PROBANDHAY — ARIJIT MITRA — BANGLAR GOURAB — MUKTADHARA — 24 JULY 2025, 3rd YEAR

প্রবন্ধ — অরিজিৎ মিত্র — “ অন্তরাত্মার অলিন্দে বাংলার ঐতিহ্য: শিল্প, সংস্কৃতি ও চিরন্তন গৌরবগাথা” — মুক্তধারা — ২৪ জুলাই ২০২৫, বর্ষ ৩

সাহিত্যের পাতা

PROBANDHAY  ARIJIT MITRA  BANGLAR GOURAB  MUKTADHARA  24 JULY 2025 3rd YEAR

প্রবন্ধমুক্তধারা, বর্ষ ৩

“ অন্তরাত্মার অলিন্দে বাংলার ঐতিহ্য: শিল্প, সংস্কৃতি ও চিরন্তন গৌরবগাথা ”
 

অরিজিৎ মিত্র

নতুন বন্ধু

 


 

ভূমিকা:

“বাংলা” শব্দটি উচ্চারণমাত্রই মনে ভেসে ওঠে সবুজের সমারোহে মোড়া এক অপরূপ ভূখণ্ডের ছবি, যেখানে খাল-বিল, নদ-নদী আর মাঠঘেরা গ্রামের প্রান্তর জুড়ে লুকিয়ে আছে চিরন্তন ঐতিহ্যের দীপ্ত ছায়া। এই বাংলা কেবল একটি ভৌগোলিক পরিসর নয়, বরং এক জীবন্ত ঐতিহ্যের নাম, যার শিকড় প্রোথিত ইতিহাসের গভীরে, যা বয়ে চলে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে। বাংলার সংস্কৃতি ঠিক তেমনই—যেন আত্মার গভীরতম অলিন্দে গাঁথা এক রত্নভাণ্ডার, যা যুগের সঙ্গে বদলায়, তবু হারায় না নিজস্বতা।


 

বাংলার আদি ঐতিহ্য: সভ্যতার সূচনা থেকে শিল্পের অভিযাত্রা

বাংলার ঐতিহ্যের শেকড় সুদূর অতীতে। সভ্যতার ঊষালগ্নে এই ভূখণ্ডে গড়ে উঠেছিল মহাস্থানগড়, ময়নামতী, পাহাড়পুরের মতো নগর-সভ্যতা, যেখানে সভ্যতার স্বর্ণালী ইতিহাস এখনও ধ্বনি তোলে। মাটির নিচে চাপা পড়া প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা যায়—হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর পর বাংলার সভ্যতাও ছিল তীক্ষ্ণ ও সমৃদ্ধ। শিল্পকর্ম, স্থাপত্য, পোড়ামাটির ফলক—সবই তার সাক্ষ্য।

 

লোকশিল্প ও গ্রামবাংলার শিল্পতীর্থ: মাটির টানে বেঁধে রাখা শেকড়

বাংলার লোকশিল্প ঠিক যেন এই মাটিরই ভাষা। নকশিকাঁথা, জামদানি, ঢাকাই মসলিন, পাটশিল্প, শীতলপাটি, বাঁশ ও বেতশিল্প—সবই যুগ যুগ ধরে বাংলার ঘরে ঘরে বোনা হয়েছে ভালবাসার অমোঘ স্পর্শে। গৃহস্থালি সামগ্রী থেকে শুরু করে অলংকার, পোশাক, উপহার সামগ্রী—সবখানেই জড়িয়ে আছে বাংলার শিল্প-ঐতিহ্য।
বিশ্বের দরবারে এখন ‘বাংলাদেশি জামদানি’ ও ‘নকশিকাঁথা’ গর্বের সঙ্গে পরিচিত, যা বাঙালি নারী ও পুরুষের সৃষ্টিশীলতার উজ্জ্বল প্রমাণ।


 

উৎসব ও লোকাচার: বাঙালির প্রাণের আবাহন

বাংলার ঐতিহ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ হলো উৎসব। প্রতিটি ঋতুর নিজস্ব উৎসব রয়েছে। বসন্ত আসে পলাশ, শিমুলের লাল রঙ মেখে, সঙ্গে বসন্তোৎসব আর দোল পূর্ণিমা। গ্রীষ্ম নিয়ে আসে আম-কাঁঠালের রসনা-উৎসব। বর্ষায় জেগে ওঠে ভাটিয়ালি আর কাদামাটির গন্ধ। শরতের শুভ্র কাশফুলের সাথে আসে দুর্গাপূজা, যার মহাসমারোহে মুখরিত হয় বাংলার আকাশ-বাতাস। পৌষসংক্রান্তি, নবান্ন, চড়ক পূজা, রাখিবন্ধন—সবই বাংলার হৃদয়-ভূমির অবিচ্ছেদ্য অনুষঙ্গ।


 

সঙ্গীত ও নৃত্য: বাংলার আত্মার উন্মেষ

বাংলার সংগীতজগত এতই বিস্তৃত যে, তা একাধারে বিশ্বজোড়া পরিচিতি অর্জন করেছে। বাউল, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, জারি-সারি, মারফতি, গাজীর গান, কবিগান—সবগুলোই বাংলার বিভিন্ন জনপদের কথা বলে।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রবীন্দ্রসঙ্গীত, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের গান, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেনের গান—সবই বাংলার আত্মার স্পন্দন।

বাংলার নৃত্যশিল্পও সমৃদ্ধ—ছৌ নাচ, গম্ভীরা, ঝুমুর, নাট্যনৃত্য সবই বাংলার ঐতিহ্যের ঐশ্বর্য।

 

সাহিত্য: বাঙালির মননের অনিবার্য জোয়ার

বাংলার সাহিত্য যেন এক অনন্ত সমুদ্র, যার জলে ডুব দিলে বারবার নতুন মুক্তা উঠে আসে। চর্যাপদ থেকে শুরু করে মঙ্গলকাব্য, বৈষ্ণব পদাবলী, মুসলিম বাঙালি কবিদের সুফি-সাহিত্য, মাইকেল মধুসূদনের মহাকাব্য, রবীন্দ্রনাথের বৈচিত্র্যময় সাহিত্যকীর্তি, নজরুলের অগ্নিঝরা কবিতা—সবই বাংলার মননশীলতা আর মুক্ত চিন্তার সাক্ষ্য।

তারপর এসেছে জীবনানন্দ দাশের নিসর্গচেতনা, জসীমউদ্দীনের পল্লীজীবনের শব্দছবি, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নিখুঁত সমাজচিত্র, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রকৃতি-নিবিড় উপন্যাস। এই ধারা আজও সমান উজ্জ্বল।


 

শিল্প, স্থাপত্য ও চিত্রকলায় বাংলার গৌরবগাথা

বাংলার স্থাপত্যও তার ঐতিহ্যের অন্যতম বাহক। ষাট গম্বুজ মসজিদ, আটচালা মন্দির, দরগা, জমিদার বাড়ি, রাজপ্রাসাদ—সবই বাংলার ঐতিহাসিক পরিচয় বহন করে। টেরাকোটার কাজ, মৃৎশিল্প, আঁকা দেয়াল—সবখানেই বাংলার মানুষের নিপুণতা আর শিল্পবোধের ছাপ।

পটুয়া শিল্প বা স্ক্রল পেইন্টিংও বাংলার এক অমূল্য লোকশিল্প, যা আজ আন্তর্জাতিক মহলেও সমাদৃত।

ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার রক্ষায় আমাদের অঙ্গীকার

বাংলার ঐতিহ্য কখনও শুধুমাত্র অতীতের গর্ব নয়, বরং ভবিষ্যতের পথ চলার শক্তি। এই ঐতিহ্য আমাদের রক্তের মধ্যে, আমাদের কণ্ঠস্বর, পোশাক, খাদ্যাভ্যাস, চেতনা ও মননে মিশে আছে। বাঙালি হিসেবে আমাদের দায়িত্ব—এই ঐতিহ্যের ধারা বহমান রাখা, তাকে ভালোবেসে আগলে রাখা, যেন পরবর্তী প্রজন্মও এই ঐশ্বর্যের জোয়ার অনুভব করতে পারে।

আজকের বিশ্বায়নের যুগেও যদি আমরা আমাদের শেকড়ের প্রতি বিশ্বস্ত থাকি, তবে বাংলার ঐতিহ্যও ঠিক তেমনই দীপ্তি ছড়াবে, যেমনটি ছড়িয়েছিল শত-সহস্র বছর আগে।

 

"মাটির কাছাকাছি যে থাকে, তার প্রাণের সুরও মাটির মতোই স্নিগ্ধ হয়"
—লোকবচন

 

শেষ কথা:

বাংলার ঐতিহ্য, সংস্কৃতি আর শিল্প-সাহিত্য—এসবই আমাদের জাতির আত্মপরিচয়ের মূর্ত প্রতীক। এগুলো হারিয়ে গেলে আমরা নিজেদের হারিয়ে ফেলব। তাই, আসুন, এই ঐতিহ্যকে ভালোবাসি, আগলে রাখি, আর বিশ্বমঞ্চে বাংলার গৌরব আরও উজ্জ্বল করি।

 

নবম শ্রেণী, কল্যাণ নগর বিদ্যাপীঠ, খড়দহ, উত্তর ২৪ পরগনা

Comments :0

Login to leave a comment