সঞ্জিত দে: ধূপগুড়ি
ফের একবার ভোটের লাইনে দাঁড়াবে ধূপগুড়ি। শেষ মুহূর্তের প্রচারে বিপুল উৎসাহ, উদ্দীপনা তৈরি হলেও ভোটের কয়েক ঘণ্টা আগে আশঙ্কা দানা বেঁধেছে সাধারণ মানুষের মধ্যে। মাত্র দু’মাস আগে পঞ্চায়েত নির্বাচনের অভিজ্ঞতাও স্মৃতিতে টাটকা। শাসক তৃণমূল নয়, তৃণমূলের হয়ে প্রকাশ্যে ভাড়া খাটা পুলিশের ভূমিকা নিয়েই তৈরি হয়েছে শঙ্কা।
গত পঞ্চায়েত নির্বাচনে ধূপগুড়ি ও বানারহাট থানার পুলিশের ভূমিকা দেখার পরে স্বাভাবিকভাবেই সাধারণ মানুষজন ভোটের কয়েক ঘণ্টা আগে প্রশ্ন করতে শুরু করেছেন- পুলিশ অবাধ ভোট চায় তো আদৌ? গত পঞ্চায়েতে এই বানারহাট থানার আইসি ও ধূপগুড়ি থানার আইসি কার্যত প্রকাশ্যেই তৃণমূলের হয়ে ভোট করতে নেমেছিলেন। তাঁরা এখনও দায়িত্বে।
আশঙ্কা যে অমূলক নয় তা টের পাওয়া গেল চা বলয়ের বানারহাটে। বানারহাটের মানুষজনের অভিযোগ, সোমবার সকালেই বেছে বেছে বিরোধীদের বিশেষত বাম ও কংগ্রেস সমর্থকদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হুমকি দিচ্ছে পুলিশ, ভোট দিতে হবে শাসক তৃণমূলকেই। আইসি কয়েকজনকে ডেকে বলেছে তৃণমূলকে ভোট দিতে হবে, এমনই অভিযোগ। ব্যবসায়ীদের উপরেও চাপ দেওয়া হচ্ছে।
এই বিধানসভায় বানারহাট ব্লকের ৫৬ টি বুথের মধ্যে ৬টিতে চা বাগানের শ্রমিকরা রয়েছেন এবং ৩ টি বনবস্তির বাসিন্দা আছেন। গ্রামীণ কৃষি এলাকা সহ চা বাগানের শ্রমিক, বামফ্রন্ট কর্মীরা সোমবার বিকালেই এলাকার বুথ অফিস সাজাতে ব্যস্ত হয়ে থাকেন।
গত কয়েকদিন ভোট প্রচারে রাজের এক ডজনের বেশি মন্ত্রী এসেছেন। বিজেপির’ও একাধিক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী আসেন। এই দুই দলের নেতা মন্ত্রী, অভিনেতা অভিনেত্রী মিলিয়ে ৮০ জন ‘স্টার ক্যাম্পনার’ হিসাবে প্রচার করেন। প্রচারের শেষ দিনে ফিরহাদ হাকিম আসেন। তিনি নাকি পুলিশের কাছ থেকে আগাম রিপোর্ট নিয়েছেন। পুলিশ প্রশাসনের কাছে ‘নির্দেশ’ এসেছে একেবারে শীর্ষ মহল থেকে!
এই ধূপগুড়ির মাটি সাক্ষী, বিচ্ছিন্নতাবাদের লড়াইয়ে একমাত্র রক্ত ঝরেছে বামপন্থীদেরই।
দু’দশক আগে কেএলও উগ্রপন্থী হামলায় ধূপগুড়িতে সিপিআই(এম) কার্যালয়ের ভিতরেই পার্টির নেতা, সংগঠকসহ পাঁচজন শহীদ হয়েছিলেন। গোটা রাজ্য রাজনীতি তোলপাড় হয় এই ঘটনায়। ২০০২সালের ১৭ আগস্ট। সেদিন শনিবার ছিল। সন্ধ্যা তখন ৬টা ৪৫মিনিট। অতর্কিতেই সেখানে চড়াও হয়ে উন্মত্তভাবে একে-৪৭ থেকে গুলি চালাতে শুরু করে কেএলও উগ্রপন্থীরা। মুহূর্তেই পার্টি দপ্তর হয়ে ওঠে বধ্যভূমি। পার্টির অফিসের ভিতরেই রক্তাক্ত অবস্থায় লুটিয়ে পড়েন একে একে পাঁচজন। রাজ্যের তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের আবেদনে কেন্দ্রীয় সরকার বাধ্য হয় প্রতিবেশী দেশ ভুটানে উগ্রপন্থী সন্ধানে তল্লাশি করতে। ভারত এবং ভুটানের যৌথ অভিযানে কেএলও’র প্রথম সারির কয়েকজন সে সময় ধরা পড়ে, যে সমস্ত উগ্রপন্থীরা ধরা পড়েছিল তাঁদের জেলে ঠিকানা হয়। তবে রাজ্যে তৃণমূল সরকার আসার পরে অভিযুক্ত একাধিকজন ছাড়াও পায়, তাদের অনেকেই এখন শাসকদলের নেতা বনে গেছেন।
মমতা ব্যানার্জির সরকার আসার পরে একাধিক কেএলও উগ্রপন্থী জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পরে বেমালুম তৃণমূলের নেতা বনে যায়। একসময়ের কামতাপুর আন্দোলনের নেত্রী মিতালি রায় ২০১৬ সালে তৃণমূলের টিকিটে ধূপগুড়ির বিধায়ক হন। সেই মিতালি রায় শনিবার অভিষেক ব্যানার্জির সভায় থাকার পরে রবিবার সকালে বিজেপি-তে যোগ দেন।
এই ঘটনার পরে এই মুহূর্তে বাইরে থাকা প্রাক্তন উগ্রপন্থীদর কয়েকজন বিজেপি’র দিকে যাচ্ছেন বলে জানা গেছে। শুধু তাই নয় এমন এক মুখ ইতিমধ্যে বিজেপিকে ভোটে জেতানোর আবেদনও করেছে তার অনুগামীদের কাছে, এমন তথ্যও সামনে এসেছে।
স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে ভোটের শেষ মুহূর্তেও এই জনপদে শাসক তৃণমূল ও বিজেপি’র আক্রমণের মূল নিশানা সিপিআই(এম)। কংগ্রেস সমর্থিত বামফ্রন্ট প্রার্থীকে ভোট দিলে বিপদে পড়বেন, প্রকাশ্যে তৃণমূল থেকে বিজেপি’র নেতারা, পুলিশও হুমকি দিচ্ছে, একই সুরে।
শিলিগুড়ি থেকে প্রকাশিত এক দৈনিক সংবাদপত্রের একটি খবরের ফটোকপি করে সোমবার সকালে সমস্ত সংবাদপত্রের ভাঁজে ঢুকিয়ে দিয়ে বিলি করে তৃণমূলীরা। সেই খবরের মূল কথা ধূপগুড়িতে আসল লড়াই তৃণমূল বনাম বিজেপি’র। সিপিআই(এম) লড়াইয়ে নেই, ভোট দিয়ে নষ্ট করবেন না। এমনকি সেই খবরে তৃণমূল ৪৮ শতাংশ ভোট পেয়ে জয়ী হচ্ছে তাও ঘোষণা করে দেওয়া হয়।
বিকালে ধূপগুড়িতে সিপিআই(এম) কার্যলায়ে সাংবাদিকদের কাছে এরিয়া কমিটির সম্পাদক জয়ন্ত মজুমদার বলেন এই ঘটনা নিয়ে আমরা নির্বাচন কমিশনকে লিখিত অভিযোগ জানিয়েছি। শহরের সমস্ত সরকারি বিজ্ঞাপন স্তম্ভকে বেআইনিভাবে ব্যবহার করে প্রচার চলছে। কমিশনকে অভিযোগ জানানো হলেও তারা নীরব রয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে শহরের বিভিন্ন হোটেল, বিবাহ ভবন, গেস্টহাউস দুই দলের নেতা কর্মীরা ভরে রেখেছেন। প্রচার শেষ হয়ে যাবার পরেও বহিরাগত অনেকেই রয়ে গেছে। এমনকি শহরের কয়েকটি পাড়ার কিছু বাড়িতে আত্মীয় পরিচয়ে অনেক বহিরাগত রয়েছেন বলে জানা গেছে।
...........................
ক্যাপশন: ধূপগুড়ির বানারহাট চা বাগানে বুথ সাজাচ্ছেন চা শ্রমিকরা। ছবি: প্রবীর দাশগুপ্ত
Comments :0