নীলাদ্রি সেন
অবিসংবাদি মার্কসবাদী চিন্তাবিদ, সুলেখক, বক্তা এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম অগ্রণী নেতা কমরেড হায়দর আকবর খান রনো প্রয়াত হয়েছিলেন গত বছর ১০ মে ঢাকায় ৮১ বছর বয়সে। কমরেড রনোর সমগ্র জীবন কেটেছে দেশ ও শ্রমজীবী মানুষের স্বার্থে নিরবিচ্ছিন্ন সংগ্রাম ও আত্মত্যাগে। এরজন্য বারবার তাঁর জীবন বিপন্ন হয়েছে। দীর্ঘ সময় কাটাতে হয়েছে কারান্তরালে। কিন্ত মতাদর্শে অনড় কমরেড রনোকে কমিউনিজমের পথ থেকে কখনো বিচ্যুত করা যায়নি।
শৈশব ও ছাত্রজীবন
কমরেড হায়দর আকবর খান রনোর জন্ম ১৯৪২ সালের ৩১ আগস্ট। তাঁর পিতার বাসস্থান বাংলাদেশের নড়াইলের বরশালা গ্রামে। আর মায়ের বাড়ি নড়াইলের মির্জাপুর গ্রামে। দাদামশাই বিশিষ্ট রাজনীতিক সৈয়দ নওশের আলির কলকাতার বাড়িতে জন্ম হয় কমরেড রনোর। তবে ছাত্রজীবনের শুরু বাংলাদেশেই। যশোর জিলা স্কুল, রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিতে তাঁর স্কুলজীবন কাটে। বরাবরই তিনি পরীক্ষায় ক্লাসে প্রথম হতেন। ১৯৬০ সালে ঢাকার নটরডম কলেজ থেকে তিনি আইএসসি উত্তীর্ণ হন। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা বিভাগে ভর্তি হন। এখানে ছাত্র আন্দোলনের কারণে কমরেড রনোকে জেলে যেতে হয়। তাই পদার্থবিদ্যার পাঠ তিনি সম্পুর্ণ করতে পারেননি। জেলবন্দি অবস্থাতেই তিনি আইনে স্নাতক হন। হাইকোর্টে ওকালতির অনুমতি পেয়েও এই পেশাতে তিনি যুক্ত হননি। শৈশবকাল থেকেই পিতার আগ্রহে তাঁর সাহিত্যপাঠের শুরু। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে সাহিত্য প্রতিযোগিতা ও বিতর্কে অংশ নিয়ে তিনি বহু পুরস্কার পান। পরবর্তী সময়ে একজন সুলেখক ও সুবক্তা হয়ে ওঠার এটাই ছিল তাঁর জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ সোপান।
ছাত্র আন্দোলনে রনো 
ষাটের দশকে কলেজে যখন ভর্তি হলেন, পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশে তখন টালমাটাল পরিস্থিতি। চলছে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের চোখরাঙানি। প্রকাশ্যে কোনও রাজনীতি করা নিষেধ। ছাত্র সংগঠনের কোনও চিহ্নমাত্র ছিল না। কমরেড রনো ও আরও কয়েকজন ছাত্রের আত্মগোপনে থাকা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি হয়। পার্টিতে সিদ্ধান্ত ছিল যেহেতু প্রকাশ্যে কাজ করা কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে সম্ভব নয় তাই ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলে সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যা নিয়ে ভর্তি হয়েছেন। কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে গোপনে সভা করে ঠিক করা হয় যে ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬২-র মিছিল দিয়ে শুরু হবে সামরিক শাসন বিরোধী ছাত্র আন্দোলন। ইতিমধ্যে  ৩১ জানুয়ারি বিশিষ্ট রাজনীতিক সর্বজন শ্রদ্ধেয় সৈয়দ সোহরাওয়ার্দি গ্রেপ্তার হলেন। সিদ্ধান্ত বদল করে প্রতিবাদে ১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হয়। ধর্মঘটের দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সভায় প্রথম সর্বসমক্ষে সামরিক শাসনের বিরোধিতা করে বক্তব্য রাখেন কমরেড রনো। মার্চ মাসে কমরেড রনো গ্রেপ্তার হয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে থাকাকালীন ছাব্বিশ সেলে গ্রেপ্তার হওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে তিনি একত্রে ছিলেন। এই বছরেই জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর কমরেড রনোর প্রত্যক্ষ উদ্যোগে অক্টোবরে সম্মেলনের মধ্য দিয়ে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের নতুনভাবে পথচলা শুরু হয়। সম্মেলন থেকে কমরেড রনো যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। পরের বছর ১৯৬৩ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন। কমরেড রনোর নেতৃত্বে ছাত্র আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলে ১৯৬৪ তে সবকটি সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠাতে তাঁর নামে হুলিয়া জারির বিজ্ঞপ্তি বেরোয়। আত্মগোপনে থাকলেও দু’মাস পরে তিনি গ্রেপ্তার হয়ে যান। গোয়েন্দা সংস্থার অফিসে কমরেড রনোকে টানা দু’দিন ধরে ঘুমোতে পর্যন্ত না দিয়ে, মাথার ওপরে থাকা জোরালো বৈদ্যুতিন আলোর নিচে বসিয়ে জেরা করা হয়। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত কারাবাসে ছিলেন তিনি।
শ্রমজীবী আন্দোলনে অবদান
জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর কমরেড রনো রেল ধর্মঘটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে আবার অল্প সময়ের জন্য গ্রেপ্তার হন। জেলে বসেই তিনি সিদ্ধান্ত নেন ছাত্র আন্দোলন থেকে অব্যাহতি নিয়ে শ্রমিকদের সংগঠিত করবার কাজে যুক্ত হবেন। ১৯৬৬ সালে কমরেড রনো টঙ্গীর শ্রমিক এলাকাতে শ্রমিক আন্দোলনে যুক্ত হন। তাঁর সহযোগী ছিলেন কাজি জাফর আহমেদ। ঢাকায় নিজের বাড়ি ছেড়ে কমরেড রনো টঙ্গীতে একটি শ্রমিক বস্তিতে এসে ওঠেন। টঙ্গীর এই শ্রমিক এলাকায় কমরেড রনোর নেতৃত্বে গড়ে ওঠা শক্তিশালী শ্রমিক আন্দোলনের বিস্ময়কর ব্যাপ্তি ঘটে। টঙ্গীর শ্রমিক বস্তির বাসিন্দারা তাঁদের প্রিয় নেতাকে সবসময় বুক দিয়ে আগলে রাখতেন। এই কারণে পুলিশের পক্ষেও টঙ্গীর ওই বস্তি থেকে কমরেড রনোকে তুলে নিয়ে আসার হিম্মত হয়নি। তবে পুলিশের গ্রেপ্তারি এড়াতে প্রায়ই তাঁকে আত্মগোপন করতে হয়েছে। ১৯৬৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে টঙ্গী থেকে কমরেড রনোর নেতৃত্বে শুরু হয় ঘেরাও আন্দোলন। পরবর্তীতে এই ঘেরাও আন্দোলন অন্যত্র বিস্তার লাভ করলে কমরেড রনো সর্বত্র ছুটে বেড়িয়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৯ - ৭০ এর মধ্যে দীর্ঘ দু’মাস ধরে চলা টেক্সটাইল শ্রমিকদের যে ধর্মঘটকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছিল, কমরেড রনো তাতেও সুদক্ষ নেতৃত্বের পরিচয় দেন। ১৯৭০ সালে কমরেড রনো পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। টঙ্গী থেকে শুরু করে সর্বত্র জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কমরেড রনোর দৃঢ় নেতৃত্ব অল্প সময়ের মধ্যে নতুন ধারার শ্রমিক আন্দোলনের অভুতপূর্ব ব্যাপ্তি ঘটাতে সক্ষম হয়।
মুক্তিযুদ্ধে কমরেড রনো 
আন্তর্জাতিক মতাদর্শগত বিরোধের ফলে ১৯৬৬ সালে গোপন কমিউনিস্ট পার্টি বিভক্ত হলে কমরেড রনো একটি কমিউনিস্ট গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হন। ১৯৬৯ সালে তিনি সহযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে গড়ে তোলেন কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমিটি। মুক্তিযুদ্ধে এই কমিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। ১৯৭১ সালে এই কমিটির নেতৃত্বেই বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকাতে মোট ১৪টি সশস্ত্র ঘাঁটি গড়ে তোলা হয়। এগুলোর মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা ও মুক্তিবাহিনীকে পরিচালনার মূল দায়িত্বে ছিলেন কমরেড রনো। শিবপুরের সশস্ত্র ঘাঁটি থেকে তিনি এবং কমরেড রাশেদ খান মেনন ঘুরপথে চলে যান টাঙ্গাইলের বিন্নাফুর গ্রামে। সেখানে তাঁরা মওলানা ভাসানির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ভাসানি কমরেড রনোকে খুবই স্নেহ করতেন। আওয়ামি পার্টিতে থাকলেও তিনি ছিলেন বামপন্থী মনোভাবাপন্ন এবং কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর নিবিড় যোগাযোগ ছিল। কিন্ত পরের দিনই ভাসানির বাড়িতে সামরিক বাহিনী হানা দেয়। এরপর মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অনেক চেষ্টা করেও মওলানা ভাসানির সঙ্গে তাঁরা আর যোগাযোগ করতে পারেননি। মুক্তিযুদ্ধে কমরেড রনোর গড়ে তোলা সশস্ত্র ঘাঁটিগুলোর প্রায় ৩০ হাজার মুক্তিযোদ্ধা বুক চিতিয়ে লড়াই করেন। শতাধিক শহীদ হন। কলকাতার বেলেঘাটায় ১৯৭১ সালের ১-২ জুন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-র পক্ষ থেকে বামপন্থীদের নিয়ে একটি সভা হয়। এখান থেকে বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। কমরেড রনো এই কমিটির ঘোষণাপত্র তৈরি করে পেশ করেন। এই বছরেই তিনি কাকাবাবু কমরেড মুজফ্ফর আহ্মেদসহ বামপন্থী নেতৃত্বের সঙ্গে পরিচিত হন। স্বাধীন বাংলাদেশে এরশাদের সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনের জন্য চারবার তাঁকে জেলে এবং সাতবার আত্মগোপনে যেতে হয়। ১৯৯০-এর এরশাদ বিরোধী গণঅভ্যুত্থানে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। আইয়ুব ও এরশাদের সামরিক জমানায় তাঁর বাড়িতে অন্তত পঞ্চাশবার মিলিটারি ও পুলিশ হানা দেয়। ১৯৭৯ সাল থেকে কমরেড রনো বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য ও ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত সাধারণ সম্পাদক থাকলেও ২০১০ সালে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের জন্য তিনি বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত হন। ২০২২ পর্যন্ত পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা ছিলেন।
  
কলমের ধার
সাহিত্য পাঠে কমরেড রনোর বিশেষ আগ্রহ ছিল। শৈশব-কৈশোরেই তিনি রবীন্দ্রনাথ, মাইকেল, নজরুল, শেকসপিয়র সহ অন্যান্য ধ্রুপদি সাহিত্য পাঠ করেন। মার্কসবাদে তাঁর অগাধ পাণ্ডিত্য ছিল। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় তাঁর অসংখ্য লেখা প্রকাশিত হয়েছে। ‘গণশক্তি’তেও তিনি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ লিখেছেন। তাঁর লেখা - শতাব্দী পেরিয়ে, মার্কসীয় অর্থনীতি, ফরাসি বিপ্লব, রবীন্দ্রনাথ শ্রেণি দৃষ্টিকোণ থেকে, দু’খণ্ডে বাংলা সাহিত্যের প্রগতির ধারা, কোয়ান্টাম জগৎ— কিছু বৈজ্ঞানিক ও দার্শনিক প্রশ্ন, দু’খণ্ডে পলাশী থেকে মুক্তিযুদ্ধ প্রমুখ বই উল্লেখযোগ্য। ২০২২ সালে তাঁকে বাংলা আকাদেমির পক্ষ থেকে সাহিত্য পুরস্কার প্রদান করা হয়।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও কমিউনিস্ট আন্দোলনে কমরেড রনোর অসামান্য ভূমিকা, আত্মত্যাগ তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। এখন  বাংলাদেশে নতুন করে গড়ে ওঠা রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে কমরেড রনোর দেখানো পথেই রক্তপতাকা উড্ডীন রেখে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি।
 
                                         
                                    
                                 
                                     
                                     
                                     
                                     
                                     
                                    
Comments :0