শ্যামল কুমার মিত্র
বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে পূর্ত দপ্তর সারা বছর ধরে মহাকরণের রক্ষণাবেক্ষণের কাজটা যত্ন নিয়েই করতো, প্রতিবছর পূজার ছুটির সময় যুদ্ধকালীন তৎপরতায় মহাকরণ সংস্কার, মেরামতি ও নতুন করে রং করা হতো। ১৭৮০ সাল থেকে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র মহাকরণকে আরও শতাধিক বছর ব্যবহার করাই যেত। উন্নত গঠনশৈলীর কারণে এই দীর্ঘ সময়কালে একাধিক ভূমিকম্প সহ প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে মহাকরণের সামান্যতম ক্ষতিও হয়নি। ২০১১ সালে বিধানসভা নির্বাচনের আগে প্রচলিত রীতি অনুসারে গোটা মহাকরণের আমূল সংস্কার করায় পূর্বতন সরকার। ড. প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ, ডাঃ বিধান চন্দ্র রায়, প্রফুল্ল চন্দ্র সেন, অজয় কুমার মুখার্জি, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, জ্যোতি বসু এবং বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা এই মহাকরণ থেকেই সরকার চালিয়েছেন। কিন্তু নজিরবিহীনভাবে বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী, মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, আমলাদের ঘর নতুন করে সাজাতে ঐতিহ্য সমৃদ্ধ মহাকরণে শুরু হলো এক দক্ষযজ্ঞ, ঘরগুলিকে অতি বিলাসবহুল করে সাজাতে সরকারি অর্থের 'হরির লুট 'শুরু হলো। তথ্যের অধিকার আইনে একাধিকবার প্রশ্ন পাঠিয়েও এই বিপুল অপব্যয়ের অর্থাঙ্ক জানতে পারিনি। মহাকরণে অতি মহার্ঘ পুরাতন সব আসবাবপত্র রাতের অন্ধকারে পাচার হয়ে গেল, বদলে নতুন হাল ফ্যাশানের দামি দামি আসবাব পত্র এল। আমার দীর্ঘ ৩৮ বছরের চাকরি জীবনে সরকারি অর্থের এমন অপচয় অতীতে কখনো দেখিনি।
প্রয়াত মুখ্যমন্ত্রী বিধান চন্দ্র রায় সরকারি কর্মীদের মহাকরণ কমিউনিটি হল (যা পরে ক্যান্টিন হল নামে পরিচিত হয়) উপহার দিয়ে বলেছিলেন, ‘‘ফাইলের স্তূপ থেকে সাময়িক মুক্তির জন্য সরকারি কর্মীদের 'ফুসফুস' হিসাবে থাকবে এই হল।’’ দীর্ঘ কয়েক দশক ধরে রক্তদান শিবির, নাট্য উৎসব, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বিতর্ক প্রতিযোগিতা, বিভিন্ন কর্মী সংগঠনের সভা/সম্মেলন ইত্যাদিতে সারা বছর প্রানচঞ্চল হয়ে থাকত এই ক্যান্টিন হল। বাম আমলে তীব্র সরকার বিরোধী কর্মী সংগঠনও সরকারের সমালোচনামূলক বক্তৃতা দেওয়ার কাজে মহাকরণ ক্যান্টিন হলকে ব্যবহার করেছে, তীব্র সমালোচনা করেছে মুখ্যমন্ত্রীর, অর্থ মন্ত্রীর। এটাই ছিল গণতন্ত্র। এই ঐতিহাসিক ক্যান্টিন হল ভাঙার মধ্য দিয়েই শুরু হলো মমতা ব্যানার্জির সরকারের তথাকথিত নতুন সংস্কারপর্ব।
১৭৭২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ওয়ারেন হেস্টিংসকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির গভর্নর করে পাঠায়। 'বেঙ্গল রেগুলেশন অ্যাক্ট-১৯৭৩' অনুসারে বেঙ্গল, মাদ্রাজ ও বম্বে—এই ৩টি প্রেসিডেন্সির মধ্যে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির গভর্নরকে করা হলো গভর্নর জেনারেল, বাকি ২টির সর্বোচ্চ কর্তা গভর্নর। অর্থাৎ এই অ্যাক্ট অনুসারে ৩ ভাগে বিভক্ত ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সর্বময় কর্তা হলেন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির গভর্নর জেনারেল। সে আমলে লন্ডন থেকে কলকাতায় আসতে হতো জলপথে, সময় লাগতো ৬ মাস। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য চালানোর প্রয়োজনে ইংল্যান্ড থেকে রাইটার (করণিক) আসত। এখন যেখানে জিপিও, কলকাতা কালেকটরেট, ইস্টার্ন রেলের অফিস, সে আমলে সেখানে ছিল ফোর্ট উইলিয়াম যেখানে রাইটাররা থাকতেন। ইংরেজরা সিদ্ধান্ত নিলেন, ওখান থেকে ফোর্ট উইলিয়ামকে সরাতে হবে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাজ শুরু হলো। কিন্তু ফোর্ট সরে গেলে রাইটাররা থাকবেন কোথায়? এখন যেখানে মহাকরণ, সে আমলে সেখানে ছিল সেন্ট অ্যানের ভগ্নপ্রায় গির্জা। ওই গির্জা ভেঙে যে জায়গা পাওয়া গেল, ওয়ারেন হেস্টিংস তা দিয়ে দিলেন তার চারজন উপদেষ্টার অন্যতম বারওয়েলকে। রিচার্ড বারওয়েল টমাস লায়নকে দায়িত্ব দিলেন ওই জায়গায় কলকাতায় প্রথম তিনতলা বাড়ি তৈরি করার। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই টমাস লায়নের নামেই বর্তমান স্টক এক্সচেঞ্জ ও মহাকরণের মাঝের রাস্তার নাম লায়নস রেঞ্জ। লায়ন নির্মিত বারওয়েলের এই তিনতলা বাড়িই রাইটারদের থাকার জায়গা তথা কর্মস্থল রাইটার্স বিল্ডিং। ১৭৮০ সালে বারওয়েলের রাইটার্স বিল্ডিং তৈরির কাজ সম্পন্ন করেন। রিচার্ড বারওয়েল এই ভবন ৩১, ৭০০ টাকা বার্ষিক ভাড়ায় দিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে। সে আমলে ভাড়া দিয়ে এই ভবনে বসবাস করতেন একাধিক ব্যক্তি, ছিল কিছু গুদাম ও দোকান। পরবর্তী ১০০ বছরে মহাকরণে বারওয়েলের ভবনকে অক্ষত রেখে গড়ে ওঠে আরও ৬টি ব্লক। বাবওয়েলের অংশে গ্রিসের আইওনিয়ান স্থাপত্য অনুসরণ করে সমদূরত্বে ৩২ ফুট উচ্চতার ৪টি স্তম্ভ বসিয়ে পোর্টিকো করা হয়। পোর্টিকোর মাথায় বসানো হয় রোমান জ্ঞানের দেবী মিনার্ভার মূর্তি, ওই পোর্টিকোর চার ধারে জিউস, হারমেস, আথেনা এবং ডিমিটার— এই চার গ্রিক দেবদেবীর মূর্তি, যে মূর্তিগুলি ঘিরে রয়েছে একজন ইউরোপীয় ও একজন ভারতীয় স্থাপত্য শিল্পীর মূর্তি।
১৮৭১ সালে সিদ্ধান্ত হলো, কলকাতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা সমস্ত সরকারি অফিস রাইটার্সে আনা হবে। তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ভাইসরয় লর্ড মেয়োর নির্দেশে তৎকালীন গভর্নর জেনারেল জর্জ ক্যাম্পবেল এ কাজের দায়িত্বে আসেন। রাইটার্স থেকে সমস্ত দোকান, গুদাম সহ ব্যক্তি ভাড়াটিয়া উচ্ছেদ হন। ১৮৭৭ সালে কলকাতার সমস্ত সরকারি দপ্তরকে রাইটার্সে আনার কাজ শেষ হলো। তখন ভাইসরয় লর্ড রিপন, বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্নর অ্যাসলে ইডেন (যার নামে ইডেন গার্ডেনস্)। ১৮৮০ থেকে ১৯১১ পর্যন্ত ৩১ বছরে ৭ জন ভাইসরয়ের (রিপন, ডাফরিন, ল্যান্সডাউন, এলগিন-২, কার্জন, মিন্টো-২, হার্ডিঞ্জ-২) আমলে গোটা ব্রিটিশ ভারত এই রাইটার্স বিল্ডিং থেকে শাসিত হয়েছে। ১৯১১ সালে কলকাতা থেকে দিল্লিতে স্থানান্তরিত হলো ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। ৭টি ব্লকের রাইটার্স থেকে ১৯১১ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত শাসিত হয়েছে অবিভক্ত বাংলা। ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ পর্যন্ত স্বাধীন ভারতের অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবাংলার প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র মহাকরণে আরও ৬টি ব্লক নির্মিত হয় (তথ্যসূত্র: 'ওয়ারেন হেস্টিংস থেকে মমতা ব্যানার্জি: ২৩৫ বছর ধরে মহাকরণের ভাঙাগড়া- তাপস গঙ্গোপাধ্যায়)। ২০১৩ সালের ৬ আগস্ট রাইটার্স বিল্ডিং সংস্কারের কথা ঘোষণা করে মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন, ‘‘৬ মাসের মধ্যে সংস্কার সম্পূর্ণ হয়ে গেলে আমি আবার মহাকরণে বসেই সরকার চালাবো।’’ ৬ মাস দূর অস্ত, ২০২৪ সালও চলে গেল, কবে তথাকথিত সংস্কার শেষ হবে, কেউ জানে না।
২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর থেকে হাওড়ার এইচআরবিসি বিল্ডিং-এ স্থানান্তরিত হয় প্রশাসনিক কেন্দ্র। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে এই বিল্ডিং তৈরি করা হয়েছিল হাওড়া ও কলকাতায় পোশাক উৎপাদনকারী ছোট ছোট শিল্পগুলিকে এক ছাদের তলায় এনে সরকারি সহযোগিতায় একটি অত্যাধুনিক উন্নত মানের গারর্মেন্টস হাব তৈরির লক্ষ্যে। এই অসংখ্য ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য আজও কোনও বিকল্প পরিকাঠামো গড়ে তোলেনি সরকার।
তবে সব থেকে ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত ১৯৪৭ থেকে ১৯৭০ সময়কালে নির্মিত ৬টি ব্লক পুরোপুরি ভেঙে ফেলা। এই ধ্বংস উৎসবে মহাকরণের মূল কাঠামো নিশ্চিতভাবেই যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঐতিহাসিকদের সঙ্গে কোনও আলোচনা না করে, পরামর্শ না নিয়ে ইতিহাস ধ্বংসের এত বড় সিদ্ধান্ত! অপরিকল্পিতভাবে, অবৈজ্ঞানিক কায়দায় স্রেফ কিছু দৈনিক মজুরির ঠিকা শ্রমিক দিয়ে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় দপ্তর স্থানান্তরের নামে যা হয়েছে, তাতে ১৭৮০ থেকে ২০১১ পর্যন্ত দীর্ঘ ২৩১ বছরের ইতিহাসের অসংখ্য নথি, দলিল, দস্তাবেজ, দুষ্প্রাপ্য প্রকাশনা ধ্বংস হয়েছে, যা বাঙালি ও ভারতীয়দের এক অপূরণীয় ক্ষতি। মহাকরণ সহ নিউ- সেক্রেটারিয়েট বিল্ডিং, জেশপ বিল্ডিং, হেমন্ত ভবন, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, কাউন্সিল হাউস স্ট্রিট, পে অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস বিল্ডিং সহ বিধাননগরের প্রায় সমস্ত দপ্তর ছিল এমনভাবে যাতে জেলা থেকে হাওড়া এবং শিয়ালদহ স্টেশনের মাধ্যমে কর্মচারী, অধিকারিক, সাধারণ মানুষ সহজেই সরকারি দপ্তরে যেতে পারতেন। এখন একই দপ্তরের বিভিন্ন শাখা ভিন্ন-ভিন্ন জায়গায়। ফলে মানুষ চূড়ান্ত হয়রানির শিকার। নবান্নে অন্য দপ্তরের সরকারি কর্মী ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মীদেরই কার্যত প্রবেশ নিষেধ, সাধারণ মানুষ তো দূর অস্ত। সাংবাদিকদের গতিবিধি এতটাই নিয়ন্ত্রিত যে বহু কেলেঙ্কারির খবর আর সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে না। মহাকরণ সহ সরকারি দপ্তরে কর্মীসংগঠনগুলির আন্দোলনের সুযোগ ছিল বাম আমলে, এখন সব নিষিদ্ধ। মহাকরণ সংস্কারের জন্য বরাদ্দ ছিল ২৩৬ কোটি টাকা, কি সংস্কার হয়েছে কেউ জানে না, পূর্ত দপ্তরের হিসাব, আরও ১৫০ কোটি টাকা দরকার। যেভাবে গোটা মহাকরণে ২৩১ বছর আগে নির্মিত ঐতিহ্যবাহী ব্লকগুলিকে গত ১১ বছর ধরে ভাঙাচোরা অবস্থায় রোদ, জল, ঝড়ের মধ্যে রেখে দেওয়া হয়েছে তাতে মহাকরণের পূর্ণ ধ্বংস শুধু সময়ের অপেক্ষা। ফ্যাসিবাদীদের মতোই মুখ্যমন্ত্রীও মনে করেন ২০১১ সালে তার শাসনকাল থেকেই ইতিহাসের শুরু, আগের ইতিহাস মুছে দেওয়াই যায়।
Comments :0