coromandel express accident

‘জ্ঞান হতে দেখি মৃতদের স্তূপে পড়ে আছি’

জাতীয়

 

‘‘জ্ঞান ফিরে পেয়ে দেখি মৃতদেহর স্তূপের উপরে পড়ে আছি আমি। হাতে-পায়ে অসহ্য যন্ত্রণা। কোনও রকমে বাইরে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছি। আলো নেই, চারিদিকে ভাঙা কাচের টুকরো। অন্ধকার। তার মধ্যেই একটি হাত এগিয়ে আসে আমার দিকে। আমাকে চ্যাংদোলা করে স্থানীয়রা তুলে দেয় একটি মোটরভ্যানে। আর কিছু মনে নেই।’’ দুঃসহ অভিজ্ঞতার কিছু কথা বলতে বলতেই কান্নায় ভেঙে পড়েন নদীয়ার পলাশীর বাসিন্দা আমেদ শেখ। তবে তিনি তাঁর সঙ্গে থাকা দুই সঙ্গীর মধ্যে এক জনের খোঁজ এখনও পাননি। বালেশ্বর জেলা হাসপাতালের বেডে শুয়ে বলেই যাচ্ছিলেন, ‘‘বোধহয় ও আর বেঁচে নেই।’’ 
আমেদ শেখ, দিলবার, হাফিজ, সোনু শেখ কেরালায় রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। সোনু শেখ নিখোঁজ। তাঁরা চার জন চেন্নাই যাচ্ছিলেন করমণ্ডল এক্সপ্রেসে। সেখান থেকে কেরালা যাবেন— এমনই ছিল পরিকল্পনা। কিন্তু পথে এমন দুর্ঘটনা। তাঁদের মতোই মালদহের আতিকুর, জামির আক্তার, আমির সেহেল, ইউনুস কেরালায় একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করেন। ইউনুস এখনও নিখোঁজ। বাকিরা গুরুতর আহত। তেমনই বীরভূমের শান্তিনিকেতনের বাসিন্দা ধনঞ্জয় কোড়ার বুকে গুরুতর আঘাত। তিনি এক প্রকার সঙ্গাহীন। 
বালেশ্বরের এই হাসপাতাল ছাড়াও ভুবনেশ্বর, ভদ্রক, কটক, খুরদা হাসপাতালেও দুর্ঘটনায় আহতরা চিকিৎসাধীন রয়েছেন। বালেশ্বরের হাসপাতালে দক্ষিণ দিনাজপুর, নদীয়া, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, হাওড়া, পূর্ব মেদিনীপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর, ঝাড়গ্রাম, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, উত্তর চব্বিশ পরগনার বাসিন্দারা আহত অবস্থায় চিকিৎসাধীন রয়েছেন বেশি। হাসপাতালের একটি সূত্র মারফত জানা গিয়েছে, এখানে ৪০০-র বেশি আহত চিকিৎসাধীন। এঁদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দার সংখ্যা বেশি।
হতাহতদের ৯০ শতাংশই পরিযায়ী শ্রমিক। বালেশ্বর জেলা হাসপাতাল যেন শ্মশানপুরী। সারিবদ্ধ মৃতদেহ। স্বজন হারানোর কান্নার দুঃসহ চিৎকার। স্থানীয় বাসিন্দা, চিকিৎসক, সবাই জীবনপণ লড়াই করছেন, যদি শেষ মুহূর্তেও কিছু মানুষকে বাঁচানো যায়। যেদিকে চোখ যাচ্ছে, সেদিকেই আহতদের ভিড়। ওডিশার বাহানাগা এলাকার দুর্ঘটনাস্থল থেকে সবথেকে কাছের বালেশ্বর জেলা হাসপাতাল। দূরত্ব ৩১ কিমি।
ভয়াবহ ট্রেন দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ২৮৮ বলে সরকারি সূত্রের খবর।
যাঁরা প্রাণ নিয়ে দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেন থেকে বেরোতে পেরেছেন, তাঁদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে দুঃসহ সেই স্মৃতি। সেই যাত্রীদের মধ্যেই একজন পশ্চিম মেদিনীপুরের গোপাল দাস। দুর্ঘটনার পর পেরিয়েছে অনেকটা সময়। কিন্তু আতঙ্কের ঘোর কাটিয়ে বেরিয়ে আসতে পারেননি তিনি। পেশায় দিনমজুর এখনও করমণ্ডল শালিমার এক্সপ্রেসে চেন্নাই যাচ্ছিলেন। শুক্রবার সন্ধ্যায় তিনি বন্ধুদের সঙ্গে খাচ্ছিলেন। ‘‘প্রবল ঝাঁকুনি। তারপর সব অন্ধকার। ১০ মিনিট পর কান্নার আওয়াজ। আমরা বুঝতে পারলাম, ট্রেনের কামরা উলটে গেছে।’’ দুর্ঘটনার কিছু পরেই তাঁকে উদ্ধার করেন উদ্ধারকর্মীরা। বালেশ্বরের হাসপাতালের বেডে শুয়ে অভিজ্ঞতার কথা বলছিলেন তিনি। 
দুর্ঘটনায় আহত আরেক যাত্রী পূর্ব মেদিনীপুরের সুশান্ত রায় বললেন,  ‘‘হাত-পায়ের টুকরোর সঙ্গে পড়ে আছে রক্ত, কাঁচের টুকরো। আমার সিটের নিচে আর একটা সিট ঢুকে গিয়েছিল।’’ দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেন থেকে উদ্ধার হওয়া আর এক যাত্রী বললেন, ‘‘যখন ট্রেন লাইনচ্যুত হয়, তখন আমি ঘুমোচ্ছিলাম। প্রায় ১০-১৫ জন যাত্রী আমার উপর পড়ে যান। আমি যখন কামরা থেকে বেরিয়ে আসি, তখন চারদিকে ছিন্ন দেহাংশ পড়ে আছে। কোথাও হাত, কোথাও পা পড়ে রয়েছে। এক জন যাত্রীর মাথা কামরার নিচে ঢুকে গিয়েছিল।’’
বিহার থেকে ১২ জনের একটি দল চেন্নাই যাচ্ছিল চিকিৎসা করাতে। তাঁদের ৪ জন মৃত। পূর্ব মেদিনীপুরের কোলাঘাট, হলদিয়া, ভগবানপুর, কুলবেড়িয়া, শ্রীরামপুর এলাকার বাসিন্দারা চিকিৎসা করাতে যাচ্ছিলেন। তাঁদের তিন জনকে মেদিনীপুর হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
নন্দকুমারের খঞ্চির এক আহত ব্যক্তি রবীন্দ্রনাথ জানা বাড়ি ফিরেছেন। ভগবানপুরের শ্যাম সুন্দর দাস, কোলাঘাট ব্লকের নামালবার গ্রামের তিন জন নিখোঁজ। হলদিয়া ব্লকের বাড়বাসুদেবপুর গ্রামের ৭ জন করমণ্ডল এক্সপ্রেসে চেন্নাই যাচ্ছিলেন, ৪ জন বাড়ি ফিরেছেন, ২ জন কটকে চিকিৎসাধীন আছেন। বাকি এক জনের হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। এঁরা প্রত্যেকেই চিকিৎসা করাতে যাচ্ছিলেন চেন্নাই।


 

Comments :0

Login to leave a comment