Post Editorial

ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা

উত্তর সম্পাদকীয়​

অমর্ত্যালোক ব্যানার্জি
অ্যাডলফ হিটলারের বই ‘মেইন ক্যাম্ফ’ (Mein Kampf) প্রকাশিত হয় ১৯২৫ সালে, যেখানে আর্য শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা সোশ্যাল ডারউইনিজম (বিকৃত ব্যাখ্যা) এবং ইহুদি, কমিউনিস্ট, সমকামী এবং প্রতিবন্ধীদের প্রতি বিদ্বেষের বীজ বপন করা হয়েছিল। তারও আগে ১৯২৩ সালে ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনি 'ফ্যাসিও' শব্দটিকে পরিবর্তন করে স্বৈরশাসনের নতুন সংজ্ঞা তৈরি করেছিলেন ফ্যাসিজম শব্দের মাধ্যমে। ১৯৩৩ সালে জোসেফ গোয়েবলসের নেতৃত্বে তৈরি হলো প্রোপাগান্ডাস মিনিস্ট্রি। ইতিমধ্যে জার্মান সরকারের পক্ষ থেকে বিলি করা হতে থাকলো 'পিপলস রিসিভার' নামক সস্তা রেডিও, যাতে জার্মানবাসী হিটলারের ঘৃণ্য ভাষণ প্রতিদিন নিখরচায় শুনতে পারে। পত্রপত্রিকা, সিনেমা, বিদ্যালয় পাঠক্রমে নাৎসি ঘৃণার প্রচার - এ সবই ছিল হিটলারি শাসনের স্ট্র্যাটেজি। অবশেষে ১৯৩৫ সালে ‘নূর্যেণমবার্গ আইন’ জারি করে কেড়ে নেওয়া হলো ইহুদিদের নাগরিক অধিকার, বন্ধ করে দেওয়া হলো ইহুদি জার্মান বিবাহ। ‘ফাইনাল সলিউশন’-এর নির্দেশ মোতাবেক ইহুদি, কমিউনিস্ট, সমকামী, প্রতিবন্ধীদের নিকেশ করার রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হলোকাস্ট এবং আউৎসউইচ, টারাবালিংশ, সেবিবোর-এ তৈরি হলো কনসেনট্রেশন ক্যাম্প। একই কায়দায় ইতালিতে বেনিতো মুসোলিনি, স্পেনে ফ্র্যাঙ্কোর নেতৃত্বে একনায়কতন্ত্র কায়েম হলো। একনায়কতন্ত্র কায়েম, বিরোধী দল এবং মিডিয়ার দমন ও অনুগত মিডিয়া হাউস তৈরি করা, সংখ্যালঘু ও অন্যমতের প্রতি ঘৃণা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সর্বনাশ করা, ঘৃণার উসকানি, জনগণের সামনে কল্পিত শত্রু তৈরি করা, দেশপ্রেমের নামে নাগরিক অধিকার হরণ, এক দল, এক নেতা, এক জাতি, এক ধর্ম – সংক্ষেপে এই হচ্ছে ফ্যাসিবাদ।
৯০ বছর আগে ঘটে যাওয়া এই ইতিহাস আমাদের সকলেরই কমবেশি জানা। হিটলারের ফ্যাসিবাদী সন্ত্রাসে দেশছাড়া হয়েছেন সিগমুন্ড ফ্রয়েড থেকে নাৎসি বাহিনীর সদস্য অস্তিত্ববাদী দার্শনিক হাইডেগারের প্রেমিকা ও দার্শনিক হাল্লা অরেন্ট সহ অনেক শীর্ষস্থানীয় চিন্তাবিদরা। ওয়াল্টার বেঞ্জামিন নাৎসি সংসর্গে থাকবেন না, এই ভেবে নিজের রিভালবার থেকে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেছিলেন। কিন্তু আসল প্রশ্ন হলো, হিটলারের এই দানবীয় ব্যবস্থাকে জার্মানির বহু সংখ্যক বিজ্ঞানী চিকিৎসক, দার্শনিক, অধ্যাপক সোল্লাসে সমর্থন জানিয়েছেন কেন! প্রায় ৬০ লক্ষ ইহুদি নিধনের এই মারণযজ্ঞকে তারা প্রশ্নাতীত ভেবেছিলেন কেন! এমনকি দার্শনিক হাইডেগার থেকে বিজ্ঞানী হাইজেনবার্গ সকলেই! এখানেই নিহিত আছে আন্তনীয় গ্রামসির ‘দক্ষিণের প্রশ্ন’ সম্বলিত তত্ত্বগুচ্ছের উত্তর। গ্রামসি, আল্ফসার, লুকাচ, ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের তাত্ত্বিকদের আলোচনা আজকের এই উত্তর-সত্য যুগে আমরা কি মন খুলে করতে পারছি, প্রশ্ন সেটাই। মার্কসবাদের ভিন্ন প্রেক্ষিতের সাম্প্রতিক চর্চার থেকে কেন আমরা মুখ ঘুরিয়ে নেব! বর্তমান সময়ের প্রক্ষিতে মার্কসবাদকে আরও সঠিকভাবে উপলব্ধির জন্য চিন্তা প্রক্রিয়াকে সমসাময়িকতার আলোয় নিজেরদের দেশের বিশাল ঐতিহ্যকে দেখার বিকল্প নেই।
গত দশ বছর ধরে দেশজুড়ে যে সমস্ত ক্রিয়াকলাপ চালানো হয়েছে তাতে আবারও ৯০ বছর আগেকার স্মৃতি ফিরে আসার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এনআরসি-সিএএ, দেশ জুড়ে ঘৃণার ভাষণ ইত্যাদির মাধ্যমে গরিব মানুষের ঐক্যকে ধ্বংস করার সরকারি প্রচেষ্টা জারি থেকেছে। ভুলিয়ে দেওয়া হচ্ছে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, স্বামী বিবেকানন্দের প্রকৃত আদর্শকে। গোদি মিডিয়ার নির্লজ্জ ঘৃণ্য প্রচারে অনেক সাধারণ মানুষও প্রভাবিত হচ্ছেন। জাতীয় ঐক্য আজকে দাঁড়িয়ে আছে খাদের কিনারায়। এই ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আমরা লড়াইয়ের রসদ পেতে পারি প্রাচ্যের দর্শন, ধর্ম, মহাকাব্যের থেকেই। ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে বহুত্ববাদ। বৌদ্ধ নৈয়ায়িকরা ‘তৃ-অবয়ব বিশিষ্ট ন্যায়’ মেনে চলেন। অন্যদিকে মহর্ষি গৌতমের শিষ্য নৈয়ায়িকরা ‘পঞ্চঅবয়বী ন্যায়’ মেনে চলেন। বদরায়নের ব্রহ্মসূত্রের শঙ্কর ভাষ্যে ব্রহ্ম'র স্বরূপ হচ্ছে নির্গুন, নিরাকার অবাংমানসগোচর এবং ক্লিবলিঙ্গ। এর বিপরীতে মাধবাচার্য, বল্লভাচার্য বিশিষ্ট দ্বৈতবাদী রামানুজ, অচিন্ত্য ভেদাভেদবাদী শ্রীচৈতন্য প্রমুখ ভেদ-অভেদ এবং দ্বৈততার প্রসঙ্গ আলোচনা করেছেন। ভারতীয় বিভিন্ন দর্শন প্রস্থান ভেদে প্রমাণ হিসাবে মোট ছয়টি  বিষয়কে ভিত্তি করেছে – প্রত্যক্ষ, অনুমান, উপমান, শাব্দপ্রমাণ, অনুপলব্ধি ও অর্থাপত্তি প্রমাণ। তাঁদের নিজ নিজ পদ্ধতি অনুযায়ী কেউ একটি, কেউ দুটি, কেউ চারটি, কেউ পাঁচটি মেনে চলেন। অর্থাৎ এখানেও একটি মাত্র বিচার নেই। মূল কথা হচ্ছে, ভারতীয় সমাজ-দর্শনে ‘একটি মাত্র চূড়ান্ত কথা’ বলে কিছু নেই। এমনকি বৈষ্ণবদের মধ্যেও সহজিয়া, পাটুলি স্রোত ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার আছে। শুধু তাই নয় বাংলার গৌণ ধর্মে সাহেবধ্বনী, কর্তাভজা, বলাহারী এবং বাউল ফকিরদের মধ্যেও বিভিন্ন জীবন ও সমাজ বোধ নিয়ে নানাবিধ তাত্ত্বিক অবস্থান আছে। অথচ তথাকথিত হিন্দুত্ববাদীরা একটি মাত্র ভাষ্য তৈরি করেই দেশের মানুষকে বিভক্ত করতে চাইছেন। 
এত কথা বলার উদ্দেশ্য এই যে, বিদ্যাসাগর মহাশয় যেভাবে পরাশর সংহিতা থেকে শ্লোক উদ্ধৃত করে বিধবা বিবাহের পক্ষে যুক্তি সাজিয়েছিলেন, আমাদেরও তদ্রুপ ভারতীয় দর্শনের বহুত্ববাদকে অবলম্বন করেই এই নব্য ফাসিবাদীদের তৈরি করা ধর্মীয় আবেগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে।
আমরা কি তা যথেষ্ট মনোযোগ সহকারে, ত্যাগ তিতিক্ষা নিয়ে তা করতে পারছি! এককথায় বলা যায়, সেভাবে ভাবছিও না, পারছি না। রাজ্যের সরকারি কোষাগার থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে জগন্নাথ মন্দির তৈরি হয়েছে দীঘাতে। নিন্দুকদের অভিযোগ, চোরদের সরকার নাকি জগন্নাথ দেবের নিমকাঠও চুরি করেছে! কিন্তু রামমোহন, প্যারীচাঁদ, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ, রামসুন্দর ত্রিবেদীদের উত্তরসূরিরা কেউই এই নিয়ে উচ্চ আদালত মামলা করতে উদ্যত হননি। গৌরী লঙ্কেশ, কালবুর্গী, গোবিন্দ পানসারের মতো সাহসী মানুষ এই মুহুর্তে বাংলায় নেই নাকি! প্রশ্ন হচ্ছে, পশ্চিমী সভ্যতা বা বর্তমানের সঙ্ঘ পরিবারের ধর্মজীবীরা কি জানে ভারতীয়ত্ব মানে আসলে কি? পশ্চিমের রিলিজিয়ান আর প্রাচ্যের ধর্ম এক জিনিস নয়। 
এতক্ষণ যে কথাগুলো বলা হলো সেই কথারই নির্যাস ছিল হিমাংশী নারুলার কথায়। সদ্য বিবাহিতা হিমাংশী নারুলা হানিমুনে গিয়ে হারিয়েছেন তার স্বামী নেভি অফিসার বিনয় নারুলাকে। পহেলগামে সন্ত্রাসের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন মাত্র চারদিনের নববিবাহিত দম্পতি বিনয় নারুলা। অথচ হিমাংশী নারুলা পরিষ্কার জানিয়েছেন, কাশ্মীরিদের প্রতি এবং কোনোরকম জাতি ধর্ম বিদ্বেষের প্রতি তার সমর্থন নেই। হিন্দুত্ববাদীরা, ঘৃণার রাজনীতির কারবারিরা ঘৃণ্য ভাষায় আক্রমণ করেছে হিমাংশী নারুলাকে। কিন্তু হিমাংশী যে প্রকৃত অর্থে ভারতীয়, তার প্রমাণ দিয়েছেন। আর যারা আক্রমণ করেছে এই সদ্য বিধবাকে, তারাও কি আদানি আম্বানি রামদেব আসারাম রামরহিমদের তৈরি ব্যবস্থার বাইরে? ক্ষত অতি গভীর। মার্জনা প্রয়োজন; এখন উৎপল দত্ত কিংবা জয়দেব বসুর মত বুদ্ধিজীবীদের বড্ড অভাব। যারা গিগস্ লেবার এবং মূলত অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক, যারা শ্রমশক্তির ৯০ শতাংশ, তারাই শ্রমকোড-২০২০-তে সবথেকে বেশি বিপন্ন এবং হিন্দুত্ববাদীদের সফট টার্গেট। কবি সুধীন দত্ত লিখেছিলেন— 'নগর পুড়িলে দেবালয় রক্ষা পায় না।' আমি আপনি সবাই আজ রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের অপেক্ষায়। আমরা সবাই আজ হিমাংশী নারুলা।
মনে রাখতে হবে যে, শ্রীমদভগবত গীতা শুধুই ভক্তিযোগ বা জ্ঞানযোগ এর কথা বলে না, কর্মযোগের কথাও বলে। মহাভারতকে গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখতে পাওয়া যায়, মহাভারতের সাথে প্রতিশোধের রাজনীতির এক গভীর আলোচনা বা বিতর্ক মজুত আছে। সমস্ত মহাভারত জুড়েই ছড়িয়ে আছে এই সব দ্বিবিভাজন (Binary); দ্রোণের সঙ্গে দ্রুপদের, শিখণ্ডীর সঙ্গে ভীষ্ম’র, কর্ণের সঙ্গে অর্জুনের, ধৃতরাষ্ট্রের সঙ্গে পান্ডবদের, ভীমের সঙ্গে দুর্যোধনের, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র মল্ল এবং বৃজ্জিদের সঙ্গে যদু এবং কুরুদের লড়াই, দ্রৌপদীর সঙ্গে সমস্ত কৌরবদের লড়াই (বিকর্ণ ব্যতিরেকে)।
সৌপ্তিক পর্বে অশ্বথামার সঙ্গে পাণ্ডব পুত্রদের এবং ধৃষ্টদুন্ম নিহত হওয়ার ঘটনা, ভীমের সঙ্গে দুঃশাসনের লড়াই এবং ফুসফুস থেকে রক্ত চুষে খাওয়া, সারা মহাভারত জুড়েই ঘটে চলেছে একের পর এক হিংস্র প্রতিহিংসা বা প্রতিশোধের গল্প..!! কৃষ্ণের সঙ্গে শিশুপাল ও জরাসন্ধের লড়াই এক ধরনের প্রতিশোধস্পৃহার গল্প। লোহার ভীমকে টুকরো টুকরো করে দেন ধৃতরাষ্ট্র এক গভীর প্রতিশোধস্পৃহায়। এই সমস্তটাই হচ্ছে প্রতিশোধের গল্প। এর মাঝে আশ্চর্য রকম স্থির এবং ধীর শান্ত অবস্থায় থাকেন যুধিষ্ঠির। মহাভারত আমাদের শেখায় যুদ্ধ এবং প্রতিশোধস্পৃহা কখনও জাতির মঙ্গল করতে পারে না। বরং আনুসংস্যতাই হয়ে উঠে শেষমেষ পরম ধর্ম। আনুসংস্য শব্দটির ব্যাপকতা অহিংসার থেকেও বেশি। আনুসংস্য শব্দটি এসেছে অনুক্রোশ শব্দটি থেকে, যার অর্থ-অপরের দুঃখে আপনি ররুদ্যমান, এক কথায় সমানুভুতি বা এম্প্যাথি। অন্যের মাংস দিয়ে নিজের মাংস বৃদ্ধি করার চেষ্টা হচ্ছে হিংসা। তবু বনপর্বে কৌশিক মুণিকে ধর্মব্যাধ অনুক্রোশ-আনৃশংস্যতা-র পাঠ দেন।
এ কারণেই ব্যাসদেব তার শিষ্য সুক বৈষম্প্যায়নকে পাঠান, জন্মেঞ্জয়-এর সর্প দহন যজ্ঞে, মহাভারতের কাহিনি বর্ণনা করার উদ্দেশ্যে। কারণ তক্ষকের সঙ্গে পরীক্ষিতের যে লড়াই হয়েছিল, তাতে পরীক্ষিত মারা যায়। আসলে বহুপূর্বে খাণ্ডব দহনের সময়ে অর্জুনের দ্বারা তক্ষকের স্ত্রী এবং পুত্র খুন হয়েছিল। পরীক্ষিতকে হত্যা করে তক্ষক তাই তার প্রতিশোধ নিয়েছিল মাত্র। পরীক্ষিতের পুত্র জন্মেঞ্জয়ের সর্প দহন যজ্ঞেও ছিল, নাগ-কুলের প্রতি তাঁর প্রতিশোধস্পৃহা। কিন্তু প্রতিশোধের রাজনীতি শেষমেষ কোনও ইতিবাচক ফলাফল দিতে পারে না। মহাভারত তার উদাহরণ। মহাভারতের সমস্ত চরিত্রই শেষমেশ অচরিতার্থ এবং অসম্পূর্ণ। তাই সেই কাহিনি শোনানোর জন্যই, ব্যাসদেব তার শিষ্য সুক বৈসম্পায়নকে মহাভারতের কাহিনি শোনানোর জন্য অর্থাৎ জন্মেঞ্জয়কে তার পূর্বপুরুষদের ইতিবৃত্তান্ত বর্ণনা করার আদেশ দিয়েছিলেন, যাতে তিনি সত্য উপলব্ধি করে সর্পদহন যজ্ঞ বন্ধ করতে বাধ্য হন। আসলে ব্যাসদেবের মূল উদ্দেশ্য ছিল মহাভারতের এই ঘটনা যা জন্মেঞ্জয়ের পূর্বপুরুষদের বৃত্তান্ত, তা শ্রবণ করে জন্মেঞ্জয় যেন প্রতিশোধস্পৃহার অর্থহীনতা অনুধাবন করতে পারেন।
মহাভারতের সেই প্রতিশোধস্পৃহার রাজনীতি যে ক্ষতিকর, সেই কথা নতুন করে বলতে হবে আজও আমাদের দেশে। আমাদের দেশ, দেশের সংস্কৃতি, দেশের অতীত জ্ঞানভাণ্ডারকে কাজে লাগিয়েই, মৌলবাদী ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই করতে হবে। মানুষকে বোঝাতে হবে বাবা রামদেব, রামরহিম থেকে আসারাম বাপু এরা হিন্দু জীবনধারার উপযুক্ত লোক নয়। আচার্য কৃষ্ণচন্দ্র ভট্টাচার্য থেকে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, বিমলকৃষ্ণ মতিলাল থেকে হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায় কিংবা সদ্য প্রয়াত রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্য; আমরা এদের কাছ থেকেই ধর্ম জিনিসটা শিখতে চাই। 
পতঞ্জলির যোগসূত্রের ব্যাস-ভাষ্যে, বিন্ধ্যবাসী নামক সাংখ্য দার্শনিকের রচনায় ৮১ রকমের হিংসার উল্লেখ আছে। জগতে বেঁচে থাকতে গেলে, খাদ্য গ্রহণ করতে গেলে যেটুকু হিংসা দরকার, তার বাইরে আমরা যেতে পারি না। আত্মঅহঙ্কার, বাচিক হিংসা, স্বার্থপরের মতো একাই ভোগ করা, অনাহারক্লিষ্ট লোকেদের দেখিয়ে দেখিয়ে অসভ্যের মতো ছেলের বিয়েতে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করা, দানের কীর্তি প্রচার করা— মহাভারতীয় অর্থে এ সবই হিংসা।
বৌদ্ধ দর্শনের আচার্য ধর্মকীর্তি, মহা নৈয়াইক জয়ন্ত ভট্ট, মিথিলার গঙ্গেশ থেকে আরম্ভ করে এই নবদ্বীপের রঘুনাথ শিরোমণি পর্যন্ত, আমাদের এক প্রাচীন এবং অত্যন্ত গর্ব করার মতো ইতিহাস আছে। শান্তি এবং আনৃশংসতার এক জীবনজোড়া নৈতিক বোধও আমাদের সভ্যতার মধ্যে আছে। সঙ্ঘ পরিবারের ঘৃণার রাজনীতির বিরুদ্ধে আমাদের অস্ত্র হবে প্রাচ্য দেশীয় ইতিবাচক বক্তব্যসমূহ।
সনাতন সভ্যতার নামে, যে প্রচার চালানো হচ্ছে, তাতে আবার কি চতুবর্ণ প্রথা ফিরে আসবে? এসব কিছুই হবে না। তথাকথিত সনাতনীদের বাড়বাড়ন্ত হলে অন্ত্যজ শূদ্ররা কি দুর্গাপূজায় ভোগ রান্না করার অধিকার পাবেন? এখনও গ্রামে-ঘরে অনুষ্ঠান বাড়িতে বামুন ঠাকুর এনে রান্না করানোর রেওয়াজ আছে। আগে সেই সবগুলো বন্ধ হোক। সনাতনীরা সেসব দাবি কিছুই করবেন না। বরং কিছুদিন আগে এই বাংলায় দলিত হওয়ার কারণে মন্দিরে ওঠার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল। পরে মানুষের চাপে মহকুমা শাসক মন্দিরে প্রবেশের ব্যবস্থা করতে বাধ্য হন। ঘটনাটি ঘটেছে ২০২৫ সালে, যখন মমতা ব্যানার্জির বদান্যতায় রাজ্যজুড়ে বাড়বাড়ন্ত ঘটেছে আরএসএস’র।
আবার ভোট আসবে, আরও একবার, বর্বর মোদী আর দিদি জনগণের কাছে সুযোগ চাইবে। কখনো ধর্মের নামে, কখনো পাকিস্তানের সুড়সুড়ি দিয়ে, কখনো দীঘায় আড়াইশো কোটি টাকার মন্দির তৈরি করে, অথবা ইফতারের সময় মাথায় হিজাব ঢেকে অংশগ্রহণ করে। এই সস্তা রাজনীতিই ক্রমাগত চলবে।
কিন্তু আমরা এক মহান সভ্যতার অংশ, যা আমাদের শেখায় সহিষ্ণুতা, শান্তি, পারস্পরিক সহযোগিতা এবং অবশ্যই একটি বিশ্লেষণী মনন। আমরা এই মহান ভারতীয় সভ্যতার অংশ হতে হবে।

Comments :0

Login to leave a comment