GARDEN REACH ILLEGAL CONSTRUCTION

পদ খালি, চাপ কাটমানির, দুর্বল বিল্ডিং বিভাগও, বেআইনি নির্মাণের রমরমা

কলকাতা রাজ্য

kmc illegal construction garden reach bengali news

কলকাতা কর্পোরেশনের বিল্ডিং বিভাগকে ঢাল-তরোয়াল ছাড়া নিধিরাম সর্দারে পরিণত করেছে তৃণমূল বোর্ড। থানার মদতে তৃণমূল কাউন্সিলররা রেটকার্ড বানিয়ে বেআইনি নির্মাণ থেকে কাটমানি আদায় করেন। এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে, যাতে কর্পোরেশনের ইঞ্জিনিয়াররা ‘সাইটে’ ঢুকতে না পারেন। গার্ডেনরিচ কান্ডের পর সেই বিল্ডিং বিভাগের আধিকারিক এবং ইঞ্জিনিয়ারদের ঘাড়ে যাবতীয় দোষ চাপানোর চেষ্টা করেছেন মেয়র ফিরহাদ হাকিম। 

সোমবার গভীর রাতে কলকাতার গার্ডেনরিচ অঞ্চলের ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের একটি নির্মীয়মাণ বেআইনি বহুতল ভেঙে পড়ে। এখনও অবধি ঘটনায় মৃতের সংখ্যা ৯। ঘটনায় অভিযোগ ওঠে, তৃণমূলের মদতেই চলছিল ডোবা ভরাট করে অবৈধ নির্মাণটি। 

সেই ঘটনার প্রেক্ষিতে মঙ্গলবার কর্পোরেশনের প্রত্যেক বরোতে কাউন্সিলর এবং বরো চেয়ারম্যানরা বিল্ডিং ডিপার্টমেন্টের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এরপর মেয়র সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে বলেন, ‘‘প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে ওয়ার্ডের দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিকরা ওয়ার্ডে টহল দিতে বেরোবেন। বেআইনি নির্মাণ হচ্ছে কিনা, তা খতিয়ে দেখবেন তাঁরা।’’

কর্পোরেশনের ইঞ্জিনিয়াররা বলছেন, ‘‘মেয়রের ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি ভিত্তিহীন। এটা রুটিন প্রোটোকল। নতুন কিছু নয়। সমস্যা অন্য জায়গায়।’’

ইঞ্জিনিয়াররা বারবার বিল্ডিং ডিপার্টমেন্টকে দাবি জানিয়েছে, তাঁদের একেকজনের পক্ষে একটির বেশি ওয়ার্ড দেখা সম্ভব নয়। কলকাতা কর্পোরেশনের সংযুক্ত এলাকার ওয়ার্ড গুলির আয়তন বিশাল। সেখানে একজন ইঞ্জিনিয়ারের ঘাড়ে যাবতীয় দায়িত্ব চাপানো অমানবিক। 

লিখিত ভাবে ব্যক্তিগত স্তরে জানানোর পাশাপাশি কেএমসি ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড অ্যালাইড সার্ভিসেস ইউনিয়নও জানিয়েছে। 

তারপরেও তাঁদের কথা শোনা হয়নি। ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের দায়িত্বে থাকা সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারকে পার্শ্ববর্তী আরও কয়েকটি ওয়ার্ড দেখতে হয়। লোকবলের অভাবে স্বাভাবিক নিয়মে ঘাটতি থাকে নজরদারিতে। 

বিল্ডিং বিভাগ মেয়রের নিজের হাতে রয়েছে। তিনি সবটাই জানেন। তারপরেও কোনও ব্যবস্থা নেননি। এখন সমালোচনার মুখে পড়ে ইঞ্জিনিয়ারদের শো’কজ করেছেন, যাঁদের গোটা ঘটনায় কোনও হাত নেই। 

প্রসঙ্গত, ঘটনার পরে ১৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ার এবং বরো’র অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারকে শো’কজ করা হয়েছে। 

ইউনিয়নের বক্তব্য, ‘‘সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়াররা অবৈধ নির্মাণ দেখলে নোটিশ দেন। তারপরেও নির্মাণ হলে এফআইআর দায়ের হয়। সেই এফআইআরের ভিত্তিতে মিউনিসিপ্যাল আদালতে শুনানি হয়। এফআইআর’র প্রেক্ষিতে সাব অ্যাসিস্ট্যান্ট ইঞ্জিনিয়ারকে অবৈধ নির্মাণের নকশা জমা করতে হবে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে। সেই নকশার উপর ধার্য ফি’র ৫০ শতাংশ প্রমোটারকে আদালতে জমা করতে হবে। বিল্ডিং রেগুলারাইজ করার ছাড়পত্র মিললে জমা পড়বে বাকি টাকা।’’

ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মানস সিনহার কথায়, ‘‘কোর্টের চক্করে বাধা পড়ছেন কর্পোরেশনের ইঞ্জিনিয়াররা। সে কোর্ট করবে, সাইট ভিজিট করবে না নোটিশ দেবে?’’

ইঞ্জিনিয়ারদের অভিযোগ, কর্পোরেশনের পরিকাঠামোকে এমন ভাবে ভাঙা হয়েছে, যাতে ইঞ্জিনিয়াররা নির্মাণক্ষেত্র বা সাইটে ঢুকতে না পারেন। 

তাঁদের অভিযোগ, প্রতিদিন কোর্টে গিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে, এফআইআর করলে। ড্র্যাফ্টসম্যান নেই। বেআইনি নির্মাণের আয়তন কতটা, সেটা ফিতে দিয়ে মাপতে হয়। বহু ক্ষেত্রে ফিতে ধরার লোক নেই। ইঞ্জিনিয়ারকে ড্রয়িং, মাপঝোক সব একা করতে হচ্ছে। 

প্রসঙ্গত, কলকাতা কর্পোরেশনে ড্র্যাফ্টসম্যানের ৮৪টি পোস্ট খালি রয়েছে। 

এখানেই শেষ নয়। বিল্ডিং বিভাগে চুক্তিভিত্তিক ডিজি নিয়োগ করা হয়েছে। তারফলে তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করা সহজ তৃণমূলের পক্ষে। ডিজি পোস্টে ৭টি পোস্ট খালি। বিল্ডিং ডিপার্টমেন্টের বর্তমান ডিজি একজন ডেপুটি চিফ ইঞ্জিনিয়ার। তাঁকে দিয়ে কাজ চালানো হচ্ছে। 

বামফ্রন্ট বোর্ডের সময়কালে বিল্ডিং বিভাগে ২জন ডিজি ছিলেন।  

যাতে ব্যবস্থা নেওয়া না যায়, প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে সেই ব্যবস্থা করে রাখা হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ার নেই, সার্জেন্ট নেই। ঢালাও বেআইনি কাজ চলছে। 

ওয়াকিবহাল মহলের বক্তব্য, ‘‘বর্তমানে অবৈধ নির্মাণ আটকানোর গোটা দায়িত্ব কলকাতা পুলিশের সংশ্লিষ্ট থানার কাঁধে। ২০২১’র কর্পোরেশন নির্বাচনে কলকাতা পুলিশ নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল। সেই ভোটে তৃণমূল পেয়েছিল ৭২.১৩ শতাংশ ভোট। এই দুইয়ের যোগসূত্র বের করা কঠিন নয়।’’

এই অংশের বক্তব্য, অবৈধ নির্মাণ রোখার যাবতীয় দায়িত্ব কর্পোরেশনের তরফে থানাকে দেওয়া হয়েছে। ওয়ার্ডের অফিসাররা শো’কজ হলে থানার আইসি শো’কজ হননি কেন?

আধিকারিকদের অনেকেই বলছেন, বামফ্রন্ট পরিচালিত বোর্ডের সময়কালে অবৈধ নির্মাণস্থলে সূর্যদয় থেকে সূর্যাস্ত অবধি কর্পোরেশন থেকে সার্জেন্ট এবং অ্যাসিস্ট্যান্ট সিকিউরিটি অফিসার মোতায়েন থাকতেন। তাঁরা রুখতেন বেআইনি নির্মাণ। রাতের বেলা পুলিশ মোতায়েন হত। এখন গোটাটাই থানার দায়িত্ব। তৃণমূল কর্পোরেশন গার্ড পোস্টিং থেকে শুরু করে ডেমোলিশন স্কোয়াড, সবটা তুলে দিয়েছে। 

ভুক্তভুগীরা জানাচ্ছেন, কাটমানির রেট ঠিক হয় থানা থেকে। কাউন্সিলরের অফিসে আগে ডাক পড়ে। কথা না শুনলে থানা ডেকে পাঠায়। বৈধ নকশা থাকলে একরকম রেট। নকশা বৈধ না হলে স্কোয়ার ফিট পিছু রেট দ্বিগুণ হয়ে যায়। গলি থেকে রাজপথ, রেটের তারতম্য শহর জুড়ে।

এই গোটা বিষয়টি পেশাদারিত্বের সঙ্গে থানা মোকাবিলা করে। কাউন্সিলরের নাম জড়ায় না। ১০০০ টাকা থেকে শুরু হয় রেট। ‘স্কাই ইজ দ্যা লিমিট’। 

গার্ড পোস্টিং থেকে কর্পোরেশনের কোষাগারে টাকা জমা পড়ত। রাজস্ব খাতে সেই আয়ও বন্ধ। 

বেআইনি নির্মাণের অভিযোগ আদালত অবধি গড়ালে কোর্ট কেস তুলে নেওয়ার রফাসূত্র দেয় থানা। হয় বিপুল টাকার লেনদেন। রেটচার্ট বানিয়ে। কিন্তু কোনওক্ষেত্রে এই স্তরে রফা না হলে বিল্ডিং ভাঙা হয়। তারপর কোণঠাসা প্রমোটারের সঙ্গে ফের রফা হয় থানার মাধ্যমে। 

বিল্ডিং ডিপার্টমেন্টের একাধিক আধিকারিকের অভিযোগ,  ভেঙে দেওয়া সাইটে ফের শুরু হয়েছে নির্মাণ।

তাঁরা বলছেন, ‘‘মেয়র বলেছেন ৮৩২টা বিল্ডিং ভাঙা হয়েছে। সেই তালিকায় খোঁজ নিলেই দেখা যাবে, বহু ক্ষেত্রে ফের নির্মাণ শুরু হয়েছে। ৪ বার করে এফআইআরের পরেও নির্মাণ হয়েছে বহু ক্ষেত্রে। সবটাই হয়েছে থানা নজরদারি করেনা বলে। কর্পোরেশনের নোটিশের পরেও সাইটে বালি ঢোকে, রড ঢোকে, পাথর ঢোকে। কিভাবে? নজরদারির দায়িত্ব তো থানার।’’ 

গার্ডেনরিচের ভেঙে পড়া বাড়িটি পুকুর বুজিয়ে তৈরি করা। অভিযোগ, পুকুর থেকে বাস্তুজমিতে রূপান্তরিত হয়েছে বিএলআরও অফিসের মাধ্যমে। কলকাতা কর্পোরেশনের সংযুক্ত অঞ্চলে এই দায়িত্ব ভূমি ও রাজস্ব দপ্তরের। 

Comments :0

Login to leave a comment