Bangladesh Air Force Jet Crash

সন্তান হারিয়ে কাঁদছে বাবা মা, শোকে স্তব্ধ বাংলাদেশ

আন্তর্জাতিক

মীর আফরোজ জামান: ঢাকা

সন্তান হারিয়ে অনেক মা-বাবা এখন পাগলপ্রায়। যাদের এখনও সন্ধান মেলেনি, তারা খুঁজে ফিরছেন প্রাণপ্রিয় সন্তানকে। বিমান দুর্ঘটনাস্থলে ছুটে যাচ্ছেন কেউ কেউ। বুধবারও সেখানে ছিল পোড়া গন্ধ। ঘটনাস্থল, বিভিন্ন হাসপাতাল ও মর্গে পরিবারের সদস্যদের কান্নাকাটি ও আর্তনাদ শোনা যায়। তাদের কথাবার্তায় বাতাস ভারী হয়ে ওঠে।
শুধু বাবা-মা কিংবা পরিবারের লোকজন নন, মর্মান্তিক এই ঘটনা কাঁদিয়ে যাচ্ছে সবাইকে। শোকে স্তব্ধ সারা দেশ। মর্মান্তিক এ ঘটনায় মঙ্গলবার পালন করা হয়েছে রাষ্ট্রীয় শোক। ঘটনার খবর সামাজি মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া গুজবে কান না দেওয়ার আহ্বান জানান বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান।
সোমবার দুপুরে রাজধানী ঢাকার স্কুল অ্যান্ড কলেজ ক্যাম্পাসের যুদ্ধবিমান ভেঙে পড়ে। ঘটনায় মঙ্গলবার পর্যন্ত ৩১ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে দেড় শতাধিক। ঘটনায় সাধারণ মানুষও হতভম্ব-স্তব্ধ। পথেঘাটে যেখানেই জটলা, সেখানেই চলছে মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি নিয়ে আলোচনা। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে শুরু করে সবখানে শোকের ছায়া। বিশেষ করে দুর্ঘটনার পর আটকে পড়া অন্তত ২০ জন শিশু পড়ুয়াকে উদ্ধার করে নিজের প্রাণ উৎসর্গকারী শিক্ষিকা মাহেরীন চৌধুরীর আত্মত্যাগ তুলে ধরা হচ্ছে সব মাধ্যমে। 
বুধবার জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ও বিভিন্ন হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় অসহ্য যন্ত্রণা সহ্য করছেন ঘটনায় দগ্ধ ও আহতরা। তাদের অধিকাংশের সারা শরীরে ব্যান্ডেজ। কারও কারও শরীরের বিভিন্ন অংশের ঝলসে যাওয়া চামড়া-মাংস খসে পড়েছে। মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন কেউ কেউ। নিরুপায় দর্শকের মতো দেখতে হচ্ছে মা-বাবাকে।
বুধবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দিয়াবাড়ীর মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজ প্রাঙ্গণে অবস্থানকালে নানা চিত্র দেখা যায়। দ্বিতীয় দিনেও দিনভর ঘটনাস্থলে ছিল লাখো মানুষের ভিড়।
বুধবারও সেখানে ছিল পোড়া গন্ধ। সেখানকার বাতাসে বিমানটির তেলসহ নানা উৎকট গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছিল। এ যেন নিঃশব্দ এক মৃত্যুপুরী। ক্লাস রুমগুলো খালি। ভেতরে পড়ে ছিল পুড়ে চ্যাপ্টা হওয়া টেবিল-চেয়ারের অংশবিশেষ। দোতলা ভবনের নিচতলায় যেখানে বিমানটি আছড়ে পড়েছিল সেখানে পোড়া ছিন্নভিন্ন বিভিন্ন সামগ্রী, জুতা, স্যান্ডেল পড়ে থাকতে দেখা যায়। হায়দার আলী ভবনের করিডরে পুরোটাই ধ্বংসস্তূপ, যা আগুনে পুড়ে গেছে। স্কুল ভবনের সামনে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল শিশুদের বই, খাতা, ব্যাগ, জুতা, পানির বোতল, এমনকি কয়েকজনের আঁকা ছবিও। 
সরেজমিনে বিধ্বস্ত ভবনটি ঘুরে দেখা যায়, তৃতীয় শ্রেণির প্রাথমিক বিজ্ঞান, বাংলা ব্যাকরণসহ একাধিক বই অর্ধেক পোড়া ছিন্নভিন্ন হয়ে পড়ে ছিল ধ্বংসস্তূপের পাশে। সিঁড়ির পাশে পড়ে ছিল ছোটদের ব্যাগ।
ভবনের সামনের ও ভেতরের অংশ ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হয়েছে। পেছনের অংশও মোটামুটি ক্ষতি হয়েছে। আছড়ে পড়া বিমানটি পেছনের দেয়ালেও আঘাত হেনে ভেঙে ফেলেছে। পেছনের দেওয়ালে ফাটল ধরেছে। জানালার গ্লাসগুলো ভেঙে পড়েছে। ভেতরে পড়ুয়ারা বিক্ষোভ করায় বাইরের অংশ দিয়েই সেই ভয়াবহতার চিত্র বোঝার চেষ্টা করছিলেন উৎসুক মানুষ।
 বুধবার সকালে বিমানবাহিনীর সদস্যরা বিধ্বস্ত বিমানের বাকি অংশ কুড়িয়ে নিয়ে যান তদন্তের স্বার্থে।  
’ফিউনারেল প্যারেড’ আয়োজনে বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল হাসান মাহমুদ খান সাংবাদিকদের বলেন, ’মাইলস্টোন কলেজে প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অনেক গুজব ছড়িয়ে পড়েছে। ছড়িয়ে পড়া বিভিন্ন গুজবে কান না দিতে দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান তিনি। বিমানবাহিনী প্রধান বলেন, এই ঘটনায় একটি উচ্চপর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাঁরা তদন্ত করে বের করবে কী ঘটেছিল। তার ভিত্তিতে কোনো ভুলত্রুটি থাকলে সে অনুযায়ী আমরা ব্যবস্থা নেব’।
হাসান মাহমুদ খান বলেন, পাইলট সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন বিমানটিকে একটি খালি জায়গায় নামানোর জন্য এবং তিনি তাঁর জীবন উৎসর্গ করেছেন। দয়া করে দেশের এই বিপদের সময় সামাজিক মাধ্যমের গুজবে কান দেবেন না। 
এক প্রশ্নের জবাবে বিমানবাহিনী প্রধান বলেন, ’বিমান রক্ষণাবেক্ষণে বিমানবাহিনী কোনো আপস করে না। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আমরা দৈনন্দিন ব্যবস্থা নিই। তবে আমরা অবশ্যই এই দুর্ঘটনা থেকে শিক্ষা নেব। বিমান সাধারণত সহজে পুরোনো হয় না। প্রতিটি বিমানের একটি লাইফটাইম আছে। এক যুগ, দুই যুগ ব্যাপার না। বিষয় হলো রক্ষণাবেক্ষণ। আমাদের রক্ষণাবেক্ষণ সব সময় ভালো হয়। এগুলো আমরা ভালোভাবেই মেরামত করি’।
এদিকে, রাজধানীর উত্তরায় যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় বেঁচে যাওয়া শিশুদের পরিচয়, গোপনীয়তা ও মর্যাদা রক্ষা করে দায়িত্বশীল ভাবে সংবাদ প্রকাশের অনুরোধ জানিয়েছে ইউনিসেফ। এদিন এক বার্তায় সংস্থাটি আহ্বান জানিয়ে বলে শিশুদের উপর যেন বাড়তি কোনো চাপ মানসিক চাপ না পড়ে এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও সম্প্রদায়ের প্রতি আরো সহনশীল সহানুভূতিশীল আচরণ নিশ্চিত হয়। 
সর্বশেষ জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউটে ভর্তি ৪৪ জনের মধ্যে ৮ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক। তাদের এখন বিশেষ ব্যবস্থাপনায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।
বুধবার দুপুরে সাংবাদিকদের এ তথ্য জানিয়েছেন ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক নাসির উদ্দিন। অন্যদিকে সিঙ্গাপুরের এক সিনিয়র কনসালট্যান্টের সমন্বয়ে গঠিত মেডিকেল বোর্ড জানিয়েছে, বিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আহত আরও ১৩ জনের অবস্থা গুরুতর। 
ইঞ্জি. মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী,সেক্রেটারি জেনারেল, বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক বিবৃতিতে বলেছেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নির্দেশে বাংলাদেশের গোপালগঞ্জ জেলায় নিরাপত্তা বাহিনী কর্তৃক পরিচালিত দমন-পীড়ন এবং ব্যাপক দমন-পীড়ন ও গণহত্যার প্রায় অব্যবহিত পরেই এই ভয়াবহ ঘটনাটি ঘটেছে। এর পর, সরকার শোকাহত জনগণের ন্যায্য অভিযোগের প্রতি সাড়া দিতে ব্যর্থ হয়েছে এবং পরিবর্তে অভূতপূর্ব মাত্রার সহিংসতার সাথে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। নিহত ও আহতদের অনেকেই এখনও নিখোঁজ রয়েছেন এবং ঢাকা এবং সারা দেশে ব্যাপক জনরোষ চলছে। ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সক্রিয় প্রচেষ্টা চলছে,যার তীব্র নিন্দা জানাই। ডঃ মুহাম্মদ ইউনুসের সরকারের উদ্দেশ্যে আমরা বলতে চাই: এটি কোনও রাজনৈতিক বিষয় নয়; এটি একটি মানবিক ট্র্যাজেডি যা সত্য, সহানুভূতি এবং জবাবদিহিতার দাবি করে।
অন্যদিকে, ভারত বাংলাদেশ বন্ধুত্ব ও  কূটনৈতিক সম্পর্কের নিদর্শন স্বরূপ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নির্দেশে ভারতীয় মেডিকেল টিম ঢাকায় পৌঁছেছে। রয়েছেন দিল্লির রাম মনোহর লোহিয়া হাসপাতাল এবং সফদরজং হাসপাতালের চিকিৎসক এবং নার্সরা। এই দুটি হাসপাতাল ভারতের দুটি শীর্ষস্থানীয় হাসপাতাল যা পোড়া ও প্লাস্টিক সার্জারিতে বিশেষজ্ঞ।

Comments :0

Login to leave a comment