জয়ন্ত সাহা: কোচবিহার
রবিবার ইনসাফ যাত্রা হাঁটবে সাগরদিঘি থেকে শেরপুর। কোচবিহার থেকে যাবার পথে প্রতিদিন গড়ে ৪টি সভা আর গ্রাম-শহরের মাঝখান দিয়ে প্রতিদিন গড়ে ২৫ কিমি হেঁটে যেতে যেতে কতবার থেমেছে সব হিসেব রাখে বকসীরহাটের যুবক ইউসুফ আলি। বিশাল পুলিশ বাহিনী নেই। মিডিয়ার ক্যামেরার ফ্লাশের ঝলকানি তেমন চোখে পড়েনি। হাজারো মানুষের চোখ ছিল এই মিছিলের প্রতি। জমির লড়াইয়ের ঘাঁটি, বিছিন্নতাবাদী কামতাপুরি, কেএলও জঙ্গীদের রুখতে কোচবিহার থেকে শুরু হওয়া ইনসাফ যাত্রা শক্তি জুগিয়েছে।
বক্সীরহাটের ইউসুফের মতই দিনহাটার শুভ্রালোক দাস, অভীক সরকার, হলদিবাড়ির কৃত্তিবাস রায়ের মত যুবকরা ৩ নভেম্বর থেকে একদিনও বিরাম না নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় খবর পোস্ট করেছে। চলছে ব্রিগেড সমাবেশের জন্য অর্থ সংগ্রহ। কোচবিহার থেকে ইনসাফ যাত্রা শুরুর সময়ে আওয়াজ উঠেছিল, কৃষকের ফসলের লাভজনক দাম চাই, নদী ভাঙন থেকে চাষের জমি আর কৃষকের ভিটে বাঁচাও। পরিযায়ী শ্রমিকদের ঘরে ফেরাও, ওদের কাজ দাও।
যেদিন ইনসাফ যাত্রা শুরু হয় তার আগের দিনই মেখলিগঞ্জ মহকুমার জামালদহের পরিযায়ী শ্রমিকের কফিন বন্দি দেহ ফিরেছিল। ডুয়ার্স ছাড়িয়ে দুই দিনাজপুর, মালদা, মুর্শিদাবাদ চলে গেলেও পরিযায়ী শ্রমিকের ভিন রাজ্যে কাজ করতে করতে মারা যাওয়া কিংবা প্রতারিত হবার খবর আসছে প্রতিদিন। আর তাই শীতলকুচির গোলেনাওহাটির দীনবন্ধু বর্মণ, পুঁটিমারির সমর বালা-রা শিলিগুড়ি পর্যন্ত ইনসাফ যাত্রায় অংশ নিয়ে ঘরে ফিরেও ইনসাফের লড়াইতেই এখনও অক্লান্ত যোদ্ধা।
জেলার গন্ডি ছাড়িয়ে আলিপুরদুয়ার কিংবা জলপাইগুড়ি ছাড়িয়ে আরো অনেক দূরে চলে গেলেও আলিপুরদুয়ারের সোনাপুরের সামান্য অটো চালক মিরান বর্মণ তাঁর স্ত্রীর ২৫ দিনের বকেয়া মজুরি আদায়ে ইনসাফের লড়াইয়ে জয়ের খবর পেতে। শুক্রবার ফোনে জানান ৭ জানুয়ারির ব্রিগেডের সমাবেশে স্ত্রীকে নিয়ে সেও হাজির থাকতে চায়।
আলিপুরদুয়ারের কালকূট রাজাভাতখাওয়ার মত ৪২ বনবস্তি আর ৬২ চা বাগানের বেকার যুবকেরা অন্যতম সেনানী। ইনসাফ যাত্রাকে শিশারগোড়ে স্বাগত জানিয়েছিলেন,চা বাগান আন্দোলনের প্রবীণ নেতা পঞ্চায়েত ওঁরাও, কমল মিঞ্জ,নিশ্চন ঝা-রা।
শুক্রবার পঞ্চায়েত ওঁরাও টেলিফোনেই জানান, আমি তো বড় ফোন ব্যবহার করি না, তবুও বাগানের ছোটদের ফোনে প্রতিদিন দেখি ইনসাফ যাত্রা কতদূর এগলো। চা বাগানের শ্রমিকদের ন্যুনতম মজুরির দাবিতে ৭ দিনের লং মার্চ করেছিলেন। সে দাবি
আজও মেটেনি। ২০% বোনাসের দাবিও অধরা রয়ে গেছে।এরই মধ্যে নতুন করে আলিপুরদুয়ারে ৫বাগান বন্ধ হয়েছে।
বাগানের পর বাগান জুড়ে এখন চলছে ব্রিগেড সমাবেশের প্রচার। আলিপুরদুয়ার ছেড়ে ইনসাফ যাত্রা বিভিন্ন জেলা ঘুরে ব্রিগেডের পথে এগিয়ে গেলেও কোচবিহারের যুব নেতা সুধাংশু প্রামাণিক কিংবা আলিপুরদুয়ারের রাজু ব্যানার্জিদের এখন দম ফেলবার ফুরসত নেই। বুথ ধরে ধরে কোচবিহারে যেমন চলছে তালিকা প্রস্তুতের কাজ তেমনি আলিপুরদুয়ারের বনবস্তি আর চা-বাগানের মহল্লায় চলছে প্রতিদিন ব্রিগেড যাবার প্রস্তুতির কাজ। কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার ছেড়ে ইনসাফ যাত্রা যত সামনের দিকে এগিয়েছে মিছিলে এসেছে নতুন নতুন মুখ। পুরানো দাবির সাথে জুড়েছে নতুন নতুন দাবি।
যৌবনের সাথে গলা মিলিয়েছিল ডুয়ার্সের শ্রমজীবীরাও। ইনসাফ যাত্রাকে বানারহাটে স্বাগত জানিয়ে চা বাগান আন্দোলনের নেতা ও নাগরাকাটার প্রাক্তন বিধায়ক সুখমইত ওঁরাও আদিবাসী লোকগান শুনিয়েছিলেন, সেই সুখমইত ওঁরাওয়ের কথায়,ইনসাফের জন্য যে লড়াই যুবরা করছে, আমি,আমরা তার সঙ্গী। জলপাইগুড়ি থেকে ইনসাফ যাত্রা চলে গেলেও সেখানকার যুবনেতা প্রদীপ দে ও তাঁর বাহিনী এখন দিন রাত এক করে ফেলছে। সমাবেশকে সফল করতে। জেলায় ১৮৭২ টি পরিবারকে দেওয়া হয়েছে মাটির ভাঁড়। তারা সেখানে অর্থ জমাবে। সেই অর্থ পৌঁছে যাবে কলকাতায়। চা-বাগানের শ্রমিকদের সামান্য মজুরি। তারাও ৫০০ পরিবারকে ভাঁড় দিয়েছে।
সমাবেশে যাবার জন্য ও ব্রিগেড সমাবেশের খরচ তুলতে ইউনিটের যুবরা গ্রামে অন্যের জমিতে কাজ করে মজুরির টাকা তুলে দিচ্ছে ফান্ডে। ইনসাফের জন্য গত ৩ নভেম্বর সংগঠনের প্রতিষ্ঠা দিবসে যে যাত্রা শুরু হয়েছে সেটা থামবে ব্রিগেডে গিয়ে।
‘ইনসাফ যাত্রা’কে ঘিরে দার্জিলিঙ জেলায় উৎসাহ, উদ্দীপনা যেমন ছিল, এখন ব্রিগেড সমাবেশকে ঘিরে সেই উদ্দীপনা যেন দ্বিগুণ হয়েছে। এমনটাই বলছেন, যুব আন্দোলনের প্রাক্তনী ও গণ আন্দোলনের নেতা জীবেশ সরকার। তিনি বলেন, প্রতিদিন যত মানুষ ব্রিগেডের সমাবেশে যাবার জন্য বিভিন্ন এলাকা থেকে ফোন করে তালিকা জমা দিতে চাইছে, তাতে আগ্রহী সবাইকে সমাবেশে নিয়ে যাওয়াই যুব নেতৃত্বের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠবে।
Comments :0