বই — মুক্তধারা
অন্তর্নিহিত দর্শনের কারণেই বিবর্তনবাদের উপর আক্রমণ
তপন মিশ্র
বর্তমান সময়ে অভিব্যক্তি সম্পর্কে আলোচনা অত্যন্ত জরুরি। কিশোর মন থেকে জীব জগতের বৈচিত্রের কারণ, পাঠ্ক্রমে অভিব্যক্তিবাদ পঠন পাঠনের মধ্যদিয়ে যুক্তিবাদ এবং বিজ্ঞানের মৌলিক বিষয়গুলি সম্পর্কে ধারণা তৈরি কেন্দ্রীয় সরকারে অধীনে থাকা এনসিইআরটি অপ্রয়োজনীয় মনে করছে। এই সময়ে ‘বিবর্তনঃ আদিযুদ্ধ আদিপ্রেম’ ২০২২ সালের পরিমার্জিত সংস্করণ, সন্দেহ নেই, অত্যন্ত গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
লেখক সম্ভবত বইটির নামকরণ করতে গিয়ে ডারউইন তত্বের ‘Struggle for Existence’ বা ‘টিকে থাকার সংগ্রাম’ কথাটি সহজে বোঝাতে গিয়ে ‘আদিযুদ্ধ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। ‘আদিপ্রেম’ শব্দটি সম্ভবত ‘Sexual selection’ বা ‘যৌন নির্বাচন’ কথাটি বোঝাতে ব্যবহার করেছেন। ডারউইনের ১৮৫৯ সালে প্রকাশিত Origin of Species বইটিতে টিকে থাকার সংগ্রাম কথাটি বার বার ব্যবহৃত হলেও যৌন নির্বাচন কথাটি স্বল্প ব্যবহৃত হয়েছে। তাঁর ১৮৭১ সালে প্রকাশিত Descent of Man and Selection in Relation to Sex বইটিতে যৌন নির্বাচনের তত্ত্ব বিশদভাবে তুলে ধরেন।
বইটির রচনা শৈলী আকর্ষণীয় হওয়ায় নিশ্চয়ই পাঠকের কাছে সুখপাঠ্য হবে। প্রথম অধ্যায়ের‘বিধাতার হাত’উপঅধ্যায়ে লেখক জোরালোভাবে সমস্ত ধর্মগ্রন্থে সৃষ্টিতত্ত্বের ধারা যে এক সেকথা বলেছেন। যুক্তিবাদী মানুষ যে ধীরে ধীরে ধর্মীয় ধারণা ত্যাগ করার চেষ্টা করেছে তার উল্লেখ আছে। অত্যন্ত সহজ ভাষায় লেখক ‘প্রকরণ’ যে অভিব্যক্তির একটি গুরুত্বপুর্ণ কারণ তা স্পষ্ট করা আছে।
অভিব্যক্তিবাদের ইতিহাস কেবল ডারউইনবাদের মধ্যে আবদ্ধ নয়। দ্বিতীয় অধ্যায়ের উপঅধ্যায় ‘ডারউইন পেরিয়ে’ তে লেখক ডারউইন পরবর্তী সময়ে অভিব্যক্তি বিজ্ঞানের যে বিকাশ ঘটেছে তার উল্লেখ করেন।‘ক্লোনিং-এর মধ্যদিয়ে ‘সদৃশ যমজ’ তৈরি হতে পারে কিন্তু শারীরিক বৈশিষ্টের উত্তরাধিকার কখন ওই মানসিক বৈশিষ্টের উত্তরাধিকার নিশ্চিত করতে পারে না। এই বিষয়টি লেখক পঞ্চম অধ্যায়ে ‘একটি ভেড়ার জন্ম’ এই উপঅধ্যায়ে উল্লেখ করেন। বইটিতে গ্রেগর মেন্ডেলের কথা বার বার এসেছে। বংশগতি বিজ্ঞানের জনক মেন্ডেল অভিব্যক্তি গবেষণাকে অনেকটাই আধুনিক করার রসদ জুগিয়েছেন। বইটিতে অণুজীববিজ্ঞানের অনেক বিষয় যেমন DNA, ক্রোমোজোম ইত্যাদির গঠন, ক্রোমোজোম স্তরে বংশগতির প্রবাহ ইত্যদি সহজ ভাষায় উল্লেখিত হয়েছে। লেখক দ্বাদশ অধ্যায়ে বিবর্তন সম্পর্কিত অনেক ভুল ধারণার আলোচনা করেছেন। যেমন একটি ভুল ধারণা হলো ‘একটি জীবের বেঁচে থাকার সমস্ত কিছু প্রাকৃতিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে হাসিল করা যায়। প্রাকৃতিক নির্বাচন যে প্রকৃতির নিয়ন্ত্রণে চালিত এবং মানুষের নিয়ন্ত্রণ হানিকর হতে পারে তা সঠিকভাবেই লেখক উল্লেখ করেছেন।
সবশেষে একটি বিষয়ের প্রতি লেখক সহ পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার লোভ সম্বরণ করতে পারছি না। ডারউইনের আগে থেকেই অভিব্যক্তিতত্বের যে দিকটি বার বার আক্রান্ত হয়েছে তা হলো এই বিকাশমান বিজ্ঞানের অন্তর্নিহিত দর্শন। কার্লস লিনিয়াস ছিলেন প্রথম প্রকৃতিবিদ যিনি ১৭৩৫ সালে মানুষকে প্রাণীজগতের কুয়াড্রুপেডদের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। ফলে ধর্মীয় নেতাদের থেকে সেই দিন থেকেই অভিব্যক্তি সম্পর্কিত যুক্তিবাদী দর্শনের উপর আক্রমণ এসেছে বার বার। ডারউইন এবং তাঁর পরবর্তী সময়ে বস্তুবাদী চিন্তার আলোকে প্রকৃতির দ্বান্দ্বিক বিকাশের এই ধারায় আরও পুষ্ট হয়েছে। ২০২২ সালে ভান্তে পাবোর গবেষণা এই সত্যকে আরও দৃঢ ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়েছে। এই সত্যের বিরোধিতার জন্যই এনসিইআরটি দশম শ্রেণি থেকে অভিব্যক্তি সম্পর্কিত সমস্ত অধ্যায় বাদ দিয়েছে। অবশ্য আলোচিত বইটির বেশ কিছু অংশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এই ধারণার উল্লেখ যে নেই তা নয়।
বইটির মুখবন্ধ লিখেছেন অধ্যাপক পার্থ প্রতিম মজুমদারের মতো একজন প্রখ্যাত জীব বিজ্ঞানী। অত্যন্ত সুন্দরভাবে বইটি সম্পর্কে তিনি আলোচনা করেছেন। বইটির প্রচ্ছদও আকর্ষণীয়। এই সময়ে, যখন চিন্তার জগতে অন্ধকার আরও ঘনীভূত হচ্ছে,তখন এই বইটির প্রচার জরুরি হয়ে পড়েছে বলে মনে হয়।
বিবর্তন : আদিযুদ্ধ আদিপ্রেম
জয়ন্ত দাস । গাঙচিল। ৪৫০ টাকা।
Comments :0