পার্থ বিশ্বাস
‘রাজনীতি ছাড়া কিছুই হয় না, প্রত্যেকেই রাজনীতি করে, যে করে না বলে, সে-ও করে। Apolitical বলে কোনও কথা নেই। You are always a partisan, for or against.’ । উক্তিটি এক বরেণ্য প্রতিবাদী বাঙালি চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের। বাংলার দেশভাগের যন্ত্রণা ছিল সেলুলয়েডের পর্দায় তাঁর প্রতিবাদী সৃষ্টির উপাদান। কাকতালীয়ভাবেই তাঁর জন্মশতবর্ষ উদ্যাপনের সাথে এবার জুড়ে গেছে বাংলা জুড়ে দ্রোহের উৎসব, প্রতিষ্ঠান বিরোধী প্রতিবাদের ঐতিহাসিক উদ্যাপন। সেই উদ্যাপনে, চেনা ছকের রাজনীতির দাবার চালে শাসক বিরোধী কাটাকুটি খেলার গল্প নয় বরং গত তিন মাস জুড়ে কেঁপে উঠেছে শাসকের আসন এক গণআন্দোলনের জোয়ারে। রাজনীতির চেনা ছকের মানুষ না হয়েও অভয়ার ন্যায় বিচারের দাবিতে প্রতিবাদে শামিল অসংখ্য মানুষ রাজপথে পা মিলিয়েছে, হাতে হাত ধরে প্রমাণ করেছে ঋত্বিকের সেই অকপট অনুভূতি। অরাজনৈতিক নয়, বরং দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে পক্ষ অবলম্বন করতেই হয়। ফলে রাজনৈতিক পতাকা ব্যতিরেকেই রাজনৈতিক দাবি আদায়ের আন্দোলনে নেমেছে রাজ্যের মানুষ।
কিন্তু বাঙালির বারো মাসের তেরো পার্বণের সাথে দ্রোহের উৎসব জুড়ে গেলেও রাজ্যের বিরোধী দল, যারা দিল্লির মসনদে বসার হ্যাটট্রিক করেছে তাঁদের ভূমিকা এবার আসছে আতশ কাচের তলায়। গত তিন মাস ধরে রাজ্য জুড়ে চলা এই গণআন্দোলনের সামনের সারিতে ছিলেন মহিলারাই। অভয়ার বিচারের পাশাপাশি মেয়েদের ক্ষমতায়নের দাবি হয়ে উঠেছে এই আন্দোলনের অন্যতম ইস্যু। এমন প্রেক্ষিতে ‘নেপোয় দই মারার’ কায়দায় আন্দোলনের শুরুতে একটা নবান্ন অভিযানের ফ্লপ শো আর বাংলা বন্ধের হাঁক পেড়ে শীত ঘুমে ঢুকে গিয়েছিল মনুবাদি বিরোধী দল- ‘ The party with a difference’ । ফলে ‘বেটি বাঁচাও বেটি পড়াও’ ধ্বনিতে টেলিভিশনের পর্দায় গলা ফাটালেও, আর জি করের যে তরুণী মেডিক্যাশল কলেজে পড়তে এসে খুন-ধর্ষণের শিকার হলো খোদ কলেজ ক্যাম্পাসেই সে সম্পর্কে একটা শব্দ খরচ করেনি দেশের প্রধানমন্ত্রী থেকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেউই। যেমনটা তাঁরা করেননি মণিপুরে কিংবা হাথরসের ধর্ষণ হত্যার ঘটনায়। ফলে সঙ্গত কারণেই তাঁদের নেতা নেত্রীরা আন্দোলন মঞ্চের কাছে ভিড়তেই ‘ গো ব্যাক’ ধ্বনি শুনতে পেয়েছেন। এমন অভিজ্ঞতার ঠেলা সামলাতে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা থেকে শুরু করে মেজো সেজো গেরুয়া নেতার দল জুনিয়র ডাক্তারদের আন্দোলনে ‘ বাম এবং অতিবামের’ ভূত দেখতে শুরু করেছিল।
পাশাপাশি একই ফর্মুলায় রাজ্যের শাসক দলও এমন গণআন্দোলনের ধাক্কা সামলাতে ঐ আন্দোলনকে বাম অতিবামের চক্রান্ত বলে চিহ্নিত করেছে। এই প্রেক্ষিতে রাজ্যে প্রতিষ্ঠান বিরোধী আন্দোলনের এই প্রবল জনজোয়ারে প্রধান বিরোধী দল হিসাবে বিজেপিকে জনমতের চাপে আন্দোলনের ময়দানের বাইরে থাকতে হয়েছে থার্ড আম্পায়ারের মতোই ।
ফলে মাঠের বাইরে তিন মাসের লম্বা শীত ঘুম কাটিয়ে এবার ম্যাচ রেফারির মতো ঐ আন্দোলনের যবনিকা টানার পথে বিজেপি। কাঠ ফাটা বৈশাখে তেষ্টায় পাখি যেমন ‘ চোখ চোখ গেল’ ডাক পাড়ে, ঠিক তেমনই ভোট যাদের পাখির চোখ তাঁরা এখন ডাক পাড়ছে ‘ভোট গেল ভোট গেল’ রব তুলে। আর সেই ভোট বাঁচাতেই দিল্লি থেকে ছুটে এসে দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এরাজ্যে বিজেপি’র এক কোটি সদস্যের লক্ষ্যমাত্রা বেঁধে দিয়েছেন চড়া সুরে। যদিও সাম্প্রতিক অতীতে রাজ্যে লোকসভার ৪২ আসনের মধ্যে ৩৫ আসনে জয়ের লক্ষ্যমাত্রা তিনি ভোটের আগে বেঁধে দিলেও, তার অর্ধেক লক্ষ্য পূরণ করতে পারেনি রাজ্যের গেরুয়া বাহিনী। সন্দেহ নেই রাজ্যের সাম্প্রতিক ভোটে সোয়া দু’কোটির বেশি ভোট বিজেপি পেলেও সেই ভোট বিজেপি’র পক্ষে ইতিবাচক ভোট ছিল না বরং সেই ভোটের সিংহভাগই হলো তৃণমূল বিরোধী প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার ভোট। অথচ রাজ্যে এমন চড়া মেজাজের প্রতিষ্ঠান বিরোধী মানুষের আন্দোলনে ময়দানের বাইরে থাকায় দল হিসাবে বিজেপি’র যে শিয়রে সমন, সেটা বুঝেছে তাঁদের কেন্দ্রীয় নেতারা। ফলে চলমান এই আন্দোলনকে ব্যর্থ প্রতিপন্ন করে ভোট রাজনীতির চেনা ছকে বিভাজন এবং মেরুকরণের পথকেই বেছে নিয়েছেন সদস্য সংগ্রহের পথ হিসাবে। ফলে ফোনে মিসড কল দিয়ে যে অভিনব সদস্য সংগ্রহের পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন তাঁরা তাতে সদস্যপদ প্রাপ্তির পর অনায়াসে পদ্মফুল থেকে ঘাসফুলে ‘ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট’ পাঠানোর পথও প্রসারিত হয়েছে রাজ্যজুড়ে। এই প্রেক্ষিতে তাঁদের দলীয় সদস্য সংগ্রহের লক্ষ্য তৃণমূল বিরোধী নেতিবাচক ভোটকে বিজেপি’র পক্ষে ইতিবাচক ভোটে পরিণত করা হলেও আসলে উপলক্ষ হয়ে উঠছে ঐ দুই ফুলের বিভাজন এবং মেরুকরণের পথ।
বলাই বাহুল্য যে, মতাদর্শের কথা মুখে বললেও যেনতেনপ্রকারেণ দেশজুড়ে ক্ষমতা দখলই হয়ে উঠেছে বিজেপি’র পাখির চোখ। ফলে কোনও রাখ ঢাক না করেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পাশের চেয়ারে বসে টাটকা টাটকা ‘দাদাসাহেব’পুরস্কার প্রাপ্ত অভিনেতা সোচ্চারে প্রকাশ্যে সাম্প্রদায়িক হিংসার হুমকি দিয়ে বলেন, ২০২৬ সালে রাজ্যে ক্ষমতায় আসার জন্য যা যা করণীয় তার প্রতিটি পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত তাঁরা। বলাই বাহুল্য এমন লাগাম ছাড়া উত্তেজক সাম্প্রদায়িক মন্তব্যে যে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সম্পূর্ণ সম্মতি ছিল সেটা অচিরেই স্পষ্ট হলো পড়শি রাজ্য ঝাড়খণ্ড বিধানসভার মন্ত্রী মশাইয়ের ভোটের প্রচারে। এই রাজ্যে নিম্নবর্গীয় হিন্দু উদ্বাস্তুদের সমর্থন পেতে যেভাবে মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের প্রসঙ্গ প্রচারে আনেন তাঁরা ঠিক তেমনই ঝাড়খণ্ডে আদিবাসীদের সমর্থন আদায়ে সেখানে বহিরাগত মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের প্রসঙ্গ টেনে এনেছেন। অথচ বাস্তবতা হলো কেন্দ্রের নীতির কারণেই আদিবাসীদের জমি-জঙ্গলের অধিকার হারিয়ে যাচ্ছে তাবড় তাবড় কর্পোরেট গোষ্ঠী খনি এবং শিল্পের দোহাই দিয়ে। ফলে কর্পোরেটদের জমি লুটের মাশুল গুনছে আদিবাসী জনজাতিরা সরকারি নীতির কারণে আর দোষী হিসাবে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে বহিরাগত ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের। অথচ দশ বছরের বেশি সময় ধরে দিল্লির মসনদে বসার পরও বেআইনি অনুপ্রবেশ কি করে হচ্ছে সেই প্রশ্নের সম্মুখীন হচ্ছেন না তাঁরা সংসদের ভেতরে কিংবা বাইরে!
একদিকে দেশের প্রধানমন্ত্রী প্রচার চালাচ্ছেন যে এবার দেশ জুড়ে অভিন্ন আইন বিধি চালু হবে আর ঝাড়খণ্ডে প্রচারে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্রচার করছেন রাজ্যে সরকারে এলে তাঁরা আদিবাসীদের জমি কেনাবেচা বন্ধে বিশেষ আইন পাস করাবেন। অর্থাৎ ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য প্রয়োজনে চোরকে চুরি করতে বলা এবং একই সাথে গেরস্থকে সজাগ থাকার দুমুখো নীতি নিয়েই চলছে তাঁরা। কিন্তু এমন বিষাক্ত সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতির প্রচার প্রকাশ্যে দেশের শাসক দলের নেতা মন্ত্রীরা চালিয়ে গেলেও দেশের নির্বাচন কমিশনের নীরবতা বিস্ময়কর। ফলে আবারও প্রমাণ হচ্ছে নির্বাচন কমিশনের মতো স্বশাসিত সংস্থাগুলিও নিয়ন্ত্রণের রাজনীতির শিকার হয়ে পড়েছে। ফলে নির্বাচনী আচরণবিধি ঘোষণা ব্যতিরেকে সেগুলি লাগু করার প্রাতিষ্ঠানিক কোনও ভূমিকাই নেই সেই কমিশনের।
কথায় আছে কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। সেই নিরিখে দেশের কেন্দ্রীয় স্বশাসিত সংস্থাগুলির কর্ম সম্পাদিত হচ্ছে এখন দেশের সরকারের ইচ্ছাতেই। সেই আঙ্গিকের বাইরে নয় দেশের কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা সিবিআই। এ রাজ্যেও আর জি করের ঘটনায় রাজ্য পুলিশের তদন্তে আস্থা না রাখতে পেরে আদালত সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য সেই তদন্তের গতি প্রকৃতি দেখে সেই বিচারে বিড়ম্বনার সম্ভাবনাই জোরালো হচ্ছে। অভয়া মৃত্যুর অব্যবহিত পরেই হাসপাতাল চত্বর থেকে প্রাতিষ্ঠানিক চক্রান্তে যেভাবে হত্যার যাবতীয় প্রমাণ লোপাট করা হয়েছিল সেগুলি সিবিআই তদন্তেও এখনও অধরা থেকে গেছে। দুনিয়াসুদ্ধ মানুষ ঐ হত্যাকে প্রাতিষ্ঠানিক চক্রান্ত মনে করলেও সিবিআই তদন্তে সেই চক্রান্তের জাল ছাড়ানো সম্ভব হয়নি হত্যার তিন মাস পরেও। তদন্তের বিলম্বকে বৈধতা দিতে একদিকে ভাসিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘Justice hurried is justice burried’ এর ভাষ্য। কিন্তু সেই সঙ্গে জোরালো হচ্ছে প্রতিদিন ‘justice delayed justice denied’ এ ভাষ্যটিও। এমন প্রেক্ষিতে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের শুনানি তারিখের পর তারিখ পেরিয়ে চলেছে ফলে ধৈর্যের বাঁধ ভাঙার উপক্রম মানুষের। তদন্ত প্রক্রিয়ায় এই কাল বিলম্বে সবচেয়ে বেশি লাভবান হচ্ছে এই প্রাতিষ্ঠানিক চক্রান্তের কুশীলবেরা যারা এই বিলম্বের ফাঁক দিয়ে অপরাধের প্রাসঙ্গিক নথিপত্র ও প্রমাণ লোপাটের বাড়তি সুযোগ পাচ্ছেন।
এমনকি এই হত্যায় অভিযুক্ত একমাত্র সিভিক পুলিশ জেল হেপাজতে থাকা অবস্থাতেই প্রশাসনের বিরুদ্ধে তাকে ফাঁসানোর অভিযোগ করেছেন। সিবিআই এবং কলকাতা পুলিশ উভয়েই যেহেতু একমাত্র সিভিক পুলিশের বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করেছে, ফলে শাসক তৃণমূল এই হত্যার পেছনে প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার অভিযোগ নস্যাৎ করতে চাইছে। নস্যাৎ করতে চাইছে রাজ্যের পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা যাবতীয় দুষ্কর্মের অভিযোগ। আর সেই পথেই অপরাধীরা পার পাওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু মনে রাখা উচিত যে সিবিআই কিংবা পুলিশ উভয়ই অপরাধের তদন্তে ব্যর্থ হলে সেই অন্যায় কখনই ন্যায়ে পরিণত হয় না। যেমন হয় না সারদা, নারদ থেকে শিক্ষক নিয়োগ কিংবা খাদ্য কেলেঙ্কারির পেছনে থাকা কোটি কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ ।
এই অবস্থায় তদন্তে এবং বিচার বিলম্বের প্রেক্ষিতে রাজ্যে ধর্ষণ মহামারীর গতিতে বেড়ে চলেছে। অপরাধীরা টের পেয়েছে অপরাধ করেও কলার তুলে সমাজে বাস করা যায় সন্দীপ ঘোষের মডেলে, আর ধরা পড়লে নন্দ ঘোষ মডেলে মুক্তির পথ বাতলাবে স্বয়ং প্রশাসনের কর্তারাই। রাজ্যের এমন আবহ ‘থ্রেট কালচার’ শব্দ বাঙালির শব্দ ভাণ্ডারে যুক্ত হয়েছে। সেই সংস্কৃতির ধারক বাহক তৃণমূলের নেতা মন্ত্রীরা রাজ্য জুড়ে প্রতিবাদীদের বিরুদ্ধে আক্রমণ, মিথ্যা মামলা, চরিত্র হনন এবং ষড়যন্ত্র করে চলেছে পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে। এই প্রেক্ষিতে তদন্ত এবং বিচারপ্রক্রিয়ার শম্বুক গতি অভয়ার ন্যায় বিচারের অন্তরায় হয়ে উঠছে। ফলে অভয়ার বিচারের দাবিতে ‘অভয়া মঞ্চ’ গড়ে জনতার চার্জশিট পেশের আন্দোলন শুরু হয়েছে। প্রতিবাদী মানুষেরা সার বুঝেছে যে রাজপথের আন্দোলন আলগা হয়ে উঠলেই এমন প্রাতিষ্ঠানিক হত্যার সুবিচার অসম্ভব। ফলে জুনিয়র ডাক্তারেরা কাজে ফেরার পর যারা ভেবেছিলেন যে আন্দোলন শেষের শুরু হলো, সেই গুড়ে বালি দিয়ে আন্দোলনের নতুন অধ্যায় শুরু হয়েছে। ফলে গত দু’মাস ধরে রাজ্যে চলা খুন- ধর্ষণের বিরুদ্ধে কিংবা আবাস দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেলায় জেলায় মানুষের প্রতিবাদ আন্দোলন ঐ অভয়া আন্দোলনের কক্ষ পথেই তৈরি হয়েছে। ফলে অভয়ার বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন স্বৈরাচারী শাসকের মুখের ওপর আমজনতার প্রশ্ন ছুড়ে দেওয়ার সাহস তৈরি করেছে। আর এই সাহসের বার্তা শহর থেকে গ্রামে সংক্রমিত হচ্ছে বলেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠছে শাসক। আর ভয় পাচ্ছে বলেই তাঁরা ভয় দেখানোর পথ খুঁজছে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদে।
Justice Awaited
দ্রোহকালের তিন মাস
×
Comments :0