অনিন্দ্য হাজরা
জনগণনা কী কেবল কোভিডের জন্য পিছাচ্ছে? সব কিছু স্বাভাবিক হওয়ার পরও কেন্দ্র জনগণনা চালু করছে না কেন? প্রতি দশকে একবার জনগণনা হয় দেশে। শেষবার জনগণনা হয়েছে ২০১১’তে।
জনগণনায় কেবল জনসংখ্যা পাওয়া যায় না। দেশের বহু তথ্য উঠে আসে। বিভিন্ন অংশেরই মত, জনগণনা হলে কেন্দ্রের বিজেপি সরকারের ফাঁপা দাবি ধরা পড়ে যাবে। লক্ষ্যণীয়, মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার গত কুড়ি বছরে গুরুত্বপূর্ণ মাত্রায় কমেছে। জনগণনা হলে সেই প্রবণতা আরও স্পষ্ট হতে পারে বলে মত অনেকের। একাংশের মত, ফলে ধাক্কা খাবে মুসলিম জনসংখ্যা ঘিরে আরএসএস’র ভুয়ো প্রচারও।
কী বলেছে ২০১১’র সেন্সাস
২০১১’র জনগণনা রিপোর্টেই মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধি সম্পর্কে নির্দিষ্ট বক্তব্য পেশ করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ‘‘ধর্মীয় অংশের বিচারে আলাদা করে দেখলেও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে। এর মধ্যে মুসলিমদের ক্ষেত্রে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তীক্ষ্ণভাবে কমেছে।’’ আরও জানানো হয়েছিল যে, ১৯৯১-২০০১ দশকে হিন্দুদের বৃদ্ধির হার ১৯.৯২ শতাংশ। মুসলিমদের ছিল ২৯.৫২ শতাংশ। ২০০১-২০১১ দশকে হিন্দুদের বৃদ্ধির হার হয় ১৬.৭৬ শতাংশ, মুসলিমদের ২৪.৬০ শতাংশ।
সেই শেষ জনগণনা রিপোর্ট প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে জানানো হয় যে, ‘‘প্রবণতা যা তাতে ২০১১’র জনগণনায় হিন্দু, মুসলিম এবং খ্রীস্টানদের মতো ধর্মীয় অংশগুলিতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আরও কমবে।’’
এই ২০২১’র জনগণনাই আটকে দিয়েছে কেন্দ্রের বিজেপি জোট সরকার। যে সরকারের পিছনে রয়েছে উগ্র সাম্প্রদায়িক আরএসএস। শেষ জনগণনার অনুমান যদিও ভুল ছিল না। কারণ গত বছর পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার নমুনা থেকে দেখা যায় যে মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার লক্ষ্যণীয় মাত্রায় কমেছে। কিন্তু জনগণনার রিপোর্টে সেই তথ্য থাকলে তার রাজনৈতিক অভিঘাত অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মুসলিম বিরোধী উন্মত্ততা তৈরি করতে গোটা সঙ্ঘ পরিবার ঠিক উলটো অসত্য বক্তব্য পেশ করে চলেছে সারা দেশে।
কেন জনগণনা দরকার
১৮৭২ সাল থেকে নিয়মিত ভাবে ভারতে ‘সেন্সাস’ বা জনগণনা হয়ে আসছে। কেন্দ্রীয় সরকার কোভিড-লকডাউন দেখিয়ে জনগণনা পিছিয়েছে। ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচন। তার আগে জনগণনা হওয়ার সম্ভাবনা কম।
২০২২ সালের জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী, গত দুই দশকে মুসলমান সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা হ্রাসের হার ভারতের অন্যান্য ধর্মীয় গোষ্ঠীর মধ্যে সর্বাধিক। ২০১৯-২১ সালে মুসলমান সম্প্রদায়ের ‘ফার্টিলিটি রেট’ বা প্রজনন হার ২.৩। তার অর্থ একজন মহিলা গড়ে কতজন সন্তানের জন্ম দিয়ে থাকেন। ১৯৯২-৯৩ সালে মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রজনন হার ছিল ছিল ৪.৪। ২০১৫-১৬ সালে সেটি কমে দাঁড়ায় ২.৬-এ।
১৯৯২-৯৩ সালে ভারতে হিন্দুদের প্রজনন হার ছিল ৩.৩। ২০১৫-১৬ সালে সেটি কমে দাঁড়ায় ২.১-এ। ২০১৯-২১’র রিপোর্টে সেই হার আরও কমে হয়েছে ১.৯৪।
জনগণনা কেন গুরুত্বের? স্পষ্ট বুঝিয়ে দেবে রেজিস্ট্রার জেনারেলের বিজ্ঞপ্তিই। ২০২০’তে জনগণনা শুরুর জন্য জারি এই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল যে আবাসের অবস্থা, নাগরিক সুযোগসুবিধা, মানবসম্পদের তথ্য মেলে কেবল শহরে নয়, দূরপ্রান্তের গ্রামেও। পরিকল্পনা এবং নীতি প্রণয়নে এই তথ্য অত্যন্ত দরকারি।
যেমন এই মুহূর্তে দেশের ৮১.৫ কোটি মানুষ জাতীয় খাদ্য সুরক্ষা আইনের আওতায় সুলভে খাদ্যশস্য পান। এই ৮১.৫ কোটি মানুষের হিসেব পাওয়া গিয়েছে ২০১১’র জনগণনায়। বর্তমান হিসেবে এই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ানোর কথা ৯২ কোটিতে। কিন্তু জনগণনা না হওয়ায় খাদ্য সুরক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন ১০ কোটির কাছাকাছি মানুষ। সেই সঙ্গে তথ্যের আয়নায় বিচার করা যায় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারও।
ধর্ম নয়, জনসংখ্যার নির্ধারক সামাজিক অবস্থা
কেবলমাত্র হিন্দু কিংবা মুসলমান সম্প্রদায়ই নয়, সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যেই কমেছে জন্মহার। স্বাভাবিক ভাবে গোটা দেশের ফার্টিলিটি রেট কমে দাঁড়িয়েছে ২-এ। ২০১৬-১৬ সালেও এই হার ছিল ২.২এ। প্রসঙ্গত, ভারতের রিপ্লেসমেন্ট রেট হল ২.১। অর্থাৎ দেশের ফার্টিলিটি রেট রিপ্লেসমেন্ট রেটের থেকেও কমে গিয়েছে।
ভারতে ‘রিপ্লেসমেন্ট রেট’ ২.১-র নিচে নামলে কমবে জনসংখ্যাও। মুসলিম জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ২.৩, তার কাছাকাছিই রয়েছে। ফলে ‘মুসলিম জনবিস্ফোরণ’ মার্কা সঙ্ঘের প্রচারেও সমস্যা রয়েছে। জনগণনার টাটকা তথ্য সামনে এলে সমস্যা আরও বাড়বে উগ্র হিন্দুত্ববাদীদের।
জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার রিপোর্ট অনুযায়ী জন্মহার কমার পিছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে নারী শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো বিষয়গুলির।
কেরালা, জম্মু-কাশ্মীর প্রভৃতি রাজ্যগুলি এই সূচকে এগিয়ে। লক্ষ্য করার মতো যে কেরালার জনসংখ্যায় মুসলিমরা প্রায় ৩০ শতাংশ। জম্মু কাশ্মীর দেশের একমাত্র মুসলিম সংখ্যাগুরু রাজ্য। কিন্তু রাজ্যগুলির প্রজনন হার জাতীয় হারের চেয়েও কম। কেরালার ক্ষেত্রে এই হার ১.৭৯, জম্মু-কাশ্মীরের ক্ষেত্রে এই হার ১.৪।
অপরদিকে নারীশিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান প্রভৃতি সূচকে উত্তর ভারতের ‘হিন্দি বলয়’ পিছিয়ে থাকা অঞ্চল। স্বাভাবিক ভাবে এই রাজ্যগুলির ফার্টিলিটি রেটও জাতীয় গড়ের থেকে বেশি। যেমন বিহারের ফার্টিলিটি রেট ২.৯২, উত্তরপ্রদেশ এবং মধ্যপ্রদেশের ক্ষেত্রে সেটি ২.৩ এবং রাজস্থানের ক্ষেত্রে এই হার ২.২। এই রাজ্যগুলিতেও নারীশিক্ষার হার ধারাবাহিক ভাবে বাড়ছে। একইসঙ্গে তৈরি হচ্ছে সামাজিক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে জনমত। তার ফলে এই রাজ্যগুলিতেও ফার্টিলিটি রেট কমার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।
ধরা পড়ার ভয় বিজেপি, সঙ্ঘের
কোভিড পরিস্থিতি সত্ত্বেও বাংলাদেশ, নেপালের মতো দেশ জনগণনার কাজ শেষ করেছে। ব্রাজিল, মেক্সিকো, ইন্দোনেশিয়ার মতো ৭টি দেশ কোভিড পরবর্তী এক-দেড় বছরের মধ্যে জনগণনার কাজ শেষ করে ফেলেছে। ভারতে জনগণনা না হলেও নিয়মিত নির্বাচন কিন্তু হচ্ছে, কোভিড বাধা হচ্ছে না।
২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনের মুখোমুখি হবে ভারত। সেই নির্বাচন জেতার জন্য বিজেপি যে উগ্র ধর্মীয় জিগিরেই ভরসা রাখবে তা এখন থেকেই স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। ২০২৪ সালেই শতবর্ষে পদার্পণ করবে আরএসএস। এই আবহে জনগণনা প্রকাশ পেলে তা জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ে বিজেপি সহ গোটা সঙ্ঘ পরিবারের মিথ্যাচারিতা বেআব্রু করে দেবে। সেই সঙ্গে বেরিয়ে পড়বে মোদী সরকারের অজস্র প্রতিশ্রুতির ফাঁকও। তার জন্য দেশে প্রথমবার জনগণনা পিছিয়ে দিতেও পিছুপা হচ্ছে না বিজেপি।
Comments :0