অমিত কুমার দেব
ক্রমশ দরিদ্র অংশের পরিবারের সন্তানদের শিক্ষা গ্রহণের পরিসর ছোট হয়ে আসছে কেন্দ্রের শিক্ষানীতির কারণে। তার উদাহরণ দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ হয়ে থাকা জাতীয় শিশু শ্রমিক প্রকল্প। কেন্দ্রীয় শ্রম দপ্তরের সীমাহীন অবহেলায় লেখাপড়া করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত কোচবিহার জেলার এক হাজারেরও বেশি শিশু শ্রমিক। ২০২২সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে বন্ধ রয়েছে জাতীয় শিশু শ্রমিক প্রকল্পের অন্তর্গত কোচবিহার জেলার ১৯টি শিশু শ্রমিক বিদ্যালয়। কর্মহীন হয়ে পড়েছেন এই ১৯টি বিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে কর্মরত থাকা ৩৮জন শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং ৩৮জন শিক্ষাকর্মী।
কোচবিহার জেলায় এই ১৯টি বিদ্যালয়ের মধ্যে দিনহাটা গীতালদহ বিকাশ সমিতি পরিচালনা করতো ১০টি স্কুল। জেলার সিতাই, শীতলকুচি, মাথাভাঙ্গা ১নং ব্লক, দিনহাটা-১ ও ২নং ব্লক, তুফানগঞ্জ-১ ও ২নং ব্লকে স্কুলগুলি পরিচালনা করতো এই সংস্থা। এছাড়াও ক্যাপস নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা পরিচালনা করতো ৫টি স্কুল এবং হলদিবাড়ি ওয়েলফেয়ার সংস্থা পরিচালনা করতো ৪টি স্কুল। ক্যাপস পরিচালিত স্কুলগুলি ছিল কোচবিহার পৌরসভা, দিনহাটা পৌরসভা এবং কোচবিহার ১নং ব্লক এলাকায়। আর হলদিবাড়ি ওয়েলফেয়ার সংস্থা পরিচালনা করতো হলদিবাড়ি ব্লক এলাকার ৪টি স্কুল।
২০১৭সাল থেকে এই বিদ্যালয়গুলির পথ চলা শুরু করে কোচবিহার জেলায়। ৪বছরের বেশি সময় ধরে এই বিদ্যালয়গুলি সঠিকভাবে চললেও, ২০২২সালের সেপ্টেম্বর মাসে পুরোপুরি ভাবে বন্ধ হয়ে যায় কোচবিহার জেলার এই ১৯টি শিশু শ্রমিক স্কুল। জানা যায়, এই প্রতিটি স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ছিল ন্যূনতম ৪০জন। এরা প্রত্যেকেই ছিল শিশু শ্রমিক। এদের মধ্যে কেউ ছিলো মুদির দোকানের কর্মচারী, কেউ বাসা বাড়িতে কাজে যুক্ত ছিল, কেউ সাইকেল গ্যারেজে কাজ করতো, আবার কেউ কাজ করতো ইট ভাঁটায়। প্রত্যেকটি স্কুলের এই পড়ুয়াদের সাথে আলাদাভাবে সভা করে এই বিদ্যালয় গুলিতে ক্লাসের সময় ঠিক করা হতো। জানা যায়, প্রতিটি বিদ্যালয় ছিল মিড ডে মিলের ব্যবস্থা। এই বিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা প্রতি মাসে ৪০০টাকা করে স্টাইপেনও পেতো। তবে শেষ দুবছর এই প্রাপ্য স্টাইপেনের টাকা তারা পায়নি বলে অভিযোগ।
প্রথম শ্রেণী থেকে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত এই এক একটি বিদ্যালয়ের পানীয় জল, বিদ্যুৎ এবং ঘর ভাড়া বাবদ কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে দেওয়া হতো মাসিক ৩হাজার টাকা। প্রত্যেকটি বিদ্যালয়ে শিক্ষক অথবা শিক্ষিকা ছিলেন দুজন এবং শিক্ষা কর্মী ছিলেন দুজন। শিক্ষক-শিক্ষিকারা মাসিক ভাতা পেতেন ৭ হাজার টাকা এবং শিক্ষাকর্মীদের মাসিক ভাতা ছিল সাড়ে ৩ হাজার টাকা।
জানা যায়, ২০১৭ সালে ভারত সরকারের এই প্রকল্প কোচবিহারে শুরু হলেও, গোটা দেশের বিভিন্ন রাজ্যের এই প্রকল্পটি প্রায় ২০০৮ সাল থেকে শুরু হয়। দীর্ঘদিন এই বিদ্যালয়গুলি চললেও ২০২২ সালে কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়ে দেয় যে সর্বশিক্ষা মিশন বা অন্যান্য প্রকল্পের মধ্য দিয়ে শ্রমিকরা মূল স্রোতে ফিরে এসেছে অর্থাৎ সবাই বিদ্যালয়মুখী হয়েছে। এরপর কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম দপ্তর সিদ্ধান্ত করে সংশ্লিষ্ট এই প্রকল্পটি বন্ধ করে দেয়। এরপরই জেলা প্রশাসন লিখিতভাবে নির্দেশ করে এই বিদ্যালয়গুলিতে পাঠরত পড়ুয়াদের বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের স্থানান্তরিত করতে। এই নির্দেশ মতোই শিশু শ্রমিকদের স্থানান্তরিত করে দেওয়া হয়। তবে এদের মধ্যে অধিকাংশই স্কুলছুট হয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তে যেমন শিশু শ্রমিকদের শিক্ষা গ্রহণ বিশবাঁও জলে। ঠিক একই ভাবে এই বিদ্যালয়গুলিতে কর্মরত শিক্ষক-অশিক্ষক কর্মচারীরাও কাজ হারিয়ে চরম সংকটে।
Comments :0