প্রতীম দে
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ১৭ অক্টোবর ১৯২০ সালে তাসখন্দে গঠিত হয়েছিল। কমিউনিস্টদের উপর প্রথম আক্রমণ নেমে আসে পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলার মাধ্যমে। মুহম্মদ আকবর খান, নামে ২৬ বছর বয়সী এক ব্যক্তি, যিনি সম্ভবত রেড আর্মিতে কাজ করেছিলেন, ব্রিটিশরা তাকে গ্রেপ্তার করে এবং সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয় তাঁকে। তাসখন্দে পার্টি তৈরি হওয়ার পর ভারতের মাটিতে যখন ধীরে ধীরে কমিউনিস্ট পার্টি সংগঠন তৈরি করতে থাকে তখন থেকেই ব্রিটিশরা সজাগ হতে শুরু করে।
১৯২১ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের গুরুত্বপূর্ণ আমেদাবাদ অধিবেশন চলাকালীন, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রস্তাবনা পাঠ করা হয়েছিল। বলা হয়, ‘‘কংগ্রেস যদি বিপ্লবের নেতৃত্ব দেয়, যা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনকে দৃঢ় করছে, তবে এটিকে নিছক বিক্ষোভ এবং সাময়িক উৎসাহে বিশ্বাস করা উচিত নয়। এটি অবিলম্বে ট্রেড ইউনিয়নগুলির দাবিগুলিকে নিজস্ব দাবিতে পরিণত করুক; এটা কিষাণ সভার কর্মসূচিকে নিজের কর্মসূচিতে পরিণত করুক, এবং শীঘ্রই এমন সময় আসবে যখন কংগ্রেস কোনও বাধার সামনে থামবে না, এটি সমগ্র জনগণের অপ্রতিরোধ্য শক্তি দ্বারা সমর্থিত হবে যারা সচেতনভাবে তাদের বস্তুগত স্বার্থের জন্য লড়াই করছে।’’
এটি ছিল জাতীয় কংগ্রেসের আমেদাবাদ অধিবেশনে যেখানে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে মৌলানা হসরত মোহানি এবং স্বামী কুমারানন্দ ব্রিটিশ শাসন থেকে পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে প্রস্তাব পেশ করেছিলেন। সেই সময় গান্ধী এই পূর্ণ স্বাধীনতার বিরোধীতা করলেও এই ঠিক আট বছর বাদে কংগ্রেস পূর্ণ স্বরাজের দাবি তোলে। ১৯২৯ সালের ডিসেম্বরে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি, অসহযোগ আন্দোলনের ব্যাপক জনপ্রিয় তরঙ্গের সাথে, একটি সম্ভাব্য সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী শক্তি হিসেবে সংগঠিত শ্রমিক শ্রেণির প্রশ্নকে সামনে নিয়ে আসে। মাদ্রাজ লেবার ইউনিয়ন ১৯১৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এই সংগঠনের নেতা এম সিঙ্গারাভেলু, যিনি পরে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হয়েছিলেন, ১৯২৩ সালে ভারতে প্রথম মে দিবস উদযাপন করেছিলেন। বলা হয় যে কমরেড সিঙ্গারাভেলু, লাল পতাকার না থাকায়, মেয়ের লাল শাড়ি ছিঁড়ে পতাকা তৈরি করেছিলেন।
একইভাবে, কলকাতায় মুজফ্ফর আহম্দ, বোম্বেতে, আজকের মুম্বাইয়ে, এস এ ডাঙ্গে এবং লাহোরে গোলাম হুসেন, যাঁরা সবাই কমিউনিস্ট পার্টির নেতা হয়েছিলেন, নিজ নিজ শহরে শ্রমিক সংগঠিত করতে এবং কমিউনিস্ট ধারণা ছড়িয়ে দিতে শুরু করেছিলেন।
কানপুর বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা ১৯২৪ সালে বেশিরভাগ নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বলে এই কাজ বন্ধ থাকে সাময়িক। ১৯২৫ সালের ডিসেম্বরে কানপুরে প্রকাশ্যে কমিউনিস্টদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়ে। সেই সমাবেশের বক্তব্য ছিল শ্রমিক ও কৃষকদের প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, উৎপাদন ও বন্টনের মাধ্যমের সামাজিকীকরণের উপর ভিত্তি করে, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য থেকে ভারতকে মুক্ত করা। ঘোষণাপত্রের একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিবৃতিতে বলা হয়েছিল যে ‘কোনও সাম্প্রদায়িক সংগঠনের সদস্যকে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য করা হবে না।’ এটি ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে, সম্ভবত সাম্প্রদায়িক সংগঠনের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের বাদ দেওয়ার জন্য কোন তাৎপর্যপূর্ণ প্রথম রাজনৈতিক দল হিসাবে চিহ্নিত করেছে।
১৯৪০ সাল থেকে স্বাধীনতা পর্যন্ত, যখন বিশ্বে ফ্যাসিবাদ এবং সাম্প্রদায়িকতার যুগল বিশ্ব ও ভারতীয় রাজনীতিতে তাণ্ডব চালাচ্ছে। কংগ্রেসের বেশিরভাগ জাতীয় নেতৃত্ব যখন জেলে তখন কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্ব দেয় এবং আহমেদাবাদ এবং জামশেদপুরে ধর্মঘট সংগঠিত করে। কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস ১৯৪২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বরকে দমন-পীড়ন বিরোধী দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানায়। বাংলার দুর্ভিক্ষের সময় কমিউনিস্টদের কাজ আজও ইতিহাসে স্মরণীয়।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি শস্য মজুতের বিরুদ্ধে মিছিলের আয়োজন করেছিল, রেশনের দোকান খুলেছিল এবং ক্ষুধার্ত শিশুদের জন্য দুধ বিতরণ করে এমন কমিউনিটি রান্নাঘরের আয়োজন করেছিল। রাজশাহী বিভাগে কৃষিঋণ পরিশোধ স্থগিত করার দাবিতে কৃষক সমিতির আয়োজন করেছে দলটি। কলকাতায়, কমিউনিস্টরা বিধানসভার সামনে একটি বিশাল বিক্ষোভের আয়োজন করেছিল, যেখানে কয়েক হাজার মহিলা ভাতের দাবিতে একত্রিত হয়েছিল। এই সময়কালে নারী ও ছাত্ররা কমিউনিস্ট আন্দোলনের মূল ভিত্তি তৈরি করেছিল। শুধুমাত্র বাংলাতেই ছাত্র সংগঠন এআইএসএফ’র সদস্য সংখ্যা ছিল ২০ হাজারের বেশি। বাংলায় এই সংগঠনে বাম কমিউনিস্ট ছাত্রদের প্রভাব ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির বহুমুখী কর্মকাণ্ড, প্রবল প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, পার্টির সদস্য সংখ্যায় একটি তাৎপর্যপূর্ণ বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত করে। ১৯৪২ সালের জুলাই মাসে চার হাজার সদস্য নিয়ে শুরু হয় পথ চলা। ১৯৪৩ সালের মে নাগাদ তা বেড়ে হয় ১৫ হাজার এবং ১৯৪৬ সালে ৫৩ হাজারের এর উপরে পৌঁছেছিল।
স্বাধীনতার প্রাক্কালে, যখন সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ভয়াবহ আকার ধারণ করে, কমিউনিস্টরা ব্যক্তিগত এবং রাজনৈতিক উভয় ক্ষেত্রেই দাঙ্গা আক্রান্তদের সাহায্য করেছিল এবং ত্রাণ শিবির সংগঠিত করেছিল।
সিপিআই(এম) সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি রাজ্যসভার সাংসদ থাকাকালিন একবার বলেছিলেন, আন্দামান সেলুলার জেলে যাদের নাম লেখা রয়েছে তাদের অধিকাংশ কমিউনিস্ট পার্টির সাথে যুক্ত হন।
পিসি যোশী। কমিউনিস্ট পার্টির প্রথম সাধারণ সম্পাদক। ২২ বছর বয়সে মীরাট মামলায় গ্রেপ্তার জন। ছয় বছর জেলে থাকার পর মুক্তি পান।
সুবোধ রায়। মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের কনিষ্টতম সদস্য। ৬ বছর বন্দি ছিলেন সেলুলার জেলে। জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সিপিআই(এম) এ যোগদান। দীর্ঘদিন রাজ্য কমিটির সদস্য ছিলেন।
কল্পনা দত্ত। চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের আর এক উজ্জ্বল নাম। তিনিও অজীবন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন।
গণেশ ঘোষ।চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুন্ঠনের সদস্য। প্রথমে কমিউনিস্ট পার্টি। তারপর সিপিআই(এম)। বেলগাছিয়া থেকে একাধিকবার জয়ী হয়েছেন তিনি।
লক্ষ্মী সায়গল। আজাদ হিন্দ ফৌজের রাণী ঝাঁসি রেজিমন্টের নেতৃত্ব দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। তারপর সিপিআই(এম)’র সদস্য। দীর্ঘদিন রাজ্যসভার সাংসদ ছিলেন।
হরেকৃষ্ণ কোঙার। রাজ্যের প্রাক্তন মন্ত্রী। যার নেতৃত্বে হয় ভূমি সংস্কার। ১৮ বছর বয়সে প্রথম জেলে যান ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের জন্য। তারপর ছাড়া পেয়ে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য। আবার জেল হয় তার। ১৯৩৫ সালে সেলুলার জেলে কমিউনিস্টদের একত্রিত করেন তিনি। সিপিআই(এম)’র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
বিজেপি বার বার বলে কমিউনিস্টরা বলেছিল ‘এই আজাদি ঝুটা’। কমিউনিস্ট পার্টি যদিও ঘোষণা করেই সেই অবস্থান সংশোধন করে। কিন্তু আজাদির দাবি আসলে ছিল শোষণমুক্তির লক্ষ্যে। কৃষক, শ্রমিকরা আজও শোষনের শিকার। কৃষি বিল, শ্রম কোডের মাধ্যমে তাদের শোষণ করা হচ্ছে, কমিউনিস্ট পার্টি এই শোষণের বিরুদ্ধে আজাদির লড়াই আজও লড়ছে। জাত, ধর্মের বিভাজনকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে, স্বাধীনতার লড়াইয়ের উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে।
Comments :0