সুদীপ্ত বসু: কলকাতা
কয়লা পাচারকাণ্ডের তদন্তের বৃত্তে এবার ঢুকে পড়ল মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারও।
কয়লা পাচারকাণ্ডে ‘অতি প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি’র হয়ে টাকা পার্কিংয়ের কাজ যিনি করছিলেন, সেই মনজিৎ সিং গ্রেওয়াল ওরফে জিট্টি ভাইয়ের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের যৌথ সম্পত্তির হদিশ মিলেছে এবং তা হরিশ মুখার্জি রোডেই।
অভিষেক ব্যানার্জির রাজকীয় বাসভবন ‘শান্তিনিকেতন’ ভবন থেকে মাত্র আটটি বাড়ির দূরত্বে। তদন্তকারী সংস্থার হাতে এসেছে জিট্টি ভাইয়ের সঙ্গে খোদ মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের যৌথ সম্পত্তির সেই নথি।
কয়লা পাচারকাণ্ডের বৃত্তে এবার সরাসরি ঢুকে পড়ল খোদ মুখ্যমন্ত্রীর পরিবার। এর আগে এই কয়লা কাণ্ডেই দিল্লির ইডি’র দপ্তরে তিন দফায় এবং সর্বশেষ গত বছরের সেপ্টেম্বরে ম্যারাথন জেরার মুখে পড়েছিলেন তৃণমূলের নম্বর টু, সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জি। কয়লা পাচারকাণ্ডেই জেরার মুখে পড়েছিলেন অভিষেক-জায়া রুজিরা নারুলা ব্যানার্জি, অভিষেকের শ্যালিকা মেনকা গম্ভীর, তাঁর স্বামী ও শ্বশুরও।
এবার মিলল যৌথ সম্পত্তির হদিশ।
২০৪, হরিশ মুখার্জি রোড, কলকাতা-৭০০০২৬, থানা কালীঘাট। কলকাতা কর্পোরেশনের ৭৩ নম্বর ওয়ার্ড। এই ওয়ার্ডেরই বাসিন্দা ও ভোটার খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি এবং ভাইপো সাংসদ অভিষেক ব্যানার্জি। এই ঠিকানায় ৩ কাঠা ৩ ছটাক ১৪ বর্গফুটের নির্মাণ সহ জমি। গ্রাউন্ড ফ্লোরের স্ট্রাকচার ১৭১০ বর্গফুট। প্রথম তলা ১৫০০ বর্গফুটের, দ্বিতীয় তলা ১৫০০ বর্গফুটের, তৃতীয় তলা ৫৬৬ বর্গফুটের এবং ৬৮৩ বর্গফুটের ছাদ। জনৈক সেন পরিবারের সম্পত্তি। এই গোটা সম্পত্তি কিনে নেন দু’জনে। তাও বাজারদরের অর্ধেকের কম দামে।
ক্রেতার নাম মনজিৎ সিং ওরফে জিট্টি ভাই। দ্বিতীয় জনের নাম কাজরী ব্যানার্জি। তাঁদের যৌথ সম্পত্তি হিসাবেই রয়েছে নথি। কাজরী ব্যানার্জি বর্তমানে ৭৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর। মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের গৃহবধূ, মুখ্যমন্ত্রীর করিৎকর্মা ভাই কার্তিক ব্যানার্জির স্ত্রী।
কয়লা পাচারকাণ্ডে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে আগামী সপ্তাহেই দিল্লিতে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা ইডি’র দপ্তরে তলব করা হয়েছে চক্রবেড়িয়া লেনের বাসিন্দা, তৃণমূলের হিন্দি সেলের পদাধিকারী মনজিৎ সিং গ্রেওয়াল ওরফে জিট্টি ভাইকে।
বুধবার ইডি’র তরফে রীতিমতো বিবৃতি দিয়ে জানানো হয়েছিল যে এক অতি প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি (‘হাইলি ইনফ্লুয়েন্সিয়াল পলিটিক্যাল পার্সন’) তাঁর ঘনিষ্ঠ মনজিৎ সিং গ্রেওয়াল ওরফে জিট্টি ভাইয়ের মাধ্যমে কয়লা পাচারের টাকা নয়ছয় (লন্ডারিং) করার চেষ্টা চালাচ্ছে। কয়লা পাচারে মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ যার বিরুদ্ধে, যার বিরুদ্ধে এক প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার কালো টাকা সাদা করা, লন্ডারিংয়ের অভিযোগ, খোদ তাঁর সঙ্গেই যৌথ সম্পত্তি মমতা ব্যানার্জির ভাইয়ের স্ত্রীর, তাও আবার সেই হরিশ মুখার্জি রোডে, অভিষেক ব্যানার্জির বাড়ি লাগোয়া।
জনৈক সেন পরিবারের কাছ থেকে এই সম্পত্তি মাত্র ২৪ লক্ষ ৫০ হাজার টাকায় কিনে নিয়েছিলেন জিট্টি ভাই ও কাজরী ব্যানার্জি। ছয় দফায় পে-অর্ডারের মাধ্যমে এই টাকা দেওয়া হয়েছিল। যদিও সেই সম্পত্তির দলিলেই উল্লেখ রয়েছে সম্পত্তির তৎকালীন বাজার মূল্য ছিল ১কোটি ১৮ লক্ষ ৯৫ হাজার ৪৮১টাকা। সেই সম্পত্তি কেনার সময় স্ট্যাম্প ডিউটি দিতে হয়েছে ৮লক্ষ ৩২হাজার টাকা। অথচ ১ কোটিরও বেশি মূল্যের সম্পত্তি মাত্র সাড়ে ২৪ লক্ষ টাকায় দখলে নিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর ভাই কার্তিক ব্যানার্জির স্ত্রী, জিট্টি ভাইকে সঙ্গে নিয়ে। এখন সেই ঠিকানায় একটি থ্রি স্টার হোটেল।
এই বিনিয়োগের তথ্যও খতিয়ে দেখছে ইডি।
কিন্তু তার থেকেও আশ্চর্যের হলো অপরাধের বৃত্তে থাকা, মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগ ওঠা ব্যক্তির সঙ্গেই মুখ্যমন্ত্রীর পরিবারের সদস্যার যৌথ সম্পত্তি! এমনকি খোদ মুখ্যমন্ত্রীর ফেসবুক পেজ থেকেই ২০২১ সালের ৪ অক্টোবর একটি লাইভ করা হয়েছিল। তাতে দেখা যাচ্ছে হরিশ মুখার্জি রোডের একটি গুরুদ্বারে মুখ্যমন্ত্রীর পাশেই রয়েছেন এই জিট্টি ভাই।
এই মনজিৎ সিং ওরফে জিট্টি ভাই, যাকে ইডি এবার দিল্লিতে তলব করেছে, তার সঙ্গে কার্তিক ব্যানার্জির যোগাযোগ গোটা কালীঘাট, ভবানীপুর চত্বর জানে। মূলত ব্যবসায়িক সম্পর্ক। এই জিট্টি ভাইকে তৃণমূলের ভোটের সময়ও সক্রিয়ভাবেই দেখা যায়, ভোটের খরচেরও অনেক দায়িত্ব নেন তিনি। শুধু ৭৩ নম্বর অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রীর নিজের ওয়ার্ডে এই জিট্টি ভাইয়ের তিনটি হোটেল রয়েছে, পাশের ৭০ নম্বর ওয়ার্ডে রয়েছে দুটি হোটেল। শরৎ বসু রোডে ‘জয় হিন্দ ধাবা’ তাঁর প্রথম হোটেল। ভিনরাজ্যেও একাধিক সম্পত্তি মিলেছে জিট্টি ভাইয়ের। ৩নম্বর রানি শঙ্করী লেনে কার্তিক ব্যানার্জির ঠিকানাতেও রয়েছে তাঁর হোটেল। ভারতী সিনেমা হলের পাশে ‘জয় হিন্দ ব্যাঙ্কোয়েট হল’ও জিট্টি ভাইয়ের।
সম্প্রতি ইডি খবর পেয়েছিল শরৎ বসু রোডে চক্রবেড়িয়ায় ‘সালাসার গেস্ট হাউস’ নামে একটি অতিথিশালা কিনেছেন মনজিৎ সিং ওরফে জিট্টি ভাই। বুধবারই সেই সম্পত্তির রেজিস্ট্রি হয় আলিপুরে সাব রেজিস্ট্রারের অফিসে। ঐ গেস্ট হাউসের বাজারমূল্য এখন ১২কোটি টাকা। ৯ কোটি টাকা নগদ দিয়ে সেই সম্পত্তি কেনা হয়। যদিও খাতায়-কলমে দলিলে সম্পত্তির মূল্য মাত্র ৩ কোটি টাকা দেখানো হয়। আর সেই নগদ টাকা লেনদেনের খবর মিলতেই ইডি হানা দিয়েছিল ৫এ, আর্ল স্ট্রিট ঠিকানায় গজরাজ গ্রুপ সংস্থার অফিসে যেখান থেকে মেলে নগদ ১কোটি ৪০ লক্ষ টাকা ।
তদন্তকারী সংস্থার দাবি, প্রভাবশালী এক নেতার কয়লা পাচারের কালো টাকা এর মাধ্যমেই শহরে বিনিয়োগ হয়ে বেমালুম সাদা হচ্ছে, খোদ মুখ্যমন্ত্রীর কেন্দ্রেও কয়লা পাচারের টাকা বিনিয়োগ হচ্ছে।
জিট্টি ভাইয়ের সঙ্গে যৌথ সম্পত্তি কেনার নথিতে কাজরী ব্যানার্জির যে ঠিকানা উল্লেখ করা হয়েছে তা হলো ৩০,বি হরিশ চ্যাটার্জি স্ট্রিট!
তা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনের ঠিকানা।
গত কলকাতা কর্পোরেশন নির্বাচনের হলফনামাই জানাচ্ছে, তাঁর কালীঘাটের আশেপাশে ৮টি জমি, ফ্ল্যাট। এরই মধ্যে রয়েছে কয়লা পাচারকাণ্ডে তদন্তের মুখে পড়া জিট্টি ভাইয়ের যৌথ সম্পত্তি। তবে এখানেও গোলমেলে হিসাব। হলফনামায় জানানো হয়েছে, ২০৪ হরিশ মুখার্জি রোডের সম্পত্তির দাম ২২লক্ষ ৭৫ হাজার ৬৯ টাকা ৫০ পয়সা। অথচ সেই সম্পত্তির দলিল জানাচ্ছে, বাজার মূল্য যেখানে ১ কোটি ১৮লক্ষের বেশি সেখানে তা কেনা হয়েছিল মাত্র ২৪ লক্ষ টাকায়!
এদিকে, বৃহস্পতিবারই ইডি’র তরফে দাবি করা হয়েছিল গজরাজ গ্রুপের কর্ণধার বিক্রম সাকারিয়ার সঙ্গেই রাজ্যের এক ‘মন্ত্রী’র কালো টাকা লেনদেনের অবৈধ আঁতাত রয়েছে। মন্ত্রীর কালো টাকা হ্যান্ডেলিংয়ের কাজ করেন তিনি।
ইডি’র একটি সূত্রের দাবি, দক্ষিণ কলকাতার সেই মন্ত্রীর ভূমিকা সম্পর্কে একাধিক তথ্য হাতে এসেছে। তাঁকেও মানি লন্ডারিংয়ের তদন্তেই দ্রুত তলব করে জেরার করার প্রস্তুতিও শুরু হয়েছে।
Comments :0