পুঁজিবাদ তার বিকাশের থমকে যাওয়া এক স্তরে এসে নব্য উদারনীতিবাদকে গ্রহণ করেছিল পুঁজিবাদের ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী ও প্রসারিত করার লক্ষ্যে। গত তিন দশক ধরে অর্থনীতির ক্ষেত্রে নব্য উদারবাদ প্রসারিত ও বিকশিত হয়েছে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা তথা ডব্লিউটিও-কে সামনে রেখে। বাণিজ্য ক্ষেত্রে একটা আন্তর্জাতিক বিধি ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল ডব্লিউটিও। এই ব্যবস্থায় খোলা বাজারে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে বাজার দখলের সুযোগ তৈরি হয় সবদেশের সামনে। বিকাশমান দেশগুলি এবং উন্নয়নশীল দেশের একাংশ এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে উৎপাদন শিল্পে অনেকটা উন্নতি করে। উন্নত দেশের পুঁজি তথা বহুজাতিক কর্পোরেট পুঁজি তৃতীয় বিশ্বে পণ্য উৎপাদনে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। সস্তার শ্রমের তৃতীয় বিশ্বে পণ্য উৎপাদনের খরচ কম হওয়ায় উন্নত বিশ্ব থেকে পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থা সরে যায় তৃতীয় বিশ্বে। তার ফলে উন্নত বিশ্বের কর্পোরেট পুঁজি মুনাফা অনেকটা বাড়িয়ে ফেলার সুযোগ পেলেও উন্নত দেশে কর্ম সংস্থানের সুযোগ কমে যায়।
এই ব্যবস্থা মানুষের আয় বাড়ার সুযোগ কমিয়ে দেয়। বিনিময়ে কর্পোরেট মালিক ও বিত্তবানদের আয় ও সম্পদ হুহু করে বাড়িয়ে দেয়। সর্বত্র আয় ও সম্পদ বৈষম্য তীব্র হয় যা সামাজিক অসন্তোষ বাড়াতে থাকে। আমেরিকা সহ উন্নত দেশগুলিতে বৃদ্ধির হার মন্থর হয়, ঋণের বোঝা বাড়ে। কিন্তু বিকাশশীল দেশে বৃদ্ধির হার তুনলামূলকভাবে বাড়ে। এই ব্যবস্থা এভাবে নতুন এক সঙ্কটের জন্ম দেয় উন্নত বিশ্বে। পশ্চিমী উন্নত দুনিয়ার সাম্রাজ্যবাদ শিরোমণি আমেরিকার একচেটিয়া বিশ্ব প্রভাব কিছুটা হলেও হ্রাস পায়। মার্কিন কর্পোরেট মালিক ও পুঁজিবাদী শাসকের এতে উদ্বেগ বাড়ে। তাদেরই কট্টর প্রতিনিধি ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ক্ষীয়মান মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের হৃত গৌরব ফেরানোর লক্ষ্যে অতি দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকে হাতিয়ার করে ট্রাম্প আগ্রাসী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। ক্ষমতায় এসে ‘আমেরিকা প্রথম’ নীতি ঘোষণা করেন। আমেরিকাকে আবার মহান করার স্লোগান দিয়ে তিনি ডব্লিওটিও ব্যবস্থায় গড়ে ওঠা বিশ্ব বাণিজ্য কাঠামোটাকেই চৌপাট করার অভিযানে নামেন। বাণিজ্য যুদ্ধ বা শুল্ক যুদ্ধ বলে সেটা আলোচিত। আমেরিকায় ফের উৎপাদন শিল্প গড়ে তোলার জন্য সব দেশের পণ্যের উপর অতি উচ্চ শুল্ক চাপান। এতকাল কম শুল্কে আমেরিকায় পণ্য রপ্তানি করত অনেক দেশ। তাতে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি আকশ ছোঁয়া অবস্থায় পৌঁছায়। ট্রাম্প চান সব দেশের বাজারে মার্কিন পণ্যে অবাধ বাজার যাতে আমদানি, রপ্তানি সমান সমান হয়ে ঘাটতি কমে যায়।
অর্থাৎ শুল্ক সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করে অন্য দেশকে মার্কিন চাহিদা মতো দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি করতে বাধ্য করতে চাইছেন ট্রাম্প। কার্যত সব দেশই আমেরিকার কাছে নতজানু হয়ে বাণিজ্য চুক্তির আলোচনা চালাচ্ছে। একমাত্র চীন পালটা মার্কিন পণ্যে উচ্চ হারে শুল্ক চাপিয়েছে। যথারীতি নীরবে ট্রাম্পের সব আক্রমণ হজম করছে মোদীর ভারত। প্রতিবাদের কোনও ভাষা নেই। রুখে দাঁড়ানোর তাগিদ নেই। বরং ট্রাম্পকে তোয়াজ করে কিছু ছাড় পাবার মরিয়া চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন মোদীরা। ভারতের কৃষিপণ্য, দুগ্ধজাত পণ্য, ফল ইত্যাদির বাজার দখল চায় আমেরিকা। মুখে কৃষকের প্রতি দরদ দেখিয়ে ঠেকানোর কথা বলা হচ্ছে ঠিকই তবে তলে তলে আত্মসমর্পণের পথেই হাঁটছে ভারত।
Editorial
ট্রাম্পের শুল্ক হুমকি চলছেই

×
Comments :0