আট বছর পরে ফের ফাইনালে আর্জেন্টিনা। ব্রাজিলকে হারিয়ে আসার পরে ক্রোয়েশিয়ার যে বাড়তি উদ্যম ছিল, তা দিয়ে সবই হয়ত হয়, লিওনেল মেসিকে আটকানো যায় না। এই নয় যে সেমিফাইনালে একচ্ছত্র আধিপত্য নিয়ে খেলেছে আর্জেন্টিনা। কিন্তু যখন দরকার তখন ফুটে উঠেছে লাতিন আমেরিকার সাহস, মারাদোনার উত্তরপুরুষদের বল নিয়ে কারুকার্য, অন্তর্নিহিত টেকনিক্যাল দক্ষতা। বিধ্বস্ত হয়ে গেছেন লুকা মড্রিচরা।
প্রথম আধ ঘণ্টা ম্যাচে ক্রেয়েশিয়ার আধিপত্য ছিল। বিশেষত মাঝমাঠ দখলে রেখে তারা রীতিমতো হয়রান করেছে আর্জেন্টিনাকে। গোলমুখে হানা দিতে না পারলেও আর্জেন্টিনাকে আক্রমণ করার প্রায় কোনো সুযোগই দেয়নি। মড্রিচ, কোভাসিচ, ব্রোজোভিচ মিলে আর্জেন্টিনার ছন্দ ভেঙে দিয়েছিলেন। হঠাৎই খেলা ঘুরে গেল। মাঝমাঠ পেরিয়ে এঞ্জো ফার্নান্ডেজের বাড়ানো বল ধরে ক্রোয়েশিয়ার পেনাল্টি বক্সে ঢুকে যান আলভারেজ। গোলরক্ষক লিভাকোভিচের মাথার ওপর দিয়ে বল চিপ করে দেন আলভারেজ। কিন্তু তার আগেই লিভাকোভিচ আলভারেজকে শরীর দিয়ে, পা দিয়ে ফেলে দেন। পেনাল্টি পায় আর্জেন্টিনা।
স্পষ্ট পেনাল্টি, এমনকি লাল কার্ডও হতে পারত। ৩৪ মিনিটে এই পেনাল্টি শট মারতে যান মেসি। শ্বাসরুদ্ধ স্টেডিয়ামকে সাক্ষী রেখে কামানের গোলার মতো শট জড়িয়ে দেন জালে। বিশ্বকাপে তাঁর ১১ তম গোল। পেরিয়ে যান বাতিস্তুতাকে, দেশের হয়ে সর্বোচ্চ বিশ্বকাপ গোল। এর পরে চাঙ্গা হয়ে ওঠে আর্জেন্টিনা। মেসি শুরু করে দেন তাঁর বল প্লে। একটু আগে যে ক্রোয়েশিয়াকে দুর্ভেদ্য মনে হচ্ছিল, তা অগোছালো হয়ে যায়।
৩৮ মিনিটে এক বিস্ময় গোল। নিজেদের এলাকা থেকে বল পেয়ে তীব্র গতিতে দৌড়তে থাকেন আলভারেজ। তিন ডিফেন্ডারকে পেরিয়ে পৌঁছে যান ক্রোয়েশিয়ার পেনাল্টি বক্সে। যেন ১৯৮৬’র মারাদোনার সেই বিখ্যাত গোলের ছবি তাঁর মস্তিষ্কে খেলা করছে। দু’দিক থেকে আর্জেন্টিনার দুই উইং ব্যাক ছুটে আসছেন। যে কাউকে বল ঠেলবেন আলভারেজ। কিন্তু কাউকে বল দিলেন না, যেমন ৩৬ বছর আগে কাউকে দেননি মারাদোনা। ধাক্কা খেলেন একবার, কিন্তু তখন আলভারেজকে রুখে দেবার আর কোনো শক্তিই নেই। গোল। এমনকি মেসিও হতবাক হয়ে দেখছেন তাঁর সতীর্থের এই গোল। মারাদোনার মতো নয় নিশ্চয়ই, মাঝপথে ড্রিবল করেননি তিনি, কিন্তু বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে মেসি-নেইমার ছাড়া এমন গোল কেউ করতে পারেন, ভাবতে পারেননি কেউ।
দ্বিতীয়ার্ধের ৬৯ মিনিটে এল সেই যাদুময় দৃশ্য। টাচলাইনে বল পেয়ে নিয়ন্ত্রণ নিলেন মেসি।
পাখির মতো উড়তে উড়তে ঢুকে পড়লেন ক্রোয়েশিয়ার রক্ষণে। তাঁর পায়ে বল আর তা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন গাভারদিয়োল। এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ— মেসি বল নিয়ে ঘুরেই চলেছেন নাচের ভঙ্গিমায়। শেষ পর্যন্ত মাইনাস করলেন যখন তখন আলভারেজের সামনে দিগন্তজোড়া গোলের মুখ। নিখুঁত প্লেসিং। কার গোল? যে ডিফেন্ডার মেসিকে একা আটকানোর চেষ্টা করছিলেন তাঁর লজ্জিত হবার কোনো কারণ নেই, কেননা তাঁর থেকে অনেক বড় মাপের ডিফেন্ডাররা বারংবার এই ঘূর্ণনের সামনে পরাস্ত হয়েছেন।
মেসি রয়ে গেলেন তাঁর স্বপ্ন নিয়ে। বিদায় নিলেন আরেকজন—লুকা মড্রিচ। ৮০ মিনিটে মাঠ ছাড়েন তিনি। তাঁর বয়স ৩৭। আর কি খেলবেন আন্তর্জাতিক স্তরে? ক্রোয়েশিয়ার ইতিহাসে সেরা প্লেয়ার এবং বিশ্বের সর্বকালের অন্যতম সেরা মিডফিল্ডার ম্যাচের পরে কাঁদেননি। তিনি জানেন আসলে কার কাছে তিনি হেরেছেন।
Comments :0