেখানকার মানুষ অংশ নেবে না? সেই নির্বাচন করতে যদি অসুবিধা না থাকে, তাহলে বিধানসভার নির্বাচন কেন লোকসভা নির্বাচনের আগে বা একই সাথে করার নির্দেশ দেওয়া হ’লো না? বিজেপি যদি সরকার গঠন করতে পারে পরের নির্বাচনে, তাহলে যাতে নিজেদের মতো করে ঘুঁটি সাজাতে পারে, সেই জন্যই কি ১০ মাস অতিরিক্ত সময় দেওয়া হলো? 
২) মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা খতিয়ে দেখার জন্য একটা কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। কে করবে এই কমিশন? মোদী-শাহ পরিচালিত সরকার? যারা সবচাইতে বেশি মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে তাদের তৈরি কমিশন বিচার করবে! ডাকাতকে থানা পরিচালনা করার দায়িত্ব দেওয়া হলো কোন আক্কেলে? 
কোন প্যান্ডোরা বাক্স খুলল সর্বোচ্চ আদালত?
 

Comments :0

Login to leave a comment