এবার বাংলা ভাগের দাবি তুললেন বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে। ওই দাবির মধ্যে সাম্প্রদায়িক উসকানিও রয়েছে। বৃহস্পতিবার তিনি লোকসভায় বিহারের তিনটি এবং পশ্চিমবঙ্গের দুটি জেলাকে নিয়ে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের আওতায় আনার দাবি তুলেছেন। ওই জেলাগুলি দিয়ে ব্যাপক হারে অনুপ্রবেশ হওয়ার ফলে ‘জনবিন্যাসের ভারসাম্য’ বদলে যাচ্ছে বলেও তিনি দাবি করেন। একারণেই পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদ এবং বিহারের কিষানগঞ্জ, আরারিয়া ও কাটিহারকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করার দাবি জানান তিনি। ওই পাঁচ জেলাতেই মুসলিম জনসংখ্যার আধিক্য রয়েছে। এমনকি এই জেলাগুলিতে হিন্দুরা অত্যাচারিত হচ্ছে বলেও এদিন জোর গলায় জানিয়েছেন দুবে। এর আগে বুধবারই প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর সঙ্গে দেখা করে কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী সুকান্ত মজুমদার উত্তরবঙ্গের ৮ জেলাকে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার দাবি জানিয়েছিলেন। সুকান্তের দাবির পরেই নিশিকান্তের বাংলা ভাগের বিস্ফোরক মন্তব্য পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নতুন উত্তাপ ছড়িয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই দুই বিজেপি সাংসদের মন্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন সিপিআই(এম) সহ তৃণমূল নেতৃবৃন্দ।
ঝাড়খণ্ডের গোড্ডার বিজেপি সাংসদ নিশিকান্ত দুবে বৃহস্পতিবার লোকসভার জিরো আওয়ারে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের উল্লিখিত জেলাগুলিতে বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের কারণে জনবিন্যাস বদলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন। সেই সঙ্গে তিনি দাবি করেন, ‘‘ওই জেলাগুলিকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল ঘোষণা করে এনআরসি কার্যকরের উদ্যোগ নিক কেন্দ্র। এমন কী কিছু করতে পারলে আগে কমিটি পাঠাক।’’ দুবের এমনও দাবি, তাঁর রাজ্য ঝাড়খণ্ডে আদিবাসী জনসংখ্যা ১০ শতাংশ কমে গিয়েছে। তিনি বলেন, মালদহ, মুর্শিদাবাদের মতো বিহারের কাটিহার, আরারিয়া, কিষানগঞ্জ এবং পশ্চিমবঙ্গের মালদহ ও মুর্শিদাবাদে বিপুল পরিমাণে অনুপ্রবেশ ঘটছে প্রতিনিয়ত। এমনকি মালদহ, মুর্শিদাবাদ থেকে গিয়ে ঝাড়খণ্ডে হিন্দুদের ওপর অত্যাচার চালানো হচ্ছে বলেও তীব্র সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করেন তিনি। তাঁর দাবি, কেন্দ্রীয় সরকার অবিলম্বে ব্যবস্থা না নিলে হিন্দুরা আর টিকবে না। একথা বলতে গিয়ে দুবে ঝাড়খণ্ডে অনুপ্রবেশকারিরা আদিবাসী মেয়েদের বিয়ে করছে বলে ‘লাভ জিহাদ’র অভিযোগও করেন। বক্তব্যে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারের নামও টেনে আনেন নিশিকান্ত। তিনি বলেন, ‘‘বাংলাদেশীদের অনুপ্রবেশ সুনিশ্চিত করতে বাংলায় মমতা ব্যানার্জির পুলিশ মালদহ ও মুর্শিদাবাদে গ্রামের পর গ্রাম খালি করে দিচ্ছে।’’ আবার দুবে জানান, তাঁর বক্তব্য ভুল প্রমাণিত হলে তিনি পদত্যাগ করতেও তৈরি। প্রসঙ্গত, এই নিশিকান্তই প্রথম কৃষ্ণনগরের তৃণমূল সাংসদ মহুয়া মৈত্রের বিরুদ্ধে ‘অর্থের বিনিময়ে প্রশ্ন’ করার অভিযোগ তুলেছিলেন। যার জেরে গত লোকসভা থেকে বহিষ্কৃত হতে হয় মহুয়াকে।
বাংলার উত্তরের জেলাগুলি ভাগ করা নিয়ে বুধবার থেকেই শুরু হয়েছে বিতর্ক। ওইদিন প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেন সুকান্ত মজুমদার। বৈঠক শেষে বিজেপি’র রাজ্য সভাপতি ও কেন্দ্রীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী বলেন, “উন্নয়নের স্বার্থে উত্তরবঙ্গের আট জেলাকে উত্তর-পূর্বের সঙ্গে যুক্ত করার দাবি করেছি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কাছে।” তাঁর দাবি, বাংলার উন্নয়নের স্বার্থেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে এই দাবি রেখেছেন তিনি। নিজের বক্তব্যের সমর্থনে বঙ্গ বিজেপি’র সব সাংসদকে প্রধানমন্ত্রীর সামনে হাজির করতে পারেন বলেও দাবি করেন। তার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে সময়ও চেয়েছেন। বস্তুত, সুকান্তের এমন বক্তব্যের পরেই বাংলা ভাগের আরেক দাবি এদিন করলেন বিজেপি’রই সাংসদ নিশিকান্ত দুবে।
উল্লেখ্য, বুধবার রাজ্যসভায় গ্রেটার কোচবিহার ঘোষণার দাবি জানিয়েছিলেন অনন্ত মহারাজ। তিনি জানান, গ্রেটার কোচবিহার পিপলস অ্যাসোসিয়েশন চায় বাংলা থেকে আলাদা করে গ্রেটার কোচবিহার তৈরি হোক। কেন্দ্রের তরফে তাঁকে এই বিষয়ে মৌখিক আশ্বাস দেওয়া হয়েছে বলেও দাবি।
সুকান্ত মজুমদার এবং নিশিকান্ত দুবের বাংলা ভাগ নিয়ে মন্তব্যের তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সিপিআই(এম)-র রাজ্যসভার সাংসদ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘‘বিজেপি’র হিন্দু রাষ্ট্র গঠনের কুপ্রচেষ্টা বহুদিনের। একারণেই লোকসভা ভোটের আগে ৪০০ পারের হুঙ্কার দিয়েছিলেন যাতে নিজেদের অভিষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছতে সুবিধা হয়। এমনকি নিজেকে দেবতার প্রতিভূ বলেও দাবি করেছিলেন। তাহলে বোঝানো যেত, সেই হিন্দুরাষ্ট্র স্বয়ং দেবতাই করে দিয়েছেন। কিন্তু আশা পূরণ হয়নি ভোটে বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পাওয়ায়। একারণেই এখন এলকাভিত্তিক হিন্দুদের জোটবদ্ধ করার প্রয়াস চালানো হচ্ছে। বুধবার সুকান্ত মজুমদারের উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিকে আলাদা করে উত্তর-পূর্ব ভারতের সঙ্গে যুক্ত করার প্রস্তাব কিংবা এদিন নিশিকান্ত দুবের বাংলার দুই এবং বিহারের তিন জেলাকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের অন্তর্গত করার দাবির মধ্যে হিন্দু সংখ্যাধিক্যের ভাবনা নিহিত রয়েছে। আসলে বিজেপি চাইছে দেশকে টুকরো টুকরে করে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে পরিণত করে সারাসরি কেন্দ্রের মাধ্যমে শাসন করা। সেখানে শুধু হিন্দুরাই থাকবে। কাঁওয়ার যাত্রার সময় দোকানদারদের পরিচিতি তুলে ধরার ফতোয়া কিংবা আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্তবিশ্ব শর্মার একইভাবে ‘ভারসাম্য বজায়’ রাখার মন্তব্যের মধ্যেও সেই হিন্দুদের জোটবদ্ধ করার হুমকিই ছিল। এখন পশ্চিমবঙ্গে সেই উদ্যোগ চলছে।’’ তবে তিনি মনে করেন, ‘‘এর জমি তৈরি করে দিয়েছেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি পরিচিতি সত্ত্বার রাজনীতি করে। এখন তার বিষময় প্রতিফলন ঘটছে।’’
Nishikant Dubey
হিন্দুত্বের জিগির তুলে এবার বাংলা ভাগের দাবি দুবের
×
Comments :0